মেগা প্রকল্পে মেগা দুর্নীতি

- আপডেট সময় : ১০:১৭:২৭ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৮ জুন ২০২৫ ৬১ বার পড়া হয়েছে
শেখ হাসিনা, শেখ রেহেনা, টিউলিপ ও সজীব ওয়াজেদ জয়সহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্র নির্মাণের নামে ৪৯ হাজার কোটি টাকা লোপাট এবং শেখ হাসিনা ও জয়ের বিরুদ্ধে ৩০০ মিলিয়ন ডলার পাচারের অভিযোগ উঠেছে : আক্তার হোসেন
দেশের চলমান অর্থনৈতিক সংকট ও ভঙ্গুর অবস্থার মূলে রয়েছে স্বেচ্ছাচারী রাজনীতি। স্বৈরাচারী রাজনীতির অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হচ্ছে আজকের বিকলাঙ্গ অর্থনীতি। এর পেছনে ছিলেন রাজনীতিবিদ, আমলা এবং নামধারী ব্যবসায়ীরা। তারা মেগা প্রকল্পে মেগা চুরির মাধ্যমে নিজেদের পকেট ভরেছে। গণঅভ্যুত্থান পর থেকেই শেখ পরিবারের বিরুদ্ধে মেগা প্রজেক্টের নামে অর্থ লুটপাটের বিস্তর দুর্নীতির ফিরিস্তি জমা পড়তে থাকে দুদকে। গেল বছরের ডিসেম্বরে ৯ মেগা প্রজেক্ট থেকে প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা দুর্নীতির অভিযোগে অনুসন্ধানে নামে সংস্থাটি। এর মধ্যে অন্যতম ছিল রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র।
রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্র নির্মাণের নামে বড় ধরনের লুটপাটের খোঁজে এবার গণপূর্তে চিঠি দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অভিযোগ বলা হয়েছে, ৪৯ হাজার কোটি টাকা লোপাট এবং শেখ হাসিনা ও জয় মিলিয়ে ৩০০ মিলিয়ন ডলার পাচার করেছে। এছাড়া উন্নয়ন প্রজেক্টের নামে দুর্নীতির অভিযোগে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহসহ ৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছ সংস্থাটি।
গতকাল বুধবার দুদকের মহাপরিচালক আক্তার হোসেন জানান, শেখ হাসিনা, শেখ রেহেনা, টিউলিপ ও সজীব ওয়াজেদ জয়সহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্র নির্মাণের নামে ৪৯ হাজার কোটি টাকা লোপাট এবং শেখ হাসিনা ও জয়ের বিরুদ্ধে ৩০০ মিলিয়ন ডলার পাচারের অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগ অনুসন্ধানে রূপপুরের সাইট প্রজেক্ট গ্রিন সিটি আবাসন পল্লীর ২৬০০ কোটি টাকার প্রজেক্টের সব নথিপত্র চেয়ে চিঠি দিয়েছে দুদক। তিনি আরও জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নের নামে লুটপাটের অভিযোগে রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) সাবেক দুই ভিসি নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ ও এ কে এম নুর-উন-নবীসহ ৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। তাদের নামে উন্নয়ন প্রজেক্টের নামে ৪ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন প্রজেক্ট জুড়েই নকশা পরিবর্তন, চুক্তিতে মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনে উপেক্ষাসহ নানা অনিয়মের প্রমাণ মিলেছে বলে জানান দুদক মহাপরিচালক।
ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমলে ৯ প্রকল্পে ৮০ হাজার কোটি টাকা দুর্নীতি হয়েছে। এসব প্রকল্পের নথিপত্র চেয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে চিঠি দিয়েছিল দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে- মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চল, খুরুশকুল বিশেষ আশ্রয়ণ প্রকল্প, মিরসরাই বেপজা অর্থনৈতিক অঞ্চল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরের পানি শোধনাগার ও গভীর নলকূপ স্থাপন, মিরসরাইয়ে ভারতীয় অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপন ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর উন্নয়ন প্রকল্প।
দুদক সূত্র থেকে জানা যায়, এসব প্রকল্পের প্রস্তাব/প্রাক্কলন, অনুমোদিত প্রস্তাব/প্রাক্কলন, বাজেট অনুমোদন, বরাদ্দ, অর্থ ছাড়করণ, ব্যয় অর্থের পরিমাণ ও এই সংক্রান্ত যাবতীয় নথিপত্র এবং এসব প্রকল্প নিয়ে কোনো তদন্ত হয়ে থাকলে প্রতিবেদন ও প্রকল্প সময়ের পৃথক সারসংক্ষেপ কপি চাওয়া হয়েছে। এর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, ছোট বোন শেখ রেহানা এবং রেহানার মেয়ে ও ব্রিটিশ মন্ত্রী টিউলিপ সিদ্দিকের দেশে-বিদেশে লেনদেনের যাবতীয় নথি তলব করে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) কাছে চিঠি দেয় দুদক। একই সঙ্গে টিম নির্বাচন কমিশন অফিস এবং ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অফিসেও তাদের ব্যক্তিগত নথিপত্র তলব করে চিঠি দিয়েছে বলেও জানা গেছে। দুদক ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, ছোট বোন শেখ রেহানা এবং রেহানার মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে ২০০৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং বিশেষ আশ্রয়ণ প্রকল্পসহ নয়টি প্রকল্পে ৮০ হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান শুরু করেছিল। একই সঙ্গে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের বিরুদ্ধে ৩০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার পাচারের পৃথক আরও একটি অভিযোগ অনুসন্ধান করে সংস্থাটি।
অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, গত ১৭ ডিসেম্বর রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ৫০০ কোটি ডলারের বেশি বা ৫৯ হাজার কোটি টাকাসহ বিভিন্ন প্রকল্পে ৮০ হাজার কোটি টাকা দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। যেখানে গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার বোন শেখ রেহানা, তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ও ভাগনি টিউলিপ সিদ্দিকসহ পরিবারের সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। অভিযোগে রূপপুর ছাড়াও আশ্রয়ণসহ ৮টি প্রকল্প দুর্নীতির তথ্য আমলে নেওয়া হয়েছে। অন্যান্য প্রকল্পগুলোতে ২১ হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। এরপর ১৮ ডিসেম্বর অনুসন্ধান টিম গঠন করা হয়।
আর ২২ ডিসেম্বর শেখ হাসিনা এবং তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের বিরুদ্ধে ৩০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার পাচারের পৃথক আরও একটি অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ওই অভিযোগে বলা হয়, আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই সম্প্রতি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় বিষয়ে একটি প্রাথমিক তদন্ত করে।
২০১৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বনাম রিজভী আহমেদ মামলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের নাম প্রথম নজরে আসে। এফবিআইর তদন্তে সজীব ওয়াজেদ জয়ের গুরুতর আর্থিক কেলেঙ্কারির বিষয়টি উন্মোচিত হয়। এফবিআই তাদের লন্ডনের প্রতিনিধির মাধ্যমে বিষয়টি নিশ্চিত করেছে এবং প্রমাণ পেয়েছে যে, সেখানে গুরুতর আর্থিক অনিয়ম এবং মানি লন্ডারিং এর অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিসের (ডিওজে) সিনিয়র ট্রায়াল এটর্নী লিন্ডা সেমুয়েলস স্পেশাল এজেন্ট লা প্রিভোটের সঙ্গে যোগাযোগ করে বাংলাদেশ হতে ৩০০ মিলিয়ন ডলার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন ব্যাংক হিসেবে জমা করা হয়েছে। গত ১৫ ডিসেম্বর ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ও ভাগনি টিউলিপ সিদ্দিকের মালয়েশিয়ার ব্যাংকের মাধ্যমে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র (আরএনপিপি) থেকে ৫ বিলিয়ন বা ৫০০ কোটি ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা) লোপাটের অভিযোগ অনুসন্ধানে দুদকের নিষ্ক্রিয়তা কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন হাইকোর্ট। গত ৩ সেপ্টেম্বর এ অভিযোগ অনুসন্ধানের নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিট দায়ের করেন জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন এনডিএমের চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ। রিটে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যদের দুর্নীতি অনুসন্ধানে দুদকের নিষ্ক্রিয়তার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করা হয়। দুদক চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্টদের রিটের বিবাদী করা হয়। দুদকসহ বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ৫০০ কোটি ডলারের বেশি আত্মসাৎ করেছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গ্লোবাল ডিফেন্স কর্পের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে আসে। প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা রোসাটম মালয়েশিয়ার একটি ব্যাংকের মাধ্যমে শেখ হাসিনাকে এ অর্থ আত্মসাতের সুযোগ করে দেয়। যাতে মধ্যস্থতা করেন ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ও ভাগনি টিউলিপ সিদ্দিক। দেশের সবচেয়ে বড় ও ব্যয়বহুল প্রকল্প রূপপুরের পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। এতে বলা হয়, রাশিয়ার সহযোগিতায় বিদ্যুৎকেন্দ্রটির নির্মাণে খরচ ধরা হয় এক হাজার ২৬৫ কোটি ডলার। প্রয়োজনের তুলনায় যা অনেক বেশি। যাতে মালয়েশিয়ার একটি ব্যাংকের মাধ্যমে শেখ হাসিনাকে এই বাজেট থেকে ৫০০ কোটি ডলার আত্মসাতের সুযোগ করে দেয় প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা রোসাটম। নিজের ভাগ্নি টিউলিপ সিদ্দিকের মধ্যস্থতায় রাশিয়ার সঙ্গে এ চুক্তি করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আর এ মধ্যস্থতার বিনিময়ে পাচার করা অর্থের ৩০ শতাংশ পেয়েছেন টিউলিপ সিদ্দিক, শেখ রেহানা ও পরিবারের কয়েকজন সদস্য।