বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত জুলাইর ৪ যোদ্ধার অবস্থার উন্নতি

- আপডেট সময় : ০১:১২:৩৯ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৭ মে ২০২৫ ১২৪ বার পড়া হয়েছে
রাজধানীর কলেজ গেট এলাকার সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন জুলাইয়ের ৪ যোদ্ধার অবস্থার উন্নতি হচ্ছে। তাদের জ্ঞান ফিরেছে। তারা কথা বলছে পারছেন। পরিক্ষা নিরীক্ষার পর তাদেরকে ষ্টোমার্ক ওয়াস করা হয়েছে। গুরুত্ব সহকারে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। তারা কথা বলছে পারছেন। সহপাঠীদের সঙ্গে কথা বলছেন। ইনজেকশন ও স্যালাইনের পাশাপাশি অন্যান্য ওষুধ দেয়া হয়েছে।
নয় মাস হাসপাতালে খেকে চিকিৎসায় অনিহা, দীর্ঘদিনের অবহেলা, হতাশা ও একাকিত্বে সমাজ ও পরিবারের বোঝার চাপে পড়ে এই যোদ্ধারা বিষপানের মতো কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তারা ক্ষোভের সঙ্গে বলেছেন, এই পৃথিবীতে সমাজ ও পরিবারের বোঝা হয়ে বেঁচে থাকতে চান না। দীঘ নয় মাস চললো, এ দীর্ঘ সময় হাসপাতালের বিছানায় অবহেলিত ভাবে পড়ে আছেন তারা। চিকিৎসায় অনিহা ও অনিশ্চয়তা, পরিবারের তুচ্ছ তাচ্ছিল্যতার কারনে ডিপ্রেশনে পড়েই এমন আত্মঘাতী কাজটি করেছেন। এমনটাই বলেছেন তাদের সমপাঠীরা।
জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনষ্টিটিউট ও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন জুলাই অভুত্থানে আহত ৪ যোদ্ধা গতকাল মদ্যরাতে হাসপাতালের পরিচালকের কক্ষেই বিষপানে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন।
এবিষয়ে জুলাই ফাউন্ডেশন কর্মকর্তারা বলেন, কঠিন মনস্তাত্ত্বিক ধাক্কা থেকেই আহতদের বিষপানের মাধ্যমে মরে যেতে চেয়েছিলেন। নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চরম অনিশ্চয়তা, সামাজিক অবহেলা ও নিরাপত্তাহীনতার জেরে বিষপান করে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন চারজন জুলাই যোদ্ধা। বিষয়টিকে ‘কঠিন মনস্তাত্ত্বিক ধাক্কা’ হিসেবেই দেখছে জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন। ফাউন্ডেশন বলছে, দীর্ঘদিনের অবহেলা, হতাশা ও একাকিত্বের চাপে পড়ে এই যোদ্ধারা এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ঘটনার খবরে গতকাল রোববার গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে জুলাই ফাউন্ডেশন এসব তথ্য জানায়। বিবৃতিতে ফাউন্ডেশনটির সিইও লে. কর্নেল (অব.) কামাল আকবার জানান, আত্মহত্যার চেষ্টা করা যোদ্ধাদের মধ্যে একজন কিছুদিন আগেই বিদেশে চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরেছেন। যোদ্ধাদের এমন সিদ্ধান্ত শুধু তাদের ব্যক্তিগত দুর্বলতা নয় বরং এটি একটি সামাজিক ব্যর্থতার বহিঃপ্রকাশ।
এর আগে ওই দিনই জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান এবং জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে একটি বিশেষ মতবিনিময় সভায় বসে জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন। সভায় যোদ্ধাদের স্বাস্থ্যসেবা, পুনর্বাসন ও সামাজিক মর্যাদা নিয়ে বিভিন্ন গঠনমূলক প্রস্তাব গৃহীত হয়। কিন্তু এর মধ্যেই সংবাদ আসে জুলাই যোদ্ধাদের মধ্যে চারজন বিষপান করেছেন।
ফাউন্ডেশন জানিয়েছে, তাৎক্ষণিকভাবে হাসপাতালের সহায়তায় আক্রান্তদের সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এমনকি ফাউন্ডেশনের সিইও নিজে ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে আহতদের সেবার তত্ত্বাবধান করেন এবং অন্যান্য যোদ্ধাদের আশ্বস্ত করেন।
লে. কর্নেল (অব.) কামাল আকবার বলেন, জুলাই যোদ্ধারা আমাদের অহংকার। তারা যেন নিজেদের একাকী না ভাবেন, সেটি নিশ্চিত করাই এখন আমাদের প্রধান দায়িত্ব।
