নারী মুক্তিযোদ্ধা ফুলমতির ছেলে রতন
রাস্তায় বসে জুতা সেলাই করে চলে সংসার, ছেলে-মেয়ে পড়ছে কলেজে
- আপডেট সময় : ৪১ বার পড়া হয়েছে
পাকা সড়কের ধারে কাঠের বাক্সে মাথা রেখে ঝিমুচ্ছেন রতন কুমার দাস (৪৮)। মলিন সাদা শার্ট ও পুরোনো লুঙ্গি পরিহিত রতন প্রতিদিন রোদ-বৃষ্টি-ঝড় উপেক্ষা করে মানুষের জুতা মেরামত ও পালিশ করেন। ক্লান্তি সইতে না পেরে মাঝে মাঝে রাস্তাতেই বাক্সের ওপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েন।
এই চিত্র চোখে পড়বে গাইবান্ধার সাদুল্লাপুর উপজেলার চৌমাথা মোড়ে। দেখা যায়, ছোট্