রাজনৈতিক অস্থিরতায় বাড়ছে অপরাধ
- আপডেট সময় : ১০:৫০:৩০ অপরাহ্ন, সোমবার, ২০ জানুয়ারী ২০২৫ ৬ বার পড়া হয়েছে
* ছিনতাই হচ্ছে মধ্যরাত থেকে ভোর পর্যন্ত, এমনকি দিনে-দুপুরেও * সড়ক, বাসাবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বেশি হানা দিচ্ছে। বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ব্যাংকের গ্রাহকদেরও টার্গেট করা হচ্ছে * পুলিশ সদর দপ্তরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেছেন, আমরা জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনতে কঠোর পরিশ্রম করছি। অপরাধ নিয়ন্ত্রণে অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় এবং উন্নত গোয়েন্দা তৎপরতা সুনিশ্চিত করা হচ্ছে
রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর সবচেয়ে নাজুক অবস্থায় রয়েছে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। লম্বা সময় মাঠে ছিল না পুলিশ। বিভিন্ন থানা থেকে অস্ত্র লুট, আসামি পলায়নের ঘটনাও ঘটে। এখনো শতভাগ নিয়ন্ত্রণে আসেনি সেই আইনশৃঙ্খলা। এ সুযোগে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে অপরাধীরা। কিছু সীমাবদ্ধতা নিয়ে পরিস্থিতি সামলাতে নাজেহাল পুলিশ। ছিনতাই বেশি বেড়ে যাওয়ায় নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কায় রাজধানীবাসী। মধ্যরাত থেকে ভোর পর্যন্ত, এমনকি দিনে-দুপুরেও ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে। ছিনতাই প্রতিরোধে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কার্যত কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না বলে মনে করছেন ভুক্তভোগীরা।
এবিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি বিভিন্ন গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহে রাজধানীর ৫০টি থানার পুলিশ সদস্যদের পাশাপাশি গোয়েন্দা পুলিশসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা নিয়োজিত। রাজধানীতে রাতে, বিশেষ করে ভোরের দিকে ছিনতাইয়ের ঘটনায় বেশ উদ্বিগ্ন খোদ ডিএমপির পুলিশ কর্মকর্তারাই।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজনৈতিক পট পরিবর্তন ও অন্তর্বর্তী কালিন সরকার গঠনের পর বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে অপরাধমূলক কর্মকান্ড বেড়েছে। গ্রেফতার জেল জরিমানাও নিয়ন্ত্রনে আসছে না আইন শৃংখলা পরিস্থিতি। প্রতিনিয়ত ঘটছে চুরি, ডাকাতি, খুন অপহরনের পর জিম্মি এবং মোটা অঙ্কের টাকা আদায়ের মতো ঘটনা। যা জনসাধারণের মধ্যে আতঙ্ক ও উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে।
পুলিশ বলেছে, গত রোববার রাজধানীর কদমতলী এলাকায় যাত্রীবেশে গাড়ি নিয়ে ছিনতাই চক্রের পাঁচ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে ডিএমপির কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট। চক্রটি গত এক বছর ধরে মাইক্রোবাস নিয়ে ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় ছিনতাই করত বলে জানিয়েছে পুলিশ। গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন, মোহাম্মদ আকতার হোসেন, হারুনুর রশিদ, কামাল হোসেন, মোহাম্মদ নুরুদ্দিন ও মোহাম্মদ হানিফ। তাদের কাছ থেকে ১১টি মোবাইল ফোন, একটি মাইক্রোবাস ও একটি পাওয়ার ব্যাংক জব্দ করা হয়েছে।
ডিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বলেন, ‘চক্রটি গত এক বছর ধরে রাজধানীতে সক্রিয় ছিল। তারা রাতে বেরিয়ে সাধারণ যাত্রীবেশে মাইক্রোবাসে বসে থাকত। চক্রটি সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ি, রায়েরবাগ, সাইনবোর্ডসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে যাত্রী তুলে সুবিধাজনক জায়গায় নিয়ে জিম্মি করে যাবতীয় মালামাল লুটে নিত। পরে লুট করা অর্থ চক্রের সদস্যরা নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করত। আর ছিনতাইকৃত মোবাইলগুলো গুলিস্তানে বিক্রি করে দিত। তিনি বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে চক্রের সদস্যরা জানিয়েছেন, তাদের মাধ্যমে অন্তত পাঁচ শতাধিক ব্যক্তি ছিনতাইয়ের শিকার হয়েছেন। তারা অপহরন ও জিম্মী করে টাকা আদায়ের সঙ্গে জড়িত রয়েছে। গ্রেপ্তারকৃতদের বিরুদ্ধে কদমতলী থানায় একাধিক মামলা রয়েছে। চক্রের অন্য সদস্যদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
পুলিশের একাধিক সূত্র বলছে, বেশিরভাগ চুরি-ছিনতাই-ডাকাতি ঘটছে মধ্যরাত থেকে ভোর পর্যন্ত। গত দুই মাসে যেসব ছিনতাই ঘটেছে সবই এ সময়ের মধ্যে। এর মধ্যে ডাকাতির ঘটনা বিশ্লেষণ করে পুলিশ জানতে পেরেছে, সড়ক, বাসাবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে তারা বেশি হানা দিয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ব্যাংকের গ্রাহকদেরও টার্গেট করা হচ্ছে। আর ভোরের দিকে বাসস্ট্যান্ড, লঞ্চ টার্মিনাল, রেলস্টেশন ও নিরিবিলি-অন্ধকার সড়কে রিকশাযাত্রীদের নিশানা বানিয়েছে ছিনতাইকারীরা।
