ঢাকা ০৯:১৬ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ০১ অগাস্ট ২০২৫
সংবাদ শিরোনাম ::
Logo ৩১ দফা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সাংবাদিকদের সাথে ডা. শাহ আলম তালুকদারের মতবিনিময় Logo ডামুড্যায় সুধীজনের সাথে জেলা প্রশাসকের মতবিনিময় সভা Logo দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত দুঃস্থ পরিবারের মাঝে নগরকান্দায় ত্রাণ সামগ্রী ঢেউটিন ও চেক বিতরণ Logo বান্দরবান সরকারি কলেজে জুলাই শহীদ দিবস উদযাপন Logo জামালপুর গোয়েন্দা শাখা ডিবি-২ পুলিশ কর্তৃক জুয়া মাদক সহ আটক-৬ Logo আলোচিত শিশু আছিয়ার পরিবারকে গাভী, বাছুর ও পাকা গোয়ালঘর উপহার জামায়াতের আমিরের Logo তানোরে বৃদ্ধার চুরি যাওয়া ১১ লক্ষ টাকা উদ্ধার পুলিশের Logo ফেনীতে এনজিওর পাওনা আদায়ে কাবুলি ওয়ালার ভুমিকায়! অগ্যতা নিরুপায়ী আত্বহননে গৃহবধূ Logo সরিষাবাড়ীতে “কবি কাজী নজরুল ইসলাম গোল্ডেন অ্যাওয়ার্ড ২০২৫” পেলেন নাজমুল ইসলাম Logo দাগনভূঞায় সড়ক সংস্কার কাজে বাধা চাঁদাবাজির অভিযোগে ঠিকাদারের জিডি

মানসিক বিপর্যস্ত জুলাই আহতদের সিংহভাগই

হালিম মোহাম্মদ
  • আপডেট সময় : ৪৬ বার পড়া হয়েছে
দৈনিক গনমুক্তি অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

গেল বছরে বৈষম্যবিরোধী কোটা আন্দোলনে আওয়ামী সরকার পতন ও ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেশ ছেড়ে পলায়নের ঘটনায় হত্যাযজ্ঞ এবং জ্বালাও পোড়াও প্রায় সহস্ত্রাধিক যোদ্ধা শহীদ হয়েছেন। এ ঘটনায় আহত হয়েছে প্রায় ৫ হাজারেরও বেশী যোদ্ধা। এদের মধ্যে বিকলাঙ্গ এবং পঙ্গুত্ব নিয়ে বেঁচে আঝেন প্রায় শতাধিক যোদ্ধা। তাদেরকে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি ও চিকিৎসা নিয়ে কর্তৃপক্ষের মধ্যে ঘটছে নানা অপ্রীতিকর ঘটনা। চিকিৎসকরা বলছেন, হাসপাতালে ভর্তি জুলাই আহতদের মানসিক সংকট বাড়ছে। তারা ক্রমান্বয়ে মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছেন। বাংলাদেশ মেডিকেল ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি ৫৪ জন আহত রোগীর ওপর গবেষণা চালিয়ে এ তথ্য দিয়েছেন ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্টদের একটি দল। এই ৫৪ জনের সার্বিক ভাবে চলার সামর্থ নেই। তারা সকলেই রয়েছে ট্রমায়। অন্তবর্তী সরকারের দীর্ঘ প্রায় ১১ মাসে তারা বিভিন্ন ভাবে হোচট খেতে খেতে মানসিক ভাবে বিপযস্ত হয়ে পড়েছেন। তাদেরকে উন্নত চিকিৎসার পাশাপাশি কাউন্সিলিং জরুরী হয়ে পড়েছে। এমনটাই মন্তব্য করেছে একাধিক মানসিক বিশেষজ্ঞ। তবে এরইমধ্যে গবেষকদের সুপারিশে সরকার পাঁচ বিভাগের ২১ জেলায়, জুলাই আহতদের জন্যে ৩০ কোটি টাকা ব্যয়ে পুনর্বাসন প্রকল্প হাতে নিয়েছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্যসচিব মো. সাইদুর রহমান। তিনি জানিয়েছেন, বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির চার ধাপে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে।
জুলাই আহত সেলিম আর হীরা সাতমাস ধরে বাংলাদেশ মেডিকেল ইউনিভার্সিটি হাসপাতালে ভর্তি আছে। কথা হচ্ছিলো পড়াশোনা আর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে। বলছিলেন কেন তারা মানসিকভাবে হতাশাগ্রস্ত।
রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে ঘুরে দেখা গেলো সবার অবস্থাই কমবেশি একই। লম্বা সময় অবস্থানের কারণে সেটি আরো প্রকট হচ্ছে। ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্টদের গত ২৯ মে থেকে ১ জুন পর্যন্ত বাংলাদেশ মেডিকেল ইউনিভার্সিটিতে গবেষণা করা হয়েছে। আহত ৫৪ জুলাইযোদ্ধা ওপর পরিচালিত গবেষণায় বলা হয়েছে, ৩৬ জন (৬৭%) পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডারে ভুগছেন। ২৬ জনের ( ৪৮%) মাঝে চরমমাত্রায় বিষন্নতার লক্ষণ। ২৪ জন ( ৪৫%) চরম উদ্বেগে আক্রান্ত। ১৪ জনের (২৬%) মাঝে চরমমানসিক চাপের লক্ষণ পাওয়া গেছে। তাছাড়া ১১ জনের (২১%) মাঝে আত্মহত্যামূলক আচরণ প্রবল দেখা গেছে।
এবিষয়ে গবেষক দলের প্রধান, বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ও মনোবিজ্ঞানি ডা. সেলিনা ফাতেমা বিনতে শহীদ বলছেন, আমাদের মূল্যায়নে দেখা গেছে, জুলাই বিপ্লবের আহত অনেক বেঁচে থাকা ব্যক্তি পিটিএসডি, বিষণ্নতা, উদ্বেগ ও মানসিক চাপে ভুগছেন। কিছু ব্যক্তি মাদকাসক্তও হয়ে পড়েছেন এবং আত্মহত্যার চিন্তা বা প্রচেষ্টার ঝুঁকিতে আছেন।
তাদের মানসিক সুস্থতা ফিরিয়ে আনতে মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা ও কাউন্সেলিং জরুরি। আহত ব্যক্তিদের পুনর্বাসন, শিক্ষাগত ও পেশাগত পুনর্গঠন এবং অর্থনৈতিক সহায়তারও প্রয়োজন আছে। অধিকাংশই নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন, কারণ তারা মনে করেন বিরোধীরা তাদের আক্রমণ করতে পারে। তাই তাদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তার ব্যবস্থাও দরকার। সহযোগী অধ্যাপক, মনোরোগ বিদ্যা বিভাগ, বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাধানে সরকারও সারাদেশের জুলাই আহতদের নিয়ে একটি পুনর্বাসন এবং আরোগ্য প্রকল্প দাঁড় করিয়েছে। আহতদের শারীরিক, মানসিক ও অর্থনৈতিক পুনর্বাসনের লক্ষ্যে নতুন প্রকল্প নেওয়া হয়েছে।
অপরদিকে চিকিৎসা ও পুনরুদ্ধারের পথ. সহিংসতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে একটি টিকে থাকা-ভিত্তিক পদ্ধতি’ -শীর্ষক প্রকল্পটি যৌথভাবে বাস্তবায়ন করছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, আন্তর্জাতিক রেড ক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট ফেডারেশন এবং বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি। এতে ৩০ কোটি টাকা অর্থায়ন করবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। সরকারের তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি এটি চার ধাপে বাস্তবায়ন করবে জানালেন রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) অধ্যাপক ডা. মো. আজিজুল ইসলাম।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিব মো. সাইদুর রহমান বলেন, জুলাই আহতদের চিকিৎসা, পুনর্বাসন অগ্রাধিকারে রেখেছে সরকারের। আহতদের বিদেশে চিকিৎসার পাশাপাশি যাদের অঙ্গহানি হয়েছে ব্র্যাকের সহায়তায় সেটি সংযোজনের কাজও চলছে। তাদের মানসিক অবস্থার উন্নতির জন্য নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তিনি আরো বলেন, সরকারের প্রচেষ্টায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থায়নে পাঁচটি বিভাগের ২১ জেলায় একটি প্রকল্প আমরা হাতে নিয়েছি। আশা করি, ধীরে ধীরে সব সংকটই কেটে যাবে। এ প্রকল্পটি ২০২৬ সালের নভেম্বর পর্যন্ত চলবে। প্রকল্পটির মাধ্যমে প্রত্যক্ষভাবে ৮৮২ জন ক্ষতিগ্রস্ত এবং পরোক্ষভাবে প্রায় আট হাজার ব্যক্তি উপকৃত হবেন। এর