ঢাকা ১১:৩৩ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২২ অক্টোবর ২০২৫
সংবাদ শিরোনাম ::
Logo হাজারো মানুষের নদী পারাপারের একমাত্র মাধ্যম ঝুঁকিপূর্ণ বাঁশের সাঁকো Logo সাংবাদিক আলতাফ হোসেনের মৃত্যুবার্ষিকীতে দোয়া মাহফিল Logo চত্রা নদীতে গোসল করতে নেমে প্রবীণ ব্যক্তির মৃত্যু Logo গোলাপগঞ্জে ঢাকাদক্ষিণ সরকারী কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মঞ্জু গ্রেপ্তার Logo শতভাগ পদোন্নতি যোগ্য পদে প্রেষণে কর্মকর্তা নিয়োগের প্রতিবাদে দিনাজপুর শিক্ষাবোর্ডে কর্মচারীদের বিক্ষোভ Logo রামগতিতে বেড়েছে চুরি-ডাকাতি, আইনশৃঙ্খলার অবনতি Logo মানিকছড়িতে মাছের মিশ্রচাষ বিষয়ক প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠিত Logo ময়মনসিংহে সড়ক দুর্ঘটনায় ট্রাকের চালক ও হেলাপার নিহত Logo শিক্ষকদের বাড়ি ভাড়া বাড়ল ১৫ শতাংশ, পাবেন দুই ধাপে Logo ফেনীর ঐতিহাসিক ঘাটলা এখন জেলা জুড়ে

পিআর পদ্ধতির এপিট-ওপিট

হালিম মোহাম্মদ
  • আপডেট সময় : ১৮৫ বার পড়া হয়েছে
দৈনিক গনমুক্তি অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

পিআর পদ্ধতি নিঃসন্দেহে একটি অংশগ্রহণমূলক ও ন্যায্য নির্বাচন পদ্ধতি। এর সুষ্ঠু বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা, সাংবিধানিক সংস্কার ও জনসচেতনতা। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিপক্বতা বিবেচনায় ধাপে ধাপে আংশিকভাবে পিআর পদ্ধতির পরীক্ষামূলক প্রয়োগ হতে পারে, যাতে করে ভবিষ্যতের জন্য একটি টেকসই ও ন্যায্য নির্বাচনী কাঠামো গড়ে তোলা যায়। কিন্তু বাংলাদেশের জন্য পিআর নির্বাচন প্রচলিত নির্বাচন পক্রিয়ায় বিশাল ফারাক রয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশের জন্য পিআর কতটা উপযোগী এনিয়ে তারা বলেন, বর্তমানে দেশের বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এখনো একক আধিপত্য ও ব্যক্তি-নির্ভরতায় গড়ে উঠেছে। পিআর পদ্ধতি চালুর আগে প্রয়োজন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সহনশীলতা, জোট গঠনের বাস্তব প্রস্তুতি, স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন ব্যবস্থা। বাংলাদেশে নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই বিতর্ক ও আস্থার সংকট রয়েছে। অনেক দল ভোটে অংশ নেয় না, কেউ কেউ অংশ নিলেও ফলাফল নিয়ে প্রশ্ন তোলে। এমতাবস্থায় পিআর পদ্ধতি কিছু সমাধান দিতে পারে যেমন, অংশগ্রহণমূলক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করা, সংখ্যালঘু ও ছোট দলের কণ্ঠস্বর শোনা, রাজনৈতিক মেরুকরণ কিছুটা কমানো।
