সংবাদ শিরোনাম ::
যুদ্ধ-শান্তির দোলাচলে মধ্যপ্রাচ্য

মহিউদ্দিন তুষার
- আপডেট সময় : ১০:৫৭:০৪ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৪ জুন ২০২৫ ১০ বার পড়া হয়েছে
ইসরাইলের সঙ্গে আরব দেশগুলোর যুদ্ধ এবারই প্রথম নয়। আবার ইরান এবং ইসরাইলের মধ্যকার যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের অংশ নেওয়া নতুন কোনো ঘটনা নয়। এটি হঠাৎ হলেও অপ্রত্যাশিত ছিল না। যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র হিসেবে সব সময়ই ইসরাইলকে ছায়া দিয়ে যাচ্ছে ক্ষমতাধর দেশটি।
গেল ১১ জুন ইসরায়েল ইরানের পারমাণবিক ও সামরিক স্থাপনায় আকস্মিক বিমান হামলা চালালে চলতি মাসে এই সংঘাতের সূচনা হয়। ওই হামলায় ইরানের কয়েকজন শীর্ষ জেনারেল ও পারমাণবিক বিজ্ঞানী নিহত হন। এর পাল্টা জবাবে ইরানও ইসরায়েলে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। এরপর থেকে দুই পক্ষের মধ্যে পাল্টাপাল্টি হামলা চলে। গত রোববার যুক্তরাষ্ট্রও এই সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে এবং ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় বিমান হামলা চালায়। এর ফলে মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে।
ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে ১২ দিনের তীব্র সংঘাতের পর অবশেষে উভয় দেশ যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে। এই সংঘাত বন্ধ করতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বারবার আলোচনার জন্য ইরানকে আহ্বান জানালেও তেহরান তাতে কোনো কর্ণপাত করেনি। কাতার যখন মধ্যস্থতার কথা বলে, তখনই উভয় দেশ যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয়।
ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় বিমান হামলা প্রতিশোধ হিসেবে সোমবার রাতে কাতারের মার্কিন ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করে ইরান। তবে সেখানে কোনো ক্ষয়ক্ষতি বা হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। এর পর মঙ্গলবার ভোরের দিকে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সৈয়দ আব্বাস আরাঘচি জানিয়েছেন, ইসরায়েল আক্রমণ বন্ধ করলে ইরানের জবাব দেওয়ার কোনো ইচ্ছা নেই। এর কয়েক ঘণ্টা আগে ইসরায়েল ও ইরান একটি সম্পূর্ণ ও সর্বাত্মক যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে বলে সামাজিক মাধ্যমে ঘোষণা দেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে তীব্র পাল্টা আঘাত হানার ঘোষণা দেওয়ার পরপরই ইরানে নতুন করে হামলা চালানো থেকে বিরত থাকতে ইসরায়েলকে কড়া ভাষায় সতর্ক করেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। মঙ্গলবার নিজস্ব সামাজিকমাধ্যম ট্রুথ সোশালে লেখেন, ইসরায়েল, বোমা ফেলো না। এটা করলে তা হবে একটি বড় ধরনের লঙ্ঘন। তোমাদের পাইলটদের এখনই ফিরিয়ে আনো! তার এই মন্তব্যে স্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছে, ওয়াশিংটন এখন আর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেতে দিতে চায় না। যুদ্ধবিরতির পরও উত্তেজনা যখন স্থিতিশীল হয়নি, তখন ট্রাম্পের প্রকাশ্য হুঁশিয়ারি মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত উদ্বেগকেই সামনে এনে দিয়েছে।
ট্রাম্পের হুঁশিয়ারি পরই প্রস্তাবিত যুদ্ধবিরতিতে সম্মতি দিয়েছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। দেশটির প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের প্রকাশিত বিবৃতির বরাতে এ খবর পাওয়া যায়। বিবৃতিতে নেতানিয়াহু দাবি করেছেন, ইরানের বিরুদ্ধে পরিচালিত ‘অপারেশন রাইজিং লায়ন’ সফলভাবে শেষ হয়েছে এবং এতে ইসরায়েল তাদের সব লক্ষ্য অর্জন করেছে। বিবৃতিতে বলা হয়, ইসরায়েল একটি দ্বিমুখী অস্তিত্বগত হুমকি—পরমাণু ও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রদূর করতে সক্ষম হয়েছে। অভিযানে ইসরায়েলি বাহিনী তেহরানের আকাশসীমায় পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে, ইরানের সামরিক নেতৃত্বে বড় ধরনের ক্ষতি ঘটায় এবং দেশটির কেন্দ্রীয় সরকারের ডজনখানেক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় হামলা চালায়। বিবৃতিতে আরও বলা হয়, অভিযানের লক্ষ্য পূর্ণ হওয়ায় এবং প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে পূর্ণ সমন্বয়ের ভিত্তিতে ইসরায়েল দ্বিপক্ষীয় যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে সম্মত হয়েছে। তবে ইসরায়েল হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছে, যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন হলে তারা ‘জবাব দেবে’।
