বিএনপিতে ত্যাগী নেতারা কোনঠাসা

- আপডেট সময় : ১০:২২:৩১ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১ জুলাই ২০২৫ ২১ বার পড়া হয়েছে
সুবিধাবাদী আর হাইব্রিড নেতাকর্মীদের অপতৎপরতায় ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে উঠছে তৃণমূল বিএনপি। বিএনপি, অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনে হাইব্রিডদের পদচারণায় কোণঠাসা হয়ে পড়েছে বহু বছরের ত্যাগী, যোগ্য, বঞ্চিত ও অবহেলিত নেতারা। বিগত আওয়ামী সরকারের আমলে যারা রাজপথের লড়াইয়ে সম্মুখসারিতে ছিল, তারাই এখন হাইব্রিডদের চাপে দলবিমুখ হয়ে পড়ছে।
দলের প্রবীণ নেতারা জানান, গত ৫ আগস্টের আগে যারা নির্বিঘ্নে ব্যবসা-বাণিজ্য করেছেন, তাল মিলিয়ে চলেছেন আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে, তারাই এখন বিএনপির ‘হর্তাকর্তা’। তাদের সঙ্গে যোগ হয়েছেন নব্য বিএনপি নামধারী অনেকে। যারা কখনোই বিএনপিতে সম্পৃক্ত ছিলেন না। অথচ তারাই এখন দখল, টেন্ডার ও চাঁদাবাজিসহ নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়েছেন। এসব ঘটনার তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ‘হাইব্রিড’দের সংশ্লিষ্টতা পেয়েছেন দলটির দায়িত্বপ্রাপ্তরা। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, বিএনপি ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীর ওপর দায় চাপানো হয়েছে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে দলটির ত্যাগী এবং দুঃসময়ের নেতাকর্মীরা বিব্রত এবং এক রকমের কোণঠাসা। এ অবস্থায় অন্য দল থেকে আসা কিংবা সুবিধাবাদীরা দলের প্রতিটি সেক্টরে গেড়ে বসতে শুরু করেছে। যারা বিগত ১৬ বছর আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে শুরু করে টেন্ডারবাজি পর্যন্ত সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিয়ে ফুলে-ফেঁপে উঠেছে, তারা বিগত সরকার আমলে বিএনপির রাজনীতিতে না থাকলেও বর্তমান সময়ে হর্তাকর্তা হয়ে উঠছে। এদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় তৃণমূল কর্মীরা আশাহত হয়ে পড়েছে।
দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জেলার প্রায় প্রতিটি উপজেলায় বিএনপি নামধারী হাইব্রিড ও সুবিধাবাদী ব্যক্তিরা বিভিন্ন স্থানে পুকুর খনন, দখল, টেন্ডার ও চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছে। এসব ঘটনার তদন্তে বেশিরভাগই হয় ‘হাইব্রিড’ নয়তো সুবিধাবাদী টাউট-বাটপার শ্রেণির ব্যক্তিদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যাচ্ছে। অথচ নাম আসছে বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের নেতৃবৃন্দের।
যদিও হাইব্রিডদের বিষয়ে পটপরিবর্তনের শুরু থেকেই কঠোর বিএনপি হাইকমান্ড। এখন থেকে আরও কঠোর হচ্ছে। কেন্দ্র থেকে তৃণমূলে নির্দেশনা দিয়ে হাইব্রিডদের দলে জায়গা না দেওয়ার বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছে। এমনকি দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে নেওয়া হয়েছে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা। যাদের বিরুদ্ধে অপকর্মের অভিযোগ উঠেছে তদন্ত করে প্রমাণ পেলে বহিষ্কার করেছে।
তবে দলের হাইকমান্ড বলছে, হাইব্রিডদের কাছে থেকে সর্তক থাকতে নেতাকর্মীদের নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। যারা হাইব্রিড কিংবা অন্যদলের ব্যক্তিদের বিএনপিতে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিবে, তাদের বিরুদ্ধেও সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