ডিএমপির তৈরি করা এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ছিনতাইকারী বেশি রাজধানীর মোহাম্মদপুর, শাহবাগ, ভাটারা, বাড্ডা, শেরেবাংলানগর, হাজারীবাগ, তেজগাঁও, হাতিরঝিল, মিরপুর, পল্লবী, বিমানবন্দর, খিলক্ষেত ও উত্তরা পশ্চিম থানা এলাকায়। এসব অপরাধে জড়িতদের পূর্ণাঙ্গ বৃত্তান্তও রয়েছে।
পুলিশ মাঠ পর্যায়ের তথ্য বিশ্লেষণ করে জানতে পেরেছে, ঢাকায় সবচেয়ে বেশি ছিনতাইকারী ও ডাকাত রয়েছে তেজগাঁও বিভাগে। সবচেয়ে কম মিরপুর বিভাগে। থানার তথ্য বলছে, সবচেয়ে বেশি ছিনতাইকারী ও ডাকাত রয়েছে শাহবাগ, ভাটারা ও শেরেবাংলানগর থানা এলাকায়। আর সবচেয়ে কম ছিনতাইকারী ও ডাকাতের নাম তালিকাভুক্ত রয়েছে দক্ষিণখান, উত্তরখান ও উত্তরা পূর্ব থানা এলাকায়।
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্যানুযায়ী, শেখ হাসিনার শাসনামলের শেষ দিকে শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে আন্দোলন শুরু হলে রাজনৈতিক অস্থিরতার পরিণামে হত্যাকা-, ডাকাতি এবং অপহরণের মতো সহিংস অপরাধগুলোর সংখ্যা চার মাসের মধ্যে উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়। কিন্তু সরকার পতন নতুন সরকার আমলে অপরাধের ঘটনা আরো বেশি ঘটছে।
পুলিশ সদর দফতরের হিসেব অনুযায়ী গত পহেলা আগস্ট থেকে ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১ হাজার ৫৬১টি হত্যাকা- ঘটে, যা ১ এপ্রিল থেকে ৩১ জুলাই পর্যন্ত ১ হাজার ১৫৮টি ছিল। ডাকাতির ঘটনা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫শত। যা আগের চার মাসে ছিল ৪১৬টি। অপহরণের ঘটনা বেড়ে তিশ শতাধিকে। যা পূর্ববর্তী সময়ে ছিল ১৬৮টি। তবে চুরি এবং ছিনতাইয়ের ঘটনা যথাক্রমে ৮৪৪ এবং ২ হাজার ৪২৪-এ নেমে এসেছে, যা আগের চার মাসে ছিল ৯০৯ এবং ৩ হাজার ৬৮।
বিশেষজ্ঞরা এ অপরাধের বৃদ্ধিকে রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং সামাজিক অর্ডারের ভাঙনকে দায়ী করছেন। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দুর্বলতা এবং অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে অপরাধীরা যেন আরও সাহসী হয়ে উঠেছে। এ ছাড়া বিচারিক প্রক্রিয়ার ব্যাঘাতও অপরাধ বৃদ্ধির পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিদ অধ্যাপক হাফিজুর রহমান কার্জন বলেছেন, রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার ফলে সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি হওয়ায় অপরাধী দলগুলো নির্বিঘ্নে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারছে। এ পদক্ষেপের পরও জনগণের মধ্যে উদ্বেগ অব্যাহত রয়েছে। কমিউনিটি নেতারা এবং মানবাধিকার সংগঠনগুলো অপরাধ বৃদ্ধির মূল কারণগুলো দূর করার জন্য জরুরি সংস্কারের দাবি জানিয়েছেন। নাগরিকরা সরকারের কাছে জনগণের নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দিয়ে সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংস্কারের পাশাপাশি শক্তিশালী পুলিশিংয়ের প্রতি জোর দিয়েছে।
অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তারা বলেছেন, বর্তমান অপরাধপ্রবণতা রাজনৈতিক পরিবর্তনের সময়ে উদ্ভূত দুর্বলতার ফলে সৃষ্টি হয়েছে। যদিও এখনই অপরাধ দমন করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে, তবে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা দীর্ঘমেয়াদি মনোযোগ দাবি করে। এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় অন্তর্বতী সরকার পুলিশ বাহিনীকে স্থিতিশীল করার জন্য কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। বিশেষ করে নগরাঞ্চলে অপরাধের হার বেশি হওয়ায় বাড়ানো হয়েছে প্যাট্রোলিং, নজরদারি এবং কমিউনিটি পুলিশিং কার্যক্রম। ডাকাতি, অপহরণ রোধ করতে অপরাধী চক্রগুলোর বিরুদ্ধে তদন্ত পরিচালনা করা হচ্ছে, যার ফলে কয়েকজন প্রধান অপরাধীকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেছেন, আমরা জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনতে কঠোর পরিশ্রম করছি। অপরাধ নিয়ন্ত্রণে অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় এবং উন্নত গোয়েন্দা তৎপরতা সুনিশ্চিত করা হচ্ছে। তারা আরও বলেছেন, আইন প্রয়োগ, বিচারিক কার্যক্রমের উন্নতি এবং সামাজিক সংস্কারের মাধ্যমে একটি ব্যাপক সমন্বিত দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা প্রয়োজন, যাতে দেশের স্থিতিশীলতা ফিরে আসে এবং সব নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়।