মুক্তাগাছায় ঢাক-ঢোলের ধ্বনি ঐতিহ্য রক্ষায় কারিগরদের সংগ্রাম
- আপডেট সময় : ৩০ বার পড়া হয়েছে
শারদীয় দুর্গাপূজা ঘিরে ঢাক-ঢোলের শব্দে মুখরিত হয়ে উঠেছে মণ্ডপ থেকে মণ্ডপ। ধূপের গন্ধ, আলোকসজ্জা আর আর বদ্যের তালে তালে মেতে উঠেছেন মুক্তাগাছার হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষজন। তবে এই উৎসবের পেছনে নিরলস ব্যস্ততা আর ঘামঝরা শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন ঢাক-ঢোলের কারিগররা।
দূর্গোৎসবকে সামনে রেখে জমে উঠেছে ঢাক-ঢোলের বাজার। একসময় মুক্তাগাছায় অন্তত ১০ টি পরিবারে ঢাক বানাতো। এখন গোটা উপজেলায় টিকে আছে মাত্র দুইটি প্রতিষ্ঠান। তবু যারা আছেন, তাঁরা পূর্বপুরুষের ঐতিহ্য বাঁচিয়ে রাখতে আজও কাঠ-চামড়ার গন্ধে ভরপুর কর্মশালায় ব্যস্ত সময় পার করছেন।
বাদ্যযন্ত্রের দোকান ঘুরে দেখা যায়, গত এক মাস ধরে গারিগরদের যেন নিঃশ্বাস নেওয়ারও ফুসরত নেই। কাঠ খোদাই, খোল রং করা, চামড়া লাগানো কিংবা পুরনো বাদ্যযন্ত্র মেরামতে দিন-রাত এক করে দিচ্ছেন তাঁরা। তাঁদের মতে, পূজায় ঢাক-ঢোল ছাড়া কল্পনা করাই যায় না। হিন্দুশাস্ত্রেও রয়েছে এর ব্যবহার। তাই পূজা এলেই আবার নতুন করে বাড়ে এ বাদ্যের চাহিদা।
তবে সেই চাহিদা আগের মতো নেই। আধুনিক বাদ্যযন্ত্রের ভিড়ে ঢাক-ঢোলের কদর দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে। কাঠ-চামড়ার দাম বৃদ্ধি আর ক্রমশ কমতে থাকা চাহিদা-সব মিলিয়ে এ পেশায় টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে কারিগরদের জন্য।
কালিবাড়ী পারুরীতলার কারিগর নরেশ দাস (৪৭) বলেন, ২০ বছর ধরে বাপ-দাদার পেশা আঁকড়ে আছি। কিন্তু আগের দিনের মতো এখন আর তেমন বিক্রি হয় না। পূজায় কিছুটা চাহিদা বাড়লেও সংসার চালানো মুশকিল হয়ে পড়ে। তাই পূজা শেষে বিয়ে-শাদি বা কীর্তনে ঢাক বাজিয়েই কোনোরকমে সংসারের খরচ মেটাই।
বড় আকারের প্রতিটি ঢাক বিক্রি হয় ১০-১২ হাজার টাকায়, মাঝারি ৭-৮ হাজার, আর ঢোল পাওয়া যায় ৪-৬ হাজার টাকায়। প্রতিটি খোলের দাম প্রায় সাড়ে তিন হাজার টাকা। তবু খরচ বাদ দিলে হাতে থাকে অল্পই।
শহরের অদূরে সাহেব বাজারের প্রবীণ কারিগর কৃষ্ণ দাস (৬৬) আট বছর বয়স থেকেই এই কাজের হাতে খড়ি। ৫৮ বছর ধরে ঢাক-ঢোল বানিয়ে আসছেন। তিনি জানান, দুর্গা পূজার আগে কাজের চাপ বাড়লেও বেশির ভাগই আসে পুরনো বাদ্য মেরামতের জন্য। আমাদের ছেলেরা আর এ পেশায় আসছে না। সংসার চালানোই যেখানে কঠিন, সেখানে ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখা দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কারিগরদের অভিমান, আগের মতো গ্রামে-গঞ্জে গানবাজনা, যাত্রানুষ্ঠান কিংবা সামাজিক আসর হয় না। ফলে বাদ্যের ব্যবহারও কমে গেছে। তবু দুর্গোৎসবে ঢাক-ঢোলের বিকল্প নেই। দেবীর আরতিতে ঢাকের একটানা শব্দেই যেন উৎসবের পূর্ণতা আসে। তাই বছরের এই কয়েকদিনই প্রাণ ফিরে পান ঢাকশিল্পী আর কারিগররা।
স্থানীয় লেখক, গবেষক ও প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক এম ইদ্রিস আলী বলেন, বাঙালির সুরের ভুবন এক সময় কাঁপতো ঢাক-ঢোলের মুর্ছনায়। এখন সেখানে জায়গা করে নিয়েছে গিটার কিংবা প্যাডড্রাম। দেশজ বাদ্যের কদর হারিয়ে যাচ্ছে। অথচ ঢাক-ঢোল শুধু বাদ্যযন্ত্র নয়, এটি আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। একে ধরে রাখতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা জরুরি।
ঢাকের কাঠির টোকাতেই শুরু হয় দুর্গোৎসবের উৎসবধ্বনি। সময়ের সাথে সাথে পেশা বদলে গেলেও ঢাক-ঢোলের অনুরণন এখনও বাঙালির প্রাণের সুর। পূজার আলোকসজ্জা, ধূপের গন্ধ আর ঢাকের বাজনা মিলেই আজও জাগিয়ে তোলে শারদীয় আনন্দের আবহ।

