মূল লক্ষ্য হচ্ছে সহিংসতায় ক্ষতিগ্রস্তদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধার, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা এবং সামাজিক সংহতি গড়ে তোলা। প্রকল্পের কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে মেডিকেল সেবা, পুনর্বাসন ও সহায়ক যন্ত্রপাতি সরবরাহ, মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা ও কাউন্সেলিং, আয় সৃষ্টিমূলক কর্মসূচি এবং সচেতনতামূলক প্রচার ও কমিউনিটি এনগেজমেন্ট। অপরদিকে একাধিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন জুলাইয়ে আহত ও বিকলাঙ্গদের চোখের সামনে সহযোদ্ধানরা শহীদ হয়েছেন। তাদের মৃত্যু দৃশ্য চোখে ভেসে উঠে। আর তখনই তাদের মানসিক ব্যথা বেড়ে যায়। তখনই তাদেও সামাল দেয়া কঠিন হয়ে পড়ে। এমন মন্তব্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের।
অপরদিকে সম্প্রতি জুলাই শহীদ পরিবার নিয়ে অনুষ্ঠানে স্বজনরা বলেন, বছর পেরুলেও এখনও থামেনি জুলাই গণঅভ্যুত্থানে স্বজন হারানোর কান্না। তরুণ তাজা প্রাণের মুহূর্তেই নিথর হয়ে যাওয়ার সেই বীভৎস ছবি দুঃস্বপ্ন হয়ে তাড়া করছে শহীদ পরিবারগুলোকে। তাদের একটাই চাওয়া খুনিদের দ্রুত বিচার, বৈষম্যহীন আর দুর্নীতি মুক্ত ন্যায় ভিত্তিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা। দুই বোনের কাঁধে ভাইয়ের মরদেহ। যে দৃশ্য কাঁদিয়েছে পুরো দেশকে। শহীদ রাব্বী শরীয়তপুর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ছাত্র। গণঅভ্যুত্থানের শুরু থেকে শরীয়তপুরে আন্দোলনের মাঠে ছিলেন অকুতভয়। পরে চলে আসেন ঢাকায়। এখানে এসেও সম্মুখ সারিতে সোচ্চার ছিলেন সরকার পতনের আন্দোলনে। শহীদ রাব্বীর বোন মিম আক্তার বলেন, প্রতিদিনই ও আন্দোলনে যেত, আবার চলেও আসত। রাত ১০ টার মধ্যে চলে আসত। আসার পর আন্দোলনে কোথায় কি হয়েছে আমাকে দেখাত।
৪ আগস্ট বাসা থেকে কাউকে কিছু না বলে বের হয়ে যান আন্দোলনে। সেই রাতে আর বাসায় ফেরা হয়নি। পরের দিন সকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে দেখেন আদরের ১৭ বছর বয়সী ছোট ভাইয়ের নিথর দেহ। অথচ এখনও আটক হয়নি খুনিরা।
মিম আক্তার বলেন, আমার ভাইযে ওইখানে পড়া, দেখে কেমন যেন নিস্তব্ধ পাথড় হয়ে গেলাম। ওকে কখনও একটা থাপ্পড় দেওয়ার প্রয়োজন হয়নি, এতো ডিসিপ্লিন বাচ্চা ছিল। ১৭ বছরের নাফিজের বুলেটবিদ্ধ দেহ থেকে রক্ত ঝরছে অঝরে। রিকশার রডটি হয়ত ধরেছিলেন শেষ নিঃশ্বাসের আগ মুহূর্তে। ছবিটি দেখে সেদিন কেঁদেছিল পাষাণ হৃদয়ও। বাংলাদেশ নৌবাহিনী কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র নাফিজ ফার্মগেটে গুলিবিদ্ধ হন। এক রিকশাওয়ালা তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসায় বাঁধা দেয় আওয়ামী সন্ত্রাসীরা। গত ৪ আগস্ট রাতে পত্রিকার পাতায় রিক্সায় ছেলের নিথর দেহের ছবি দেখে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের মর্গে ছুটে যান বাবা।
