ঢাকা ০৪:২৮ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৭ জুন ২০২৫

বিলুপ্তির পথে কাউন

গণমুক্তি রিপোর্ট
  • আপডেট সময় : ১০:৩৪:০৫ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৬ জুন ২০২৫ ৮৪ বার পড়া হয়েছে
দৈনিক গনমুক্তি অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

হারিয়ে যাওয়ার পথে কুড়িগ্রামের চরাঞ্চলে একসময়ের পরিচিত ও পুষ্টিকর খাদ্যশস্য কাউন। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে কৃষিজীবী মানুষের খাবারের অংশ হয়ে থাকা এই শস্য এখন আর চরাঞ্চলের মাঠে আগের মতো দেখা যায় না। জেলার প্রত্যন্ত চরের কৃষকরা কাউন চাষ ছেড়ে ঝুঁকছেন বেশি লাভজনক ও উচ্চ ফলনের ফসলের দিকে। কুড়িগ্রাম কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ২০২৫ সালে জেলায় কাউনের চাষ নেমে এসেছে মাত্র ৬০ হেক্টর জমিতে। অথচ গত বছরও ৪২০ হেক্টর জমিতে কাউন চাষ হয়েছিল। দুই দশক আগে অন্তত বিশ হাজার হেক্টর জমিতে এ শস্যের চাষ হতো। একসময় যে চরভূমিতে সোনালি কাউনের ঢেউ উঠত, সেখানে এখন চাষ হচ্ছে ধান, ভুট্টা, মিষ্টি কুমড়াসহ অন্যান্য বাণিজ্যিক ফসল।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, কুড়িগ্রামের উপপরিচালক আবদুল্লাহ আল মামুন ইউএনবিকে বলেন, “বর্তমান ধারায় পরিবর্তন না এলে এক দশকের মধ্যেই চরাঞ্চল থেকে চিরতরে হারিয়ে যেতে পারে কাউন। এটি শুধু ফসলচক্রের পরিবর্তন নয়, বরং একটি গ্রামীণ খাদ্য ঐতিহ্যের অবক্ষয়। কাউন বা ফক্সটেল মিলেট শুষ্ক সহনশীল ও কম খরচের একটি শস্য। বন্যা বা দুর্ভিক্ষের সময়গুলোতে চরবাসীর ভরসা ছিল এই কাউন। ধানের চেয়ে অনেক কম পানি ও সার লাগে বলে দরিদ্র কৃষকরা সহজে এটি চাষ করতেন এবং ভাতের বিকল্প খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করতেন। তবে সময় বদলেছে। এখনকার কৃষকেরা ভাবেন লাভের কথা। কাউনে লাভ নেই, বলছিলেন নাগেশ্বরীর চর বামনডাঙ্গার কৃষক নজরুল ইসলাম (৬৫)। তিনি আরও বলেন, গত বছর পাঁচ বিঘায় (চাষ) করেছিলাম, এবার করেছি এক বিঘায়। প্রতি বিঘা থেকে চার থেকে ছয় মণ কাউন পাওয়া যায়। প্রতি মণ বিক্রি হয় ১,২০০ থেকে ১,৩০০ টাকায়; কিন্তু খরচ পড়ে আড়াই হাজার টাকা। হিসাব মেলে না। বাড়তি উৎপাদন খরচ, শ্রমিক সংকট আর ভোক্তার রুচির পরিবর্তনে কাউন আজ অতীতের স্মৃতি হওয়ার পথে। অনেকেই মনে করেন, এই শস্য আর যুগের সঙ্গে খাপ খায় না।
কুড়িগ্রাম সদরের চর ত্রাপুরের কৃষক বদিয়ার রহমান (৭৭) বলেন, আগে বন্যার কারণে ধান হতো না; তখন কাউনই ছিল ভাত। এখন হাইব্রিড ধান করি, ভুট্টাও হয় ভালো। কেউ আর কাউন খায় না। অভিজ্ঞতা হাতড়ে বদিয়ার রহমান বলেন, একসময় আমরা কাউনের ভাত খেতাম নিয়মিত, শরীরে শক্তিও পেতাম। এখন সেই স্বাদই ভুলে গেছি। গল্প এখানেই শেষ নয়। মানুষ না খেলেও, এই শস্য এখন পাখির খাবার হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। চিলমারির জোড়গাছ বাজারের ব্যবসায়ী মমতাজ আলী বলেন, কৃষকের কাছ থেকে কাউন কিনে আমি ঢাকার পাখির বাজারে পাঠাই। এখন পাখিপ্রেমীরাই কাউনের বড় ক্রেতা। তার মতে, এক সময়ের নিত্যপ্রয়োজনীয় শস্য আজ সংস্কৃতি ও অর্থনীতির দিক থেকে পরিণত হয়েছে এক প্রান্তিক পণ্যে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের রংপুর অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক শফিকুল ইসলাম বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের এই সময়ে কাউনের মতো খরাসহনশীল ও কম খরচের ফসল অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু সরকারি উদ্যোগ ও বাজার উৎসাহ না থাকলে চাষীরা এই ফসল টিকিয়ে রাখতে আগ্রহী হবেন না।