তিনি আরও জানান, এ ঘটনা আমাদের হৃদয়কে নাড়িয়ে দিয়েছে। এটা কেবল দুর্ঘটনা নয়, বরং আমাদের দায়বদ্ধতা কতটুকু পূরণ হয়েছে—সে প্রশ্নও সামনে এনেছে। তাই এখন প্রয়োজন আরও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি, যত্ন এবং কার্যকর পদক্ষেপ।
শুধু তাই নয়, জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন জানিয়েছে, যোদ্ধাদের জন্য মনোসামাজিক সহায়তা চালু করার পাশাপাশি একটি দীর্ঘমেয়াদি সহায়তা কর্মসূচি হাতে নেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যাতে ভবিষ্যতে এমন আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত আর কেউ নিতে বাধ্য না হন। সংস্থাটি বলছে, ‘এই সাহসী যোদ্ধাদের জীবনের প্রতি ভালোবাসা ফিরিয়ে দিতে রাষ্ট্র ও সমাজের একযোগে দায়িত্ব পালন করতে হবে। যেন তারা কখনোই আর নিঃসঙ্গতায় না হারিয়ে যান।
হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. খায়ের আহমেদ চৌধুরী জানান, একটি মিটিং চলাকালে তার কক্ষে ৪ জুলাই যোদ্ধা বিষপান করেন। বিষপানকারীরা হলেন- শিমুল, মারুফ, সাগর ও আখতার হোসেন (আবু তাহের)। অবস্থা বেগতিক দেখে তাদের তাৎক্ষণিকভাবে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়।
হাসপাতালে একাধিক দর্শনার্থী ও চিকিৎসাধীন রোগী বলেছেন, আগারগাঁও জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ভর্তি থাকা জুলাই গণঅভ্যুত্থানে চোখ হারানো চার তরুণ বিষপান করেছেন। পকেটে করে তারা আগেই বিষ নিয়ে যান। একটি মিটিং চলাকালে হাসপাতাল পরিচালকের কক্ষে গিয়ে সেই বিষ পান করেন। গতকাল রোববার দুপুরে এ ঘটনা ঘটে। ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. খায়ের আহমেদ চৌধুরী।
হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, জুলাই ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার (সিইও) সঙ্গে চলমান বৈঠকের সময় ওই চারজন দাবি নিয়ে তার কক্ষে যান। সিইও তাদের অপেক্ষা করতে বললে ক্ষুব্ধ হয়ে সেখানেই বিষপান করেন তারা।
জুলাই গণ-আন্দোলনে চোখ হারানো আহতরা অভিযোগ করেছেন, দীর্ঘ ৯ মাসেও তাদের উন্নত চিকিৎসা বা পুনর্বাসনের বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। বরং প্রতিশ্রুতি দিয়ে নানা বাহানা করা হয়েছে। আহতদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের দায়িত্ব নেওয়ার কথা বললেও তা বাস্তবে ঘটেনি।
হিল্লোল নামে আহত একজন বলেন, এই সরকারের কাছ থেকে কিছু পেতে হলে আন্দোলনে নামতেই হয়। শান্তিপূর্ণভাবে কিছু চাওয়া যায় না। আমাদের চিকিৎসার জন্য কেউ এগিয়ে আসেনি।
হাসপাতালটির অধ্যাপক ডা. খায়ের আহমেদ চৌধুরী বলেন, জুলাই আন্দোলনে আহত হয়ে ভর্তি থাকা ৪ জন আজ বিষপান করেছেন। তারা আগেই পকেটে করে বিষ নিয়ে আসে। কিন্তু আমার রুমে এসে মিটিং চলাকালীন তাদের এই কর্মকা-ে খুবই অবাক হয়েছি। ঠিক কি কারণে তারা এমন করেছে আমরা কিছুই জানি না।
তিনি আরও বলেন, তাদের তাৎক্ষণিকভাবে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে এবং বর্তমানে তারা সম্পূর্ণ সুস্থ আছেন।
বিষপানের এ ঘটনায় জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক ডা. খায়ের আহমেদ চৌধুরী বলেন, আমরা সাধারণ রোগীদের বেড ফাঁকা করে দীর্ঘ ৯ মাস ধরে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে তাদের চিকিৎসা দিয়ে আসছি। কিন্তু তাদের এ ধরনের আচরণ আমাদের খুবই মর্মাহত করে। আমাদের পক্ষ থেকে যতটা সেবা দেওয়ার, আমরা তা দিয়েছি। তারা এখন চাইলে নিজ নিজ বাসায় গিয়েই বাকি চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের কাজটি সম্পন্ন করতে পারেন। তারপরও তারা হাসপাতালে আছেন, আমরাও আন্তরিকতার সাথে সেবা দিয়ে যাচ্ছি।