শহীদ নাফিজের বাবা গোলাম রহমান বলেন, গিয়ে দেখি আমার ছেলের মাথায় জাতীয় পতাকা বাঁধা। তখন আমি ফ্রিজিং গাড়িতে তোলার পর, আমি যেন ছেলের দাফন করতে পারি, এই ধর্য্য ধারণ করতে পারি। শরীফ আরাফাত উত্তরা জামিয়া রওজাতুল উলুম মাদ্রাসা পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী। স্বৈরাচার পতনের ৫ আগস্ট রাজধানীর উত্তরা–পূর্ব থানার সামনে গুলিবিদ্ধ হন। এরপর সাড়ে ৪ মাস চিকিৎসা। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। শহীদ হন ২৩ ডিসেম্বর। শহীদ আরাফাতের ভাই হাসান আলী বলেন, আমি আহ্বান জানাব এদের রক্তের মূল্যায়ন করে তারা যেন আসামিদের বিচারের আওতায় আনে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদ হয়েছেন সহস্ত্রাধিক। শিশু থেকে শুরু করে সকল বয়সীরা এই তালিকায়। জাতিসংঘের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার সরাসরি নির্দেশেই গুলি করে গণহত্যা চালানো হয়। স্বজনহারা আহাজারি কবে শেষ হবে তা আমাদের জানা নেই।

নিউজটি শেয়ার করুন

ট্যাগস :

মানসিক বিপর্যস্ত জুলাই আহতদের সিংহভাগই

আপডেট সময় :

গেল বছরে বৈষম্যবিরোধী কোটা আন্দোলনে আওয়ামী সরকার পতন ও ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেশ ছেড়ে পলায়নের ঘটনায় হত্যাযজ্ঞ এবং জ্বালাও পোড়াও প্রায় সহস্ত্রাধিক যোদ্ধা শহীদ হয়েছেন। এ ঘটনায় আহত হয়েছে প্রায় ৫ হাজারেরও বেশী যোদ্ধা। এদের মধ্যে বিকলাঙ্গ এবং পঙ্গুত্ব নিয়ে বেঁচে আঝেন প্রায় শতাধিক যোদ্ধা। তাদেরকে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি ও চিকিৎসা নিয়ে কর্তৃপক্ষের মধ্যে ঘটছে নানা অপ্রীতিকর ঘটনা। চিকিৎসকরা বলছেন, হাসপাতালে ভর্তি জুলাই আহতদের মানসিক সংকট বাড়ছে। তারা ক্রমান্বয়ে মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছেন। বাংলাদেশ মেডিকেল ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি ৫৪ জন আহত রোগীর ওপর গবেষণা চালিয়ে এ তথ্য দিয়েছেন ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্টদের একটি দল। এই ৫৪ জনের সার্বিক ভাবে চলার সামর্থ নেই। তারা সকলেই রয়েছে ট্রমায়। অন্তবর্তী সরকারের দীর্ঘ প্রায় ১১ মাসে তারা বিভিন্ন ভাবে হোচট খেতে খেতে মানসিক ভাবে বিপযস্ত হয়ে পড়েছেন। তাদেরকে উন্নত চিকিৎসার পাশাপাশি কাউন্সিলিং জরুরী হয়ে পড়েছে। এমনটাই মন্তব্য করেছে একাধিক মানসিক বিশেষজ্ঞ। তবে এরইমধ্যে গবেষকদের সুপারিশে সরকার পাঁচ বিভাগের ২১ জেলায়, জুলাই আহতদের জন্যে ৩০ কোটি টাকা ব্যয়ে পুনর্বাসন প্রকল্প হাতে নিয়েছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্যসচিব মো. সাইদুর রহমান। তিনি জানিয়েছেন, বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির চার ধাপে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে।
জুলাই আহত সেলিম আর হীরা সাতমাস ধরে বাংলাদেশ মেডিকেল ইউনিভার্সিটি হাসপাতালে ভর্তি আছে। কথা হচ্ছিলো পড়াশোনা আর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে। বলছিলেন কেন তারা মানসিকভাবে হতাশাগ্রস্ত।
রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে ঘুরে দেখা গেলো সবার অবস্থাই কমবেশি একই। লম্বা সময় অবস্থানের কারণে সেটি আরো প্রকট হচ্ছে। ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্টদের গত ২৯ মে থেকে ১ জুন পর্যন্ত বাংলাদেশ মেডিকেল ইউনিভার্সিটিতে গবেষণা করা হয়েছে। আহত ৫৪ জুলাইযোদ্ধা ওপর পরিচালিত গবেষণায় বলা হয়েছে, ৩৬ জন (৬৭%) পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডারে ভুগছেন। ২৬ জনের ( ৪৮%) মাঝে চরমমাত্রায় বিষন্নতার লক্ষণ। ২৪ জন ( ৪৫%) চরম উদ্বেগে আক্রান্ত। ১৪ জনের (২৬%) মাঝে চরমমানসিক চাপের লক্ষণ পাওয়া গেছে। তাছাড়া ১১ জনের (২১%) মাঝে আত্মহত্যামূলক আচরণ প্রবল দেখা গেছে।