গত ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর তার অধীনে নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কারের লক্ষ্যে গঠিত বিভিন্ন কমিশন নানা প্রস্তাবনা উপস্থাপন করছে। বিশেষ করে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচন বা পিআর পদ্ধতির দিকে নজর দিচ্ছে অনেক রাজনৈতিক দল, এর মধ্যে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন, জাতীয় পার্টি এবং কমিউনিস্ট পার্টি। বর্তমান প্রেক্ষাপটে জামায়াতে ইসলামী পিআর পদ্ধতির পক্ষে শক্ত অবস্থান নিয়েয়ে। অপরদিকে শুরু থেকেই বিএনপি এই পদ্ধতির বিরোধিতা করে আসছে। প্রচলিত সংসদীয় পদ্ধতিতে নির্বাচনের পক্ষেই রয়েছে তারা।
নির্বাচনী বিশ্লেষকরা মনে করছেন, আনুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থা গণতন্ত্রকে আরও শক্তিশালী করবে এবং ভোটারদের মতামত যথাযথভাবে প্রতিফলিত করা নিশ্চিত হবে। বিএনপির আপত্তির কারণে এ নতুন পদ্ধতি বাস্তবায়ন নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। মতপার্থক্য প্রকট হচ্ছে দিন দিন। সব রাজনৈতিক দল একমত হলেই বাংলাদেশ ধীরে ধীরে আনুপাতিক ভোটিংয়ের দিকে এগোতে পারে।
আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব বা পিআর হচ্ছে নির্বাচনী ব্যবস্থার এমন একটি পদ্ধতি যেখানে আসন বণ্টন হয় প্রতিটি রাজনৈতিক দলের প্রাপ্ত ভোটের আনুপাতিক হারে। যদি কোন দল মোট প্রদত্ত ভোটের শতকরা ১০ শতাংশ পায়, তাহলে সেই দল আনুপাতিক হারে সংসদের ১০ শতাংশ বা ৩০টি আসন পাবেন। পিআর বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব নির্বাচনের ক্ষেত্রে মুক্ত, গোপন ও মিশ্র তিনটি আনুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থা রয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে।
নির্বাচন বিশ্লেষক অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ বলেন, কোনো দল নির্বাচনে যত শতাংশ ভোট পাবে, সংসদে তারা সেই অনুপাতে আসন পাবে, নির্বাচনের এই আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতি যদি চালু হয় তাহলে তা সুশাসন নিশ্চিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, সব ভোটারদের মতামতের প্রতিফলন ঘটানো সম্ভব এই পদ্ধতিতে ভোটের মাধ্যমে। কারণ হিসেবে তিনি বলছেন, অনেক সময় খুব সামান্য পার্থক্য থাকলেও অনেক দল সংসদে একটি আসনও পায় না। কিন্তু এই পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে তাতে ন্যূনতম ভোট পেলে সব রাজনৈতিক দলেরই প্রতিনিধিত্ব থাকার সুযোগ রয়েছে সংসদে।
প্রচলিত নির্বাচন ব্যবস্থার সাথে পিআর নির্বাচন পদ্ধতিতে বিশাল পার্থক্য রয়েছে। বর্তমান বাংলাদেশের সংসদীয় নির্বাচন ব্যবস্থায় ৩০০টি আসনে আলাদা আলাদা প্রার্থী দিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে রাজনৈতিক দলগুলো। বলা যায়, বর্তমান পদ্ধতিতে জাতীয় নির্বাচনে একটি আসনে মোট চারজন প্রার্থী চারটি দল থেকে নির্বাচন করছে। এই নির্বাচনে ভোট পড়েছে ৮৫ শতাংশ। এর মধ্যে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় তিনজন প্রার্থীই ২০ শতাংশ করে ভোট পেল। আর চতুর্থ প্রার্থী পেলো ২৫ শতাংশ ভোট।