এদিকে ইরানের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, তেহরান যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে। কাতারের প্রধানমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ বিন আবদুর রহমান আল থানির মধ্যস্থতায় ইরানি কর্মকর্তাদের সঙ্গে ফোনালাপের মাধ্যমে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছায় তেহরান। তবে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাইয়েদ আব্বাস আরাগচি বলেছেন, যদি ইসরায়েল অবৈধ আগ্রাসন এখনই বন্ধ করে তাহলে ইরান আর পাল্টা জবাব দেয়ার কোনো ইচ্ছা রাখে না।
আরাগচি এক্স (সাবেক টুইটার) পোস্টে বলেন, ভোর ৪টার মধ্যে ইসরায়েল যদি হামলা বন্ধ না করে, তাহলে ইরানের পাল্টা আক্রমণ চলতেই থাকবে। তিনি বলেন, ইসরায়েলই যুদ্ধ শুরু করেছে, আমরা না। এখন পর্যন্ত কোনো যুদ্ধবিরতি চুক্তি হয়নি, তবে ইসরায়েলের আগ্রাসন বন্ধ হলে আমরা আমাদের প্রতিক্রিয়া থামাব। তিনি আরও জানান, সামরিক অভিযান বন্ধের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত পরে নেওয়া হবে।
ইরানের পরমাণু স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্রের বিমান হামলার ফলে বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতি ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে নতুন করে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, এর ফলে তেলের দাম বাড়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, যা সরাসরি ভোক্তা ব্যয়, বিনিয়োগ জিডিপি প্রবৃদ্ধিকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করতে পারে।
ফেডারেল রিজার্ভের চেয়ারম্যান জেরোম পাওয়েল এই সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদ (কংগ্রেস) এ সাক্ষ্য দেবেন। তাঁর শুনানির সময়, মধ্যপ্রাচ্য সংকটের অর্থনৈতিক প্রভাব নিয়ে আলোচনা হবে। যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমবাজার ইতোমধ্যেই মন্থর হয়ে পড়েছে, অর্থাৎ নতুন চাকরি তৈরির গতি কমেছে। ট্রাম্প প্রশাসনের শুল্ক নীতির পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যের এই সংঘাত মূল্যস্ফীতির ঝুঁকিকে নতুন মাত্রা দিচ্ছে।
বিশ্ব অর্থনীতিতে এই অস্থিরতা কীভাবে প্রভাব ফেলবে, তা জানতে বিশ্লেষকরা নজর রাখছেন ফেডারেল রিজার্ভ বা মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিগত অবস্থানের দিকে। সেদিক থেকে কংগ্রেসে পাওয়েলের বক্তব্য হতে চলেছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ যুক্তরাষ্ট্রে গৃহস্থালি ব্যয় কমারও আশঙ্কা করা হচ্ছে, ব্যবসাগুলোও হয়তো একই পথে হাঁটবে তখন। ইরানের হামলার পর বিশ্বব্যাপী জ্বালানি মূল্য অস্থিতিশীল হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। ব্রেন্ট ক্রুডের দাম বেড়ে ৮০ – ১০০ ডলারে পৌঁছাতে পারে। মর্গান স্ট্যানলির আর্থিক বিশ্লেষক অ্যালেন ঝেন্টনার মনে করছেন, তেলের দাম বাড়লে ভোক্তাপণ্যের দাম বাড়ায়— গৃহস্থালী খরচ কমবে। যা যুক্তরাষ্ট্রসহ বাকি বিশ্বের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
১২ দিনের চলমান যুদ্ধেও ফলে বিশ্ববাজারে তৈরি হয় অস্থিরতা। তেলের দাম ১১%-এ পৌঁছে যা এক মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। বিশ্বব্যাপী শেয়ারবাজারের পতন ঘটে। হামলার ভয়ে দেশ ছেড়ে লেজ গুটিয়ে পালায় হাজার হাজার ইসরায়েলি ইহুদিরা। তবে ইসরায়েলের হামলায় ইরানে নিহত ৬০৬ জন আহত ৫ হাজারের বেশি। ইরানের মত এত নিহত না হলেও যতেষ্ট ক্ষতির মুখে পড়েছে দেশটি।