এবিষয়ে গবেষক দলের প্রধান, বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ও মনোবিজ্ঞানি ডা. সেলিনা ফাতেমা বিনতে শহীদ বলছেন, আমাদের মূল্যায়নে দেখা গেছে, জুলাই বিপ্লবের আহত অনেক বেঁচে থাকা ব্যক্তি পিটিএসডি, বিষণ্নতা, উদ্বেগ ও মানসিক চাপে ভুগছেন। কিছু ব্যক্তি মাদকাসক্তও হয়ে পড়েছেন এবং আত্মহত্যার চিন্তা বা প্রচেষ্টার ঝুঁকিতে আছেন।
তাদের মানসিক সুস্থতা ফিরিয়ে আনতে মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা ও কাউন্সেলিং জরুরি। আহত ব্যক্তিদের পুনর্বাসন, শিক্ষাগত ও পেশাগত পুনর্গঠন এবং অর্থনৈতিক সহায়তারও প্রয়োজন আছে। অধিকাংশই নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন, কারণ তারা মনে করেন বিরোধীরা তাদের আক্রমণ করতে পারে। তাই তাদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তার ব্যবস্থাও দরকার। সহযোগী অধ্যাপক, মনোরোগ বিদ্যা বিভাগ, বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাধানে সরকারও সারাদেশের জুলাই আহতদের নিয়ে একটি পুনর্বাসন এবং আরোগ্য প্রকল্প দাঁড় করিয়েছে। আহতদের শারীরিক, মানসিক ও অর্থনৈতিক পুনর্বাসনের লক্ষ্যে নতুন প্রকল্প নেওয়া হয়েছে।
অপরদিকে চিকিৎসা ও পুনরুদ্ধারের পথ. সহিংসতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে একটি টিকে থাকা-ভিত্তিক পদ্ধতি’ -শীর্ষক প্রকল্পটি যৌথভাবে বাস্তবায়ন করছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, আন্তর্জাতিক রেড ক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট ফেডারেশন এবং বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি। এতে ৩০ কোটি টাকা অর্থায়ন করবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। সরকারের তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি এটি চার ধাপে বাস্তবায়ন করবে জানালেন রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) অধ্যাপক ডা. মো. আজিজুল ইসলাম।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিব মো. সাইদুর রহমান বলেন, জুলাই আহতদের চিকিৎসা, পুনর্বাসন অগ্রাধিকারে রেখেছে সরকারের। আহতদের বিদেশে চিকিৎসার পাশাপাশি যাদের অঙ্গহানি হয়েছে ব্র্যাকের সহায়তায় সেটি সংযোজনের কাজও চলছে। তাদের মানসিক অবস্থার উন্নতির জন্য নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তিনি আরো বলেন, সরকারের প্রচেষ্টায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থায়নে পাঁচটি বিভাগের ২১ জেলায় একটি প্রকল্প আমরা হাতে নিয়েছি। আশা করি, ধীরে ধীরে সব সংকটই কেটে যাবে। এ প্রকল্পটি ২০২৬ সালের নভেম্বর পর্যন্ত চলবে। প্রকল্পটির মাধ্যমে প্রত্যক্ষভাবে ৮৮২ জন ক্ষতিগ্রস্ত এবং পরোক্ষভাবে প্রায় আট হাজার ব্যক্তি উপকৃত হবেন। এর মূল লক্ষ্য হচ্ছে সহিংসতায় ক্ষতিগ্রস্তদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধার, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা এবং সামাজিক সংহতি গড়ে তোলা। প্রকল্পের কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে মেডিকেল সেবা, পুনর্বাসন ও সহায়ক যন্ত্রপাতি সরবরাহ, মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা ও কাউন্সেলিং, আয় সৃষ্টিমূলক কর্মসূচি এবং সচেতনতামূলক প্রচার ও কমিউনিটি এনগেজমেন্ট। অপরদিকে একাধিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন জুলাইয়ে আহত ও বিকলাঙ্গদের চোখের সামনে সহযোদ্ধানরা শহীদ হয়েছেন। তাদের মৃত্যু দৃশ্য চোখে ভেসে উঠে। আর তখনই তাদের মানসিক ব্যথা বেড়ে যায়। তখনই তাদেও সামাল দেয়া কঠিন হয়ে পড়ে। এমন মন্তব্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের।