বর্তমান পদ্ধতি অনুযায়ী চতুর্থ প্রার্থীই এই আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হবেন। আর ওই তিনটি দলের ৬০ শতাংশ ভোট তেমন কোন কাজে আসছে না। একই ভাবে সারাদেশের অন্তত ২৯০ আসনে যদি একই হারে ভোট পেয়ে চতুর্থ দলটির প্রার্থীরা জয়লাভ করে, তাহলে মাত্র ২৫ শতাংশ ভোট নিয়ে তারা সরকার গঠনসহ সংসদে একচ্ছত্রভাবে আধিপত্য করবে। অথচ বাকি তিন দল মিলে ৬০ শতাংশ ভোট পেলেও তাদের কোন প্রতিনিধিত্ব থাকলো না সংসদে। এতে সংসদে প্রতিনিধিত্বমূলক অংশগ্রহণ থাকে না।
নির্বাচন বিশ্লেষক অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ বলেন, এ পদ্ধতিতে ভোট হলে নিজস্ব ভোট ব্যাংকে কাজে লাগিয়ে বা স্থানীয় ইমেজ কাজে লাগিয়ে কেউ জিতে সরকার গঠন করতে পারে। সেক্ষেত্রে অনেক সময় মেজরিটি ভোটারে মতের প্রতিফলন হয় না। আর আনুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতিতে ভোটের আগে প্রতিটি দল ক্রম ভিত্তিতে প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করবে। প্রতিটি রাজনৈতিক দল তার প্রাপ্ত ভোটের হার অনুসারে আসন সংখ্যা পাবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, কিছু রাজনৈতিক দল সারা দেশে গড়ে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ ভোট পেলেও সংসদে তাদের কোন প্রতিনিধিত্ব থাকে না আসনভিত্তিক একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না হওয়ার কারণে। এই পদ্ধতিতে ভোট হলে সে সব দলের সংসদে প্রতিনিধিত্ব থাকবে।
পিআর পদ্ধতি কী? বাংলাদেশে এর সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ বর্তমান নির্বাচন ব্যবস্থার বিকল্প হিসেবে অনেকেই পিআর বা চৎড়ঢ়ড়ৎঃরড়হধষ জবঢ়ৎবংবহঃধঃরড়হ পদ্ধতির কথা বলছেন। এ পদ্ধতিতে প্রত্যেক দল তাদের প্রাপ্ত মোট ভোটের অনুপাতে সংসদে আসন পায়। একক প্রার্থী নয়, এখানে মূলত দলভিত্তিক প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হয়। ফলে কোনো দলের ভোট হারিয়ে যায় না, বরং তার প্রতিফলন সরাসরি সংসদে দেখা যায়।
পিআর পদ্ধতিতে (চৎড়ঢ়ড়ৎঃরড়হধষ জবঢ়ৎবংবহঃধঃরড়হ) ভোটগ্রহণ হয় দলভিত্তিক। যে দল মোট ভোটের যত শতাংশ পাবে, সে দল তত শতাংশ আসন পাবে। এতে একটি এলাকার পরিবর্তে পুরো দেশকেই একটি একক ভোট এলাকা হিসেবে ধরা হয়। এর ফলে ছোট দল, সংখ্যালঘু ও প্রান্তিক গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হয়।
সকল দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়। ছোট দলগুলোও পার্লামেন্টে জায়গা পেতে পারে, যার ফলে গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণ বাড়ে। ভোটের সঠিক প্রতিফলন ঘটে। কোনো ভোট ‘অপ্রয়োজনীয়’ হয় না। যার ফলে ভোটারদের মতামত সংসদে প্রতিফলিত হয়। সংখ্যালঘু ও ভিন্নমতের প্রতিনিধিত্ব বাড়ে। এতে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী ও সংখ্যালঘুরা তাদের কণ্ঠস্বর সংসদে তুলে ধরতে পারেন। রাজনৈতিক আপস ও সংলাপ উৎসাহিত হয়। যেহেতু একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা কঠিন, তাই দলগুলোর মধ্যে জোট গঠন ও সমঝোতার প্রবণতা বাড়ে। রাজনৈতিক মেরুকরণ কমে আসে।
