মানব পাচারে সক্রিয় নোয়াখালীর মামা-ভাগিনা

- আপডেট সময় : ১২:২৪:৩৮ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৩ ফেব্রুয়ারী ২০২৫ ২৯২ বার পড়া হয়েছে
দেশের প্রবাসী অধ্যুষিত জেলা গুলোর মধ্যে অন্যতম নোয়াখালী। চলতি ২০২৪–২৫ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে প্রবাসী আয়ে শীর্ষ ৫ জেলার তালিকায় রয়েছে এই জেলার নাম। এই অঞ্চলের মানুষের মাঝে বিদেশে যাওয়ার প্রবণতা বেশি। বৈধ-অবৈধ নানা পথে তারা পাড়ি দিচ্ছেন ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। উন্নত জীবনের আশায় বিদেশমুখী প্রবণতা কারনে দালাল চক্রের পাতা ফাঁদে পড়ে অনেকেই হারাচ্ছেন সর্বস্ব। কারো কারো সলিল সমাধি হচ্ছে প্রবাসের মাটিতেই। তবে দালালেরা থেকে যাচ্ছে ধরা ছোয়ার বাইরে। সম্প্রতি মুক্তিপণ দিতে ব্যর্থ হওয়ায় লিবিয়া থেকে লাশ হয়ে ফিরেছেন নোয়াখালীর ফয়েজ আহম্মেদ। ২২ বছর বয়সী যুবক সেনবাগ উপজেলার ছাতারপাইয়া ইউনিয়নের বসন্তপুর গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন। ২০২১ সালে তেমুহনী আব্দুল রশিদ ভূইয়া উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাশ করে উন্নত জীবনের আশায় বিদেশে পাড়ি দেওয়ার স্বপ্ন দেখেন। তবে সেই স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়। গত ২৮ জানুয়ারী লিবিয়া থেকে তার লাশ দেশে পৌছায়। অভিযোগ রয়েছে মানবপাচারকারী চক্রের সদস্য মোমেনুল হক মুন্না ও ইসমাইল হোসেনের দাবিকৃত টাকা দিতে ব্যর্থ হওয়ায় খুন করা হয়েছে ফয়েজকে। পরে নিহতের পরিবারকে নানা শর্ত মানতে বাধ্য করে লাশ দেশে পাঠানো হয়। তবে এই ঘটনায় এখনো কোন মামলা হয়নি।
জানা যায়, লিবিয়ায় খুন হওয়া যুবক সেনবাগ উপজেলার বসন্তপুর গ্রামের প্রবাসী মইন উদ্দিনের ছেলে ছিলেন। অপরদিকে অভিযুক্ত মানবপাচারকারী চক্রের সদস্য মোমেনুল হক মুন্না ও ইসমাইল হোসেন সম্পর্কে মামা-ভাগিনা। মোমেনুল হক মুন্নার ছাতারপাইয়া ইউনিয়নের বসন্তপুর গ্রামের মৃত আবুল বাসারের ছেলে। ইসমাইল হোসেন পাশ্ববর্তী কাবিলপুর দক্ষিণপাড়া আলাউদ্দিন মাওলানা বাড়ির বাসিন্দা। মানবপাচার সিন্ডিকেট গড়ে নোয়াখালী-ফেনীসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ইটালিতে চাকরি দেওয়ার নামে লিবিয়ার বেনগাজি শহরে আটকে মুক্তিপণ আদাইয়ের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে চক্রটি।