অপরদিকে সম্প্রতি জুলাই শহীদ পরিবার নিয়ে অনুষ্ঠানে স্বজনরা বলেন, বছর পেরুলেও এখনও থামেনি জুলাই গণঅভ্যুত্থানে স্বজন হারানোর কান্না। তরুণ তাজা প্রাণের মুহূর্তেই নিথর হয়ে যাওয়ার সেই বীভৎস ছবি দুঃস্বপ্ন হয়ে তাড়া করছে শহীদ পরিবারগুলোকে। তাদের একটাই চাওয়া খুনিদের দ্রুত বিচার, বৈষম্যহীন আর দুর্নীতি মুক্ত ন্যায় ভিত্তিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা। দুই বোনের কাঁধে ভাইয়ের মরদেহ। যে দৃশ্য কাঁদিয়েছে পুরো দেশকে। শহীদ রাব্বী শরীয়তপুর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ছাত্র। গণঅভ্যুত্থানের শুরু থেকে শরীয়তপুরে আন্দোলনের মাঠে ছিলেন অকুতভয়। পরে চলে আসেন ঢাকায়। এখানে এসেও সম্মুখ সারিতে সোচ্চার ছিলেন সরকার পতনের আন্দোলনে। শহীদ রাব্বীর বোন মিম আক্তার বলেন, প্রতিদিনই ও আন্দোলনে যেত, আবার চলেও আসত। রাত ১০ টার মধ্যে চলে আসত। আসার পর আন্দোলনে কোথায় কি হয়েছে আমাকে দেখাত।
৪ আগস্ট বাসা থেকে কাউকে কিছু না বলে বের হয়ে যান আন্দোলনে। সেই রাতে আর বাসায় ফেরা হয়নি। পরের দিন সকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে দেখেন আদরের ১৭ বছর বয়সী ছোট ভাইয়ের নিথর দেহ। অথচ এখনও আটক হয়নি খুনিরা।
মিম আক্তার বলেন, আমার ভাইযে ওইখানে পড়া, দেখে কেমন যেন নিস্তব্ধ পাথড় হয়ে গেলাম। ওকে কখনও একটা থাপ্পড় দেওয়ার প্রয়োজন হয়নি, এতো ডিসিপ্লিন বাচ্চা ছিল। ১৭ বছরের নাফিজের বুলেটবিদ্ধ দেহ থেকে রক্ত ঝরছে অঝরে। রিকশার রডটি হয়ত ধরেছিলেন শেষ নিঃশ্বাসের আগ মুহূর্তে। ছবিটি দেখে সেদিন কেঁদেছিল পাষাণ হৃদয়ও। বাংলাদেশ নৌবাহিনী কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র নাফিজ ফার্মগেটে গুলিবিদ্ধ হন। এক রিকশাওয়ালা তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসায় বাঁধা দেয় আওয়ামী সন্ত্রাসীরা। গত ৪ আগস্ট রাতে পত্রিকার পাতায় রিক্সায় ছেলের নিথর দেহের ছবি দেখে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের মর্গে ছুটে যান বাবা।
শহীদ নাফিজের বাবা গোলাম রহমান বলেন, গিয়ে দেখি আমার ছেলের মাথায় জাতীয় পতাকা বাঁধা। তখন আমি ফ্রিজিং গাড়িতে তোলার পর, আমি যেন ছেলের দাফন করতে পারি, এই ধর্য্য ধারণ করতে পারি। শরীফ আরাফাত উত্তরা জামিয়া রওজাতুল উলুম মাদ্রাসা পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী। স্বৈরাচার পতনের ৫ আগস্ট রাজধানীর উত্তরা–পূর্ব থানার সামনে গুলিবিদ্ধ হন। এরপর সাড়ে ৪ মাস চিকিৎসা। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। শহীদ হন ২৩ ডিসেম্বর। শহীদ আরাফাতের ভাই হাসান আলী বলেন, আমি আহ্বান জানাব এদের রক্তের মূল্যায়ন করে তারা যেন আসামিদের বিচারের আওতায় আনে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদ হয়েছেন সহস্ত্রাধিক। শিশু থেকে শুরু করে সকল বয়সীরা এই তালিকায়। জাতিসংঘের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার সরাসরি নির্দেশেই গুলি করে গণহত্যা চালানো হয়। স্বজনহারা আহাজারি কবে শেষ হবে তা আমাদের জানা নেই।