পিআর পদ্ধতির চ্যালেঞ্জ ও ঝুঁকি, সরকার গঠনে জটিলতা। অনেক সময় কোনো দল এককভাবে সরকার গঠন করতে পারে না। জোট গঠন কঠিন হয়ে পড়ে। নীতিনির্ধারণে ধীরগতি। একাধিক দল মিলে সরকার চালালে সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিলম্ব হয়। রাজনৈতিক অস্থিরতা। জোট ভেঙে গেলে বারবার নির্বাচন দিতে হয়। এতে স্থিতিশীলতা ক্ষুণ্ন হয়। স্থানীয় প্রতিনিধিত্ব দুর্বল হয়। নির্দিষ্ট এলাকার জনগণের সমস্যা সরাসরি সংসদে না পৌঁছাতে পারে। বিশ্বের কোথায় কোথায় পিআর পদ্ধতি চালু আছে। ইউরোপের নেদারল্যান্ডস, সুইডেন, ফিনল্যান্ড, বেলজিয়াম, জার্মানি (আংশিক)। এশিয়ার ইসরায়েল, ইন্দোনেশিয়া, নেপাল, আফ্রিকা মহাদেশ, দক্ষিণ আফ্রিকা, নামিবিয়া। লাতিন আমেরিকার ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা। উত্তর আমেরিকার আংশিকভাবে কানাডা।
পিআর পদ্ধতির একটি ক্লাসিক উদাহরণ ইসরায়েল। যেখানে পুরো দেশই একক ভোট এলাকা। যে দল মাত্র ৩.২৫% ভোট পায়, তারাও আসন পায়। এতে ছোট দলগুলো সবসময় সংসদে প্রবেশ করে। কিন্তু এ পদ্ধতির ফলে দেখা দেয় কিছু সমস্যাও। তা হলো, দুর্বল জোট সরকার। একক দল কখনোই সরকার গঠন করতে পারে না। প্রায়ই জোট ভেঙে যায়, ফলে ঘনঘন নির্বাচন হয়। (২০১৯-২০২২ সালে ৫ বার নির্বাচন) ছোট দলের অস্বাভাবিক প্রভাব। ছোট দলগুলো ‘কিং-মেকার’ হয়ে উঠে। বড় দলগুলোকে জিম্মি করে তাদের দাবি আদায় করে নেয়। তা ছাড়া নীতিগত স্থবিরতা, নানা দৃষ্টিভঙ্গির কারণে বড় সংস্কার নিতে দেরি হয় বা সম্ভব হয় না। ধর্মীয় চাপ, ধর্মীয় ছোট দলগুলো আধুনিকতা ও নারী অধিকারের বিরোধিতা করে সরকারে চাপ তৈরি করে। ঘনঘন জোট পরিবর্তন ও রাজনৈতিক অস্থিরতায় জনগণের মধ্যে আস্থা কমে।

নিউজটি শেয়ার করুন

ট্যাগস :

পিআর পদ্ধতির এপিট-ওপিট

আপডেট সময় :

পিআর পদ্ধতি নিঃসন্দেহে একটি অংশগ্রহণমূলক ও ন্যায্য নির্বাচন পদ্ধতি। এর সুষ্ঠু বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা, সাংবিধানিক সংস্কার ও জনসচেতনতা। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিপক্বতা বিবেচনায় ধাপে ধাপে আংশিকভাবে পিআর পদ্ধতির পরীক্ষামূলক প্রয়োগ হতে পারে, যাতে করে ভবিষ্যতের জন্য একটি টেকসই ও ন্যায্য নির্বাচনী কাঠামো গড়ে তোলা যায়। কিন্তু বাংলাদেশের জন্য পিআর নির্বাচন প্রচলিত নির্বাচন পক্রিয়ায় বিশাল ফারাক রয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশের জন্য পিআর কতটা উপযোগী এনিয়ে তারা বলেন, বর্তমানে দেশের বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এখনো একক আধিপত্য ও ব্যক্তি-নির্ভরতায় গড়ে উঠেছে। পিআর পদ্ধতি