বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির পাঁয়তারা…

- আপডেট সময় : ১০:৪৭:৩২ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৫ ২৫ বার পড়া হয়েছে
আওয়ামীলীগের পরিকল্পিত গুজব
- সরকারের বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রচারণা
- দেশে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির পাঁয়তারা
- শেখ হাসিনাকে ঘিরে ইতিবাচক গুজব
- বিদেশে বসে ছড়ানো হচ্ছে গুজবের ৮০%
- ভুয়া ফটোকার্ড দিয়ে গণমাধ্যমের নাম ব্যবহার
- তিন মাসে ছড়ানো হয় ৭ শতাধিক গুজব
- বিএনপি-জামায়াত-এনসিপির বিরুদ্ধে অপপ্রচার
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অস্থিরতা তৈরির লক্ষ্যে পরিকল্পিতভাবে গুজব ছড়িয়ে যাচ্ছে পতিত সরকারের লোকজন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, ইউটিউব ব্যবহার করে গুজব ছড়িয়ে অন্তর্বর্তী সরকারকে উৎখাত ছাড়াও সমাজ ও রাষ্ট্রে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে একটি চক্র। গুজব ছড়িয়ে মব তৈরির চেষ্টাও অব্যাহত রেখেছে তারা। গুজবের ৮০ শতাংশ বিদেশে বসে ছড়ানোর ফলে জড়িতদের আইনের আওতায় আনা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষে কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। চলতি বছরের তিন মাসে আটশর বেশি গুজব ছড়ানো হয়েছে সামাজিকমাধ্যমে। গুজবের অনেক তথ্য ও পেজ পাশের দেশ থেকে ছড়ানো হচ্ছে বলে প্রমাণ পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকরী বাহিনী ও ফ্যাক্টচেক করা ব্যক্তিরা। সম্প্রতি সামাজিকমাধ্যমে ভাইরাল হয় উপদেষ্টা পরিষদে পরিবর্তন আসছে। এমন একটি প্রজ্ঞাপনের কাগজ সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব জানান বিষয়টি ভুয়া। সেনাপ্রধান পদত্যাগ করেছেন বলে গত ১১ মার্চ গভীর রাতে সামাজিকমাধ্যমে একটি খবর ছড়িয়ে পড়ে। আদতে ঘটনাটি ছিল গুজব। শুধু সেনাপ্রধানই নয় প্রধান উপদেষ্টার পদত্যাগেরও গুজব ছড়িয়েছে একটি মহল। জাতিসংঘের মহাসচিব গুতেরেসের ঢাকা সফরে শেখ হাসিনার ছবি সংযুক্ত করে ছড়ানো হয় গুজব। বেশি গুজব ছড়ানো হয় রাজনৈতিক দলগুলোকে টার্গেট করে।
সোশ্যাল মিডিয়ায় গত কয়েকদিন ধরে একটি মেয়ের ধূমপান ও মদ্যপানের ভিডিও ভাইরাল করে ছড়ানো হয়েছে সমন্বয়ক রুবাইয়া ইয়াসমিন নামে। ভাইরালের পর এ নিয়ে বিভিন্ন মহলে শুরু হয় আলোচনা-সমালোচনা ও ব্যক্তিগত আক্রমণ। তবে জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপির এই গুজবের বিরুদ্ধে সোচ্চার অবস্থান নিয়েছেন। জানা যায়, ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে যাকে দেখা গেছে, তার নাম রুবাইয়া ইয়াসমিন নয়, বরং এমএক্স জুথী নামে পরিচিত এক তরুণী। ওই তরুণীর কোনো রাজনৈতিক পরিচয় নেই এবং তিনি কোনো সমন্বয়কও নন। কিন্তু প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে তাকে রাজনৈতিক পরিচয়ে ট্যাগ করে নোংরামি চালান একটি পক্ষ। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের লন্ডনপ্রবাসী কন্যা জাইমা রহমানের নাম ও ছবি ব্যবহার করে ফেসবুকে অসংখ্য ভুয়া আইডি, পেজ ও গ্রুপ খোলেন সংঘবদ্ধ চক্রটি।