নিউজটি শেয়ার করুন

ট্যাগস :

বিলুপ্তির পথে কাউন

আপডেট সময় : ১০:৩৪:০৫ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৬ জুন ২০২৫

হারিয়ে যাওয়ার পথে কুড়িগ্রামের চরাঞ্চলে একসময়ের পরিচিত ও পুষ্টিকর খাদ্যশস্য কাউন। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে কৃষিজীবী মানুষের খাবারের অংশ হয়ে থাকা এই শস্য এখন আর চরাঞ্চলের মাঠে আগের মতো দেখা যায় না। জেলার প্রত্যন্ত চরের কৃষকরা কাউন চাষ ছেড়ে ঝুঁকছেন বেশি লাভজনক ও উচ্চ ফলনের ফসলের দিকে। কুড়িগ্রাম কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ২০২৫ সালে জেলায় কাউনের চাষ নেমে এসেছে মাত্র ৬০ হেক্টর জমিতে। অথচ গত বছরও ৪২০ হেক্টর জমিতে কাউন চাষ হয়েছিল। দুই দশক আগে অন্তত বিশ হাজার হেক্টর জমিতে এ শস্যের চাষ হতো। একসময় যে চরভূমিতে সোনালি কাউনের ঢেউ উঠত, সেখানে এখন চাষ হচ্ছে ধান, ভুট্টা, মিষ্টি কুমড়াসহ অন্যান্য বাণিজ্যিক ফসল।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, কুড়িগ্রামের উপপরিচালক আবদুল্লাহ আল মামুন ইউএনবিকে বলেন, “বর্তমান ধারায় পরিবর্তন না এলে এক দশকের মধ্যেই চরাঞ্চল থেকে চিরতরে হারিয়ে যেতে পারে কাউন। এটি শুধু ফসলচক্রের পরিবর্তন নয়, বরং একটি গ্রামীণ খাদ্য ঐতিহ্যের অবক্ষয়। কাউন বা ফক্সটেল মিলেট শুষ্ক সহনশীল ও কম খরচের একটি শস্য। বন্যা বা দুর্ভিক্ষের সময়গুলোতে চরবাসীর ভরসা ছিল এই কাউন। ধানের চেয়ে অনেক কম পানি ও সার লাগে বলে দরিদ্র কৃষকরা সহজে এটি চাষ করতেন এবং ভাতের বিকল্প খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করতেন। তবে সময় বদলেছে। এখনকার কৃষকেরা ভাবেন লাভের কথা। কাউনে লাভ নেই, বলছিলেন নাগেশ্বরীর চর বামনডাঙ্গার কৃষক নজরুল ইসলাম (৬৫)। তিনি আরও বলেন, গত বছর পাঁচ বিঘায় (চাষ) করেছিলাম, এবার করেছি এক বিঘায়। প্রতি বিঘা থেকে চার থেকে ছয় মণ কাউন পাওয়া যায়। প্রতি মণ বিক্রি হয় ১,২০০ থেকে ১,৩০০ টাকায়; কিন্তু খরচ পড়ে আড়াই হাজার টাকা। হিসাব মেলে না। বাড়তি উৎপাদন খরচ, শ্রমিক সংকট আর ভোক্তার রুচির পরিবর্তনে কাউন আজ অতীতের স্মৃতি হওয়ার পথে। অনেকেই মনে করেন, এই শস্য আর যুগের সঙ্গে খাপ খায় না।
কুড়িগ্রাম সদরের চর ত্রাপুরের কৃষক বদিয়ার রহমান (৭৭) বলেন, আগে বন্যার কারণে ধান হতো না; তখন কাউনই ছিল ভাত। এখন হাইব্রিড ধান করি, ভুট্টাও হয় ভালো। কেউ আর কাউন খায় না। অভিজ্ঞতা হাতড়ে বদিয়ার রহমান বলেন, একসময় আমরা কাউনের ভাত খেতাম নিয়মিত, শরীরে শক্তিও পেতাম। এখন সেই স্বাদই ভুলে গেছি। গল্প এখানেই শেষ নয়। মানুষ না খেলেও, এই শস্য এখন পাখির খাবার হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। চিলমারির জোড়গাছ বাজারের ব্যবসায়ী মমতাজ আলী বলেন, কৃষকের কাছ থেকে কাউন কিনে আমি ঢাকার পাখির বাজারে পাঠাই। এখন পাখিপ্রেমীরাই কাউনের বড় ক্রেতা। তার মতে, এক সময়ের নিত্যপ্রয়োজনীয় শস্য আজ সংস্কৃতি ও অর্থনীতির দিক থেকে পরিণত হয়েছে এক প্রান্তিক পণ্যে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের রংপুর অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক শফিকুল ইসলাম বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের এই সময়ে কাউনের মতো খরাসহনশীল ও কম খরচের ফসল অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু সরকারি উদ্যোগ ও বাজার উৎসাহ না থাকলে চাষীরা এই ফসল টিকিয়ে রাখতে আগ্রহী হবেন না।