কেন্দ্রীয় দপ্তর সূত্র জানিয়েছে, গত ৯ মাসে বিএনপি ও অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের ৩ হাজার ২১০ জন নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিয়েছে। এর মধ্যে বিএনপিই ১ হাজার ৮২০ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছে। এর মধ্যে অন্তত ৭০০ জনকে কারণ দর্শানো নোটিশ, ৮০০ জনকে বহিষ্কার, ৫০ জনের পদ স্থগিত, অন্তত ১০০ জনকে সতর্ক এবং ১৫০ জনকে সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ভঙ্গের নোটিশ দেওয়া হয়েছে। সহযোগী সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলও এ পর্যন্ত ৪০০ জনকে বহিষ্কার ও ৬০০-এর অধিক নেতাকর্মীকে কারণ দর্শানো নোটিশ দিয়েছে। অঙ্গসংগঠন স্বেচ্ছাসেবক দলের অন্তত ১০০ জনকে বহিষ্কার ও ১৫০ জনকে কারণ দর্শানো নোটিশ দেওয়া হয়েছে। যুবদলেরও শতাধিক নেতাকর্মীকে বহিষ্কার করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীদের অপরাধমূলক কর্মকা- এবং দলীয় শৃঙ্খলার ব্যাপারে খুব কঠোর অবস্থান নিয়েছেন। যা সারা দেশে প্রশংসা পেয়েছে। পটপরিবর্তনের পর ১১ আগস্ট দলের একজন সাংগঠনিক সম্পাদকের পদ স্থগিত করার মধ্য দিয়ে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ শুরু হয়। হেভিওয়েট নেতাদের মধ্যে সর্বশেষ ৫ মার্চ বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট মাসুদ আহমেদ তালুকদারের দলীয় প্রাথমিক সদস্য পদসহ সব পর্যায়ের পদ স্থগিত করা হয়। সংগঠনের পরিচয় ব্যবহার করে কোথাও দখল বাণিজ্যের কোনোরূপ ঘটনা পরিলক্ষিত হওয়া মাত্রই অপরাধীকে তাৎক্ষণিক ঘটনাস্থলে আটক করে কেন্দ্রীয় দপ্তরে জানানোর জন্য সচেতন জনসাধারণ ও ভুক্তভোগীসহ সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি বিশেষভাবে অনুরোধ জানিয়ে বিবৃতিও দিয়েছে যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদলসহ অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলো।
হাইব্রিডদের বিষয়ে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী বলেন, হাইব্রিড নেতাদের বিষয়ে তারা সতর্ক রয়েছেন। এরই মধ্যে দল থেকে নেতাকর্মীদের সতর্ক করা হয়েছে। দলে যোগদান অনুষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়েছে। এরপরও বিভিন্ন জায়গায় বিএনপির নাম ভাঙিয়ে অনেকে অনেক অপকর্ম করছেন। যাদের সঙ্গে বিএনপির ন্যূনতম কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। এসব বিষয়ে তারা যথেষ্ট সজাগ রয়েছেন। বিএনপির দুর্দিনে যারা ত্যাগ স্বীকার করেছেন, পরিশ্রম করেছেন-দল তাদের মূল্যায়ন করবে। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এ বিষয়ে তৃণমূলের নেতাকর্মীকে বিভিন্ন সময়ে আশ্বস্ত করেছেন।
দলটির বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীর সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, দলীয় কার্যালয় ছাড়াও বিভিন্ন সড়কের অলিগলিতে হাইব্রিড নেতাদের ব্যানার, পোস্টার শোভা পাচ্ছে। বিভিন্ন নেতার বাসাবাড়ি কিংবা অফিসে এসব নেতার পদচারণাও বাড়ছে। ভিড় করছেন বিভিন্ন লবিং-তদবির নিয়ে। অন্যদিকে, দীর্ঘ ১৭ বছর ধরে যেসব নেতাকর্মী রাজপথে ছিলেন, মামলা-হামলায় সর্বস্বান্ত হয়েছেন, পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন, ঘরছাড়া হয়েছেন, তারা এখন অনেকটা অসহায়। হাইব্রিড নেতাদের চাপে তাদের অনেকেই এখন দলীয় কার্যালয়, নেতাদের বাসাবাড়ি এড়িয়ে চলছেন। অহেতুক মিথ্যা অভিযোগে বহিষ্কার আতঙ্ক নিয়ে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছেন অনেকে। বিএনপির একাধিক নেতা জানান, ৫ আগস্টের আগে নয়াপল্টনের কার্যালয়ে গুটিকয়েক নেতাকর্মীকে দেখা যেত। কিন্তু পটপরিবর্তনের পর এখন নেতাকর্মীদের ভিড়ে কার্যালয়ে ঢোকাই যায় না।