অনুসন্ধানে জানাযায়, দীর্ঘ বছর ধরে ইসমাইল হোসেন প্রবাসে রয়েছেন। দীর্ঘ প্রবাস জীবন গ্রীসে কাটিয়ে ২৫ বছর থেকে তিনি লিবিয়া-ইটালি-গ্রিস রুটের মানবপাচারের সাথে যুক্ত রয়েছেন। লিবিয়ার প্রবাসী বাঙ্গালীদের কাছে তিনি এই রুটের মাফিয়া হিসেবে পরিচিত। গেইমের নামে লিবিয়ান পুলিশের কাছে ধরিয়ে পরে মুক্ত করার অযুহাতে অর্থ আদাই ও দেশ থেকে নানা প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিদেশে আটকে মুক্তিপণ আদায় করেন এই মাফিয়া। আর তার সহযোগী হিসেবে গত ৮ বছর থেকে কাজ করেন ভাগিনা মোমেনুল হক মুন্না। ইসমাইল হোসেনের এক ছেলে আরাফাত হোসেন শিবলু আমেরিকান প্রবাসী। আরেক ছেলে ইশতিয়াক হোসেন সিহাব আইএলটিএস করে আমেরিকায় পাড়ি দেওয়ার চেষ্টায় আছেন। মানবপাচার চক্রের টাকায় কুমিল্লা জেলার মনোহরগঞ্জের
ভুগই শ্বশুর বাড়ির এলাকায় করেছেন আলিশান বাড়ি। দেশে তার সকল সম্পদের দেখাশোনা করেন শ্বশুর আব্দুর রহমান ভূইয়া। বিভিন্ন সময় মুক্তিপণ আদায়ের পর হত্যা ও গুমের অভিযোগ থাকলেও ভুক্তভোগীরা অবৈধ অভিবাসী হওয়ায় আইনের ধরা ছোয়ার বাইরে রয়েছেন মাফিয়া ইসমাইল।
ইসমাইলের শ্বশুর আব্দুর রহমান ভূইয়া জানান, তার জামাই দীর্ঘদিন থেকে বিদেশে লোক পাঠানোর ব্যবসা করেন। তবে তিনি এসবের সাথে যুক্ত নন। অভিবাসীদের আটকে মুক্তিপণ আদায়ের অভিযোগে বিষয়ে জানতে চাইলেই তিনি এ বিষয়ে কিছু জানেন না বলে জানান।
সোনাইমুড়ী উপজেলার মাছিমপুর গ্রামের লিবিয়া ফেরৎ অনিক তার ওপরে ঘটে যাওয়া নির্যাতনের কাহিনি বর্ননা করেন প্রতিবেদকের কাছে। গত ৫ মাস পূর্বে তাকে ইতালি পাঠানের কথা বলে লিবিয়া নিয়ে সেখানে সাগরপাড়ে একটি কক্ষে গেইম দেওয়ার কথা বলে দীর্ঘ আড়াই মাস আটকে রেখে নির্যাতন চালায়। তিনবেলা খাবার দিতো না। শুকনো রুটি খেয়ে কোনরকমে বেঁচে ছিলেন। পরে সেখান থেকে পালিয়ে অন্যের সহযোগীতায় বাংলাদেশে ফেরেন। ওই রুমে নোয়াখালী, চাঁদপুর, কুমিল্লা, শরিয়তপুর ও ঢাকা জেলার প্রায় দুইশতাধিক আটক ছিলো। তাদেরকে জিম্মি করে মারধোর করতো প্রতিরাতে। এসকল দালাল চক্রের সাথে লিবিয়ার পুলিশ ও বাংলাদেশী দূতাবাসের প্রতিনিধিরা যুক্ত রয়েছেন। কোন বাংলাদেশীকে লিবিয়ার পুলিশ আটক করলে দূতাবাস থেকে সহায়তা করতে ঘুষ দাবি করা হয়।
মাফিয়া ইসমাইলের বিষয়ে গত বছরের ২৬ সেপ্টেম্বর ফেসবুকে পোষ্ট দিয়েছেন তার আপন ভাতিজা আলমগীর পাপ্পু। তিনিও ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ইসমাইলের মাধ্যমে লিবিয়াতে জান। তাকে ইটালি পাঠানোর কথা বলে ২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে গেইম দেওয়া হয়। গেইমের নামে ৩ লাখ টাকা নেওয়া হয় ও গেইম ঘরে ১ মাস আটকে রাখা হয়। গেইম দিয়ে ৪ দিন সাগরে থাকার পর লিবিয়ার কোষ্টগার্ডের হাতে গ্রেফতার হয়। জেলখানায় ৪দিন থাকার পর তাকে মাফিয়াদের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়। সেখান থেকে ৩ লাখ টাকা মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়া পেয়েছেন। ইতালি কথা বলে তাকে নৌ যোগে গ্রিসে পাঠিয়ে সকল যোগাযোগ বন্ধ করেছেন ইসমাইল। বর্তমানে অনিশ্চয়তার মধ্যে জীবনপার করছেন আলমগীর পাপ্পু।