চালুর আগে প্রয়োজন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সহনশীলতা, জোট গঠনের বাস্তব প্রস্তুতি, স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন ব্যবস্থা। বাংলাদেশে নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই বিতর্ক ও আস্থার সংকট রয়েছে। অনেক দল ভোটে অংশ নেয় না, কেউ কেউ অংশ নিলেও ফলাফল নিয়ে প্রশ্ন তোলে। এমতাবস্থায় পিআর পদ্ধতি কিছু সমাধান দিতে পারে যেমন, অংশগ্রহণমূলক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করা, সংখ্যালঘু ও ছোট দলের কণ্ঠস্বর শোনা, রাজনৈতিক মেরুকরণ কিছুটা কমানো।
গত ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর তার অধীনে নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কারের লক্ষ্যে গঠিত বিভিন্ন কমিশন নানা প্রস্তাবনা উপস্থাপন করছে। বিশেষ করে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচন বা পিআর পদ্ধতির দিকে নজর দিচ্ছে অনেক রাজনৈতিক দল, এর মধ্যে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন, জাতীয় পার্টি এবং কমিউনিস্ট পার্টি। বর্তমান প্রেক্ষাপটে জামায়াতে ইসলামী পিআর পদ্ধতির পক্ষে শক্ত অবস্থান নিয়েয়ে। অপরদিকে শুরু থেকেই বিএনপি এই পদ্ধতির বিরোধিতা করে আসছে। প্রচলিত সংসদীয় পদ্ধতিতে নির্বাচনের পক্ষেই রয়েছে তারা।
নির্বাচনী বিশ্লেষকরা মনে করছেন, আনুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থা গণতন্ত্রকে আরও শক্তিশালী করবে এবং ভোটারদের মতামত যথাযথভাবে প্রতিফলিত করা নিশ্চিত হবে। বিএনপির আপত্তির কারণে এ নতুন পদ্ধতি বাস্তবায়ন নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। মতপার্থক্য প্রকট হচ্ছে দিন দিন। সব রাজনৈতিক দল একমত হলেই বাংলাদেশ ধীরে ধীরে আনুপাতিক ভোটিংয়ের দিকে এগোতে পারে।
আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব বা পিআর হচ্ছে নির্বাচনী ব্যবস্থার এমন একটি পদ্ধতি যেখানে আসন বণ্টন হয় প্রতিটি রাজনৈতিক দলের প্রাপ্ত ভোটের আনুপাতিক হারে। যদি কোন দল মোট প্রদত্ত ভোটের শতকরা ১০ শতাংশ পায়, তাহলে সেই দল আনুপাতিক হারে সংসদের ১০ শতাংশ বা ৩০টি আসন পাবেন। পিআর বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব নির্বাচনের ক্ষেত্রে মুক্ত, গোপন ও মিশ্র তিনটি আনুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থা রয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে।
নির্বাচন বিশ্লেষক অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ বলেন, কোনো দল নির্বাচনে যত শতাংশ ভোট পাবে, সংসদে তারা সেই অনুপাতে আসন পাবে, নির্বাচনের এই আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতি যদি চালু হয় তাহলে তা সুশাসন নিশ্চিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, সব ভোটারদের মতামতের প্রতিফলন ঘটানো সম্ভব এই পদ্ধতিতে ভোটের মাধ্যমে। কারণ হিসেবে তিনি বলছেন, অনেক সময় খুব সামান্য পার্থক্য থাকলেও অনেক দল সংসদে একটি আসনও পায় না। কিন্তু এই পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে তাতে ন্যূনতম ভোট পেলে সব রাজনৈতিক দলেরই প্রতিনিধিত্ব থাকার সুযোগ রয়েছে সংসদে।