চলতি বছরের শুরুতেই ভুল তথ্য ছড়ানোর হিড়িক পড়ে বাংলাদেশে। ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠান রিউমর স্ক্যানারের এক চমকপ্রদ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, ২০২৫ সালের প্রথম তিন মাসে (জানুয়ারি-মার্চ) ভুল তথ্য ছড়ানোর হার আগের প্রান্তিকের তুলনায় ২১ শতাংশ এবং গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ২৮ শতাংশ বেড়েছে। তিন মাসে মোট ৮৩৭টি ভুল তথ্য শনাক্ত করে রিউমর স্ক্যানার বলছে, ব্যক্তি হিসেবে শেখ হাসিনা এবং রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীকে ঘিরে ছড়ানো হয়েছে সবচেয়ে বেশি ভুয়া তথ্য।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে নিয়ে যেসব ভুল তথ্য ছড়িয়েছে, তার ৮০ শতাংশই ছিল ইতিবাচক। বিভিন্ন ভুয়া খবর ও পোস্টে তাঁকে প্রশংসার সুরে উপস্থাপন করা হয়েছে, যদিও সেগুলোর অনেকগুলোরই বাস্তবতার সঙ্গে মিল নেই। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভুল তথ্য ছড়ানো হয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে। দলটির পাশাপাশি তাদের সহযোগী সংগঠন ও নেতাকর্মীদের নিয়েও ছড়ানো হয়েছে অন্তত ৮১টি বিভ্রান্তিকর ও মিথ্যা তথ্য।
ভুল তথ্য ছড়ানোর সবচেয়ে বড় প্ল্যাটফর্ম হিসেবে উঠে এসেছে ফেসবুকের নাম। এই প্ল্যাটফর্মে একাই ৭৪৮টি ভুয়া তথ্য শনাক্ত হয়েছে। গড়ে প্রতিদিন আটটিরও বেশি ভুল তথ্য ছড়িয়েছে শুধু ফেসবুকে! এরপরে এক্স (১৬২টি), ইউটিউব (১২৪টি) এবং টিকটক ও ইনস্টাগ্রামে (৬৭টি করে) ভুল তথ্য ছড়ানোর ঘটনা মিলেছে।
রিউমর স্ক্যানারের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, প্রথম প্রান্তিকে ছড়ানো ভুল তথ্যের ৪১ শতাংশই ছিল সরাসরি রাজনৈতিক ইস্যু ঘিরে। জাতীয় নানা ইস্যুতে ২৯ শতাংশ এবং ধর্মীয় ইস্যুতে ৯ শতাংশ ভুল তথ্য ছড়ানো হয়েছে। চলতি বছরের শুরুতে অন্তর্বর্তী সরকারকে ঘিরে ৪৪টি ভুল তথ্য ছড়ানো হয়েছে, যার ৯৩ শতাংশই ছিল স্পষ্টভাবে নেতিবাচক। একই সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, বিশেষ করে সেনাবাহিনীকে কেন্দ্র করেও প্রচারিত হয়েছে একের পর এক মিথ্যা তথ্য সর্বমোট ৬০টি ভুল তথ্য শনাক্ত হয়েছে, যার মধ্যে ৪২টি সেনাবাহিনী নিয়ে।
ভুল তথ্য ছড়ানোর দায় থেকে রেহাই পায়নি গণমাধ্যমও। দেশের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে গত তিন মাসে ৪২টি ভুল তথ্য, ছবি ও ভিডিও ছড়ানোর ঘটনা চিহ্নিত হয়েছে। এ ছাড়া ভারতের ২৩টি গণমাধ্যমও বাংলাদেশকে ঘিরে অন্তত ৩৮টি অপতথ্য ছড়িয়েছে। এর মধ্যে ‘আজতক বাংলা’ একাই ছড়িয়েছে ৮টি বিভ্রান্তিকর খবর।
প্রথম প্রান্তিকে গণমাধ্যমের নাম, লোগো এবং শিরোনাম নকল করে ভুয়া ফটোকার্ড ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে ১১৮টি ঘটনার মধ্যে। এতে দেশি ও বিদেশি মিলিয়ে ৩৯টি সংবাদমাধ্যমের নাম জড়িয়ে ১৩৫টি ভুল তথ্য ছড়ানো হয়েছে। রিউমর স্ক্যানারের এই প্রতিবেদন বাংলাদেশে তথ্যযুদ্ধের বাস্তব চিত্র স্পষ্ট করে তুলে ধরছে। এখন সময় — তথ্য যাচাই করে কথা বলার, বিভ্রান্তি এড়িয়ে সচেতনতার পথে এগিয়ে চলার।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য বিভিন্ন ধরনের মিথ্যা ও অতিরঞ্জিত তথ্য অনেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ার করছেন। বিষয়গুলো আমরা নজর রাখছি এবং যারা এর সঙ্গে জড়িত তাদের আইনের আওতায় আনকে কাজ করছি। যারা গুজব ছড়িয়ে অস্থিরতা সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে দেশে ফিরলে তাদেরও আইনের আওতায় আনা হবে।