এই ঘটনা ফেসবুকে দেওয়ায় হুমকির শিকার হয়েছেন পাপ্পুর পরিবার। এ বিষয়ে পাপ্পুর ভাই আহাদ জানান, ইসমাইল হোসেন তার আপনা চাচা। তিনি অনেকদিন থেকে আদম ব্যবসার সাথে জড়িত রয়েছেন। বিভিন্ন সময় তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আসে। তার ভাই পাপ্পু লিবিয়ায় অনেক কষ্টে দিন পার করেছেন। চাচা হিসেবেও ছাড় দেননি ইসমাইল হোসেন। আর এই ঘটনা ফেসবুকে পোষ্ট দেওয়ায় সে বাড়িতে এসে গ্রাম থেকে উচ্ছেদের হুমকিও দেওয়া হয়েছে।
মানবপাচার চক্রের মাফিয়া ইসমাইল হোসেনের সাথে মুঠোফোনে কথা হয় প্রতিবেদকের। তিনি বলেন, যাদেরকে আপনারা ভুক্তভোগী বলছেন তারা নিজেরাই আমাদের কাছে আসে। আমরা তাদেরকে লিবিয়াতে ডেকে আনি নাই। যারা অবৈধ ভাবে আসেন তারাও জানেন এই পথে ঝুঁকি আছে। জিম্মিকরে টাকা আদায় ও হত্যার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, নিহত ফয়েজ আহম্মেদ কিভাবে মারা গেছেন তা তিনি জানেন না। তবে লাশ তিনি যে দেশে পাঠিয়েছেন সেই বিষয়টি স্বীকার করেন।
এবিষয়ে স্থানীয় ওয়ার্ড মেম্বার আকমত আলী জানান, মইন উদ্দিন ও মুন্না তার ওয়ার্ডের বাসিন্দা। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি হওয়ায় এসব ঘটনা জানতে পেরে তিনি ইসমাইল ও মুন্নার সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করেছিলেন। ইসমাইল হোসেন এসকল বিষয়ে বাড়াবাড়ি না করারা জন্য ফয়েজের বাবা মইন উদ্দিনকে সাড়ে তিন লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার প্রস্তাব করেছেন। নিহতের লাশের বিষয়ে প্রশ্ন করলে মেম্বার আকমত আলী বলেন, ‘‘দেখে মনে হয়েছে ফয়েজ বেশ কয়েকদিন আগেই মারা গিয়েছিলো।” সম্ভবত তাকে অনাহারে রাখা হয়েছিলো ও টর্চার করা হয়েছিলো বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
এবিষয়ে লিবিয়ার বাংলাদেশ দূতাবাসের হাই-কমিশনার মেজর জেনারেল খায়রুল বাসারের বক্তব্য নিতে কল দেওয়া হয়। দূতাবাসের এক কর্মচারী ফোন রিসিভ করে পরে যোগাযোগ করিয়ে দেওয়া হবে বলে ফোন রেখে দেন।
নোয়াখালী জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের প্রবাসী কল্যান শাখার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোঃ ফাহিম হাসান খানের সঙ্গে এই বিষয়ে কথা বললে তিনি জানান, অবৈধ পথে বিদেশে পাড়ি দেওয়াটা মোটেও উচিত না, তবে কোন ব্যক্তি বিদেশ যাওয়ার ক্ষেত্রে যদি দালাল চক্রের ফাঁদে পড়ে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে আইনি সহযোগিতা নেওয়ার জন্য জেলা প্রশাসক এর বরাবর লিখিত আবেদন করলে আমরা অবশ্য আইনি সহযোগিতা করব, বিনামূল্যে আইনি সহযোগিতা পাবে ভুক্তভোগী পরিবার।