প্রচলিত নির্বাচন ব্যবস্থার সাথে পিআর নির্বাচন পদ্ধতিতে বিশাল পার্থক্য রয়েছে। বর্তমান বাংলাদেশের সংসদীয় নির্বাচন ব্যবস্থায় ৩০০টি আসনে আলাদা আলাদা প্রার্থী দিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে রাজনৈতিক দলগুলো। বলা যায়, বর্তমান পদ্ধতিতে জাতীয় নির্বাচনে একটি আসনে মোট চারজন প্রার্থী চারটি দল থেকে নির্বাচন করছে। এই নির্বাচনে ভোট পড়েছে ৮৫ শতাংশ। এর মধ্যে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় তিনজন প্রার্থীই ২০ শতাংশ করে ভোট পেল। আর চতুর্থ প্রার্থী পেলো ২৫ শতাংশ ভোট।
বর্তমান পদ্ধতি অনুযায়ী চতুর্থ প্রার্থীই এই আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হবেন। আর ওই তিনটি দলের ৬০ শতাংশ ভোট তেমন কোন কাজে আসছে না। একই ভাবে সারাদেশের অন্তত ২৯০ আসনে যদি একই হারে ভোট পেয়ে চতুর্থ দলটির প্রার্থীরা জয়লাভ করে, তাহলে মাত্র ২৫ শতাংশ ভোট নিয়ে তারা সরকার গঠনসহ সংসদে একচ্ছত্রভাবে আধিপত্য করবে। অথচ বাকি তিন দল মিলে ৬০ শতাংশ ভোট পেলেও তাদের কোন প্রতিনিধিত্ব থাকলো না সংসদে। এতে সংসদে প্রতিনিধিত্বমূলক অংশগ্রহণ থাকে না।
নির্বাচন বিশ্লেষক অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ বলেন, এ পদ্ধতিতে ভোট হলে নিজস্ব ভোট ব্যাংকে কাজে লাগিয়ে বা স্থানীয় ইমেজ কাজে লাগিয়ে কেউ জিতে সরকার গঠন করতে পারে। সেক্ষেত্রে অনেক সময় মেজরিটি ভোটারে মতের প্রতিফলন হয় না। আর আনুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতিতে ভোটের আগে প্রতিটি দল ক্রম ভিত্তিতে প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করবে। প্রতিটি রাজনৈতিক দল তার প্রাপ্ত ভোটের হার অনুসারে আসন সংখ্যা পাবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, কিছু রাজনৈতিক দল সারা দেশে গড়ে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ ভোট পেলেও সংসদে তাদের কোন প্রতিনিধিত্ব থাকে না আসনভিত্তিক একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না হওয়ার কারণে। এই পদ্ধতিতে ভোট হলে সে সব দলের সংসদে প্রতিনিধিত্ব থাকবে।
পিআর পদ্ধতি কী? বাংলাদেশে এর সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ বর্তমান নির্বাচন ব্যবস্থার বিকল্প হিসেবে অনেকেই পিআর বা চৎড়ঢ়ড়ৎঃরড়হধষ জবঢ়ৎবংবহঃধঃরড়হ পদ্ধতির কথা বলছেন। এ পদ্ধতিতে প্রত্যেক দল তাদের প্রাপ্ত মোট ভোটের অনুপাতে সংসদে আসন পায়। একক প্রার্থী নয়, এখানে মূলত দলভিত্তিক প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হয়। ফলে কোনো দলের ভোট হারিয়ে যায় না, বরং তার প্রতিফলন সরাসরি সংসদে দেখা যায়।
পিআর পদ্ধতিতে (চৎড়ঢ়ড়ৎঃরড়হধষ জবঢ়ৎবংবহঃধঃরড়হ) ভোটগ্রহণ হয় দলভিত্তিক। যে দল মোট ভোটের যত শতাংশ পাবে, সে দল তত শতাংশ আসন পাবে। এতে একটি এলাকার পরিবর্তে পুরো দেশকেই একটি একক ভোট এলাকা হিসেবে ধরা হয়। এর ফলে ছোট দল, সংখ্যালঘু ও প্রান্তিক গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হয়।
সকল দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়। ছোট দলগুলোও পার্লামেন্টে জায়গা পেতে পারে, যার ফলে গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণ বাড়ে। ভোটের সঠিক প্রতিফলন ঘটে। কোনো ভোট ‘অপ্রয়োজনীয়’ হয় না। যার ফলে ভোটারদের মতামত সংসদে প্রতিফলিত হয়। সংখ্যালঘু ও ভিন্নমতের প্রতিনিধিত্ব বাড়ে। এতে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী ও সংখ্যালঘুরা তাদের কণ্ঠস্বর সংসদে তুলে ধরতে পারেন। রাজনৈতিক আপস ও সংলাপ উৎসাহিত হয়। যেহেতু একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা কঠিন, তাই দলগুলোর মধ্যে জোট গঠন ও সমঝোতার প্রবণতা বাড়ে। রাজনৈতিক মেরুকরণ কমে আসে।
পিআর পদ্ধতির চ্যালেঞ্জ ও ঝুঁকি, সরকার গঠনে জটিলতা। অনেক সময় কোনো দল এককভাবে সরকার গঠন করতে পারে না। জোট গঠন কঠিন হয়ে পড়ে। নীতিনির্ধারণে ধীরগতি। একাধিক দল মিলে সরকার চালালে সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিলম্ব হয়। রাজনৈতিক অস্থিরতা। জোট ভেঙে গেলে বারবার নির্বাচন দিতে হয়। এতে স্থিতিশীলতা ক্ষুণ্ন হয়। স্থানীয় প্রতিনিধিত্ব দুর্বল হয়। নির্দিষ্ট এলাকার জনগণের সমস্যা সরাসরি সংসদে না পৌঁছাতে পারে। বিশ্বের কোথায় কোথায় পিআর পদ্ধতি চালু আছে। ইউরোপের নেদারল্যান্ডস, সুইডেন, ফিনল্যান্ড, বেলজিয়াম, জার্মানি (আংশিক)। এশিয়ার ইসরায়েল, ইন্দোনেশিয়া, নেপাল, আফ্রিকা মহাদেশ, দক্ষিণ আফ্রিকা, নামিবিয়া। লাতিন আমেরিকার ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা। উত্তর আমেরিকার আংশিকভাবে কানাডা।
পিআর পদ্ধতির একটি ক্লাসিক উদাহরণ ইসরায়েল। যেখানে পুরো দেশই একক ভোট এলাকা। যে দল মাত্র ৩.২৫% ভোট পায়, তারাও আসন পায়। এতে ছোট দলগুলো সবসময় সংসদে প্রবেশ করে। কিন্তু এ পদ্ধতির ফলে দেখা দেয় কিছু সমস্যাও। তা হলো, দুর্বল জোট সরকার। একক দল কখনোই সরকার গঠন করতে পারে না। প্রায়ই জোট ভেঙে যায়, ফলে ঘনঘন নির্বাচন হয়। (২০১৯-২০২২ সালে ৫ বার নির্বাচন) ছোট দলের অস্বাভাবিক প্রভাব। ছোট দলগুলো ‘কিং-মেকার’ হয়ে উঠে। বড় দলগুলোকে জিম্মি করে তাদের দাবি আদায় করে নেয়। তা ছাড়া নীতিগত স্থবিরতা, নানা দৃষ্টিভঙ্গির কারণে বড় সংস্কার নিতে দেরি হয় বা সম্ভব হয় না। ধর্মীয় চাপ, ধর্মীয় ছোট দলগুলো আধুনিকতা ও নারী অধিকারের বিরোধিতা করে সরকারে চাপ তৈরি করে। ঘনঘন জোট পরিবর্তন ও রাজনৈতিক অস্থিরতায় জনগণের মধ্যে আস্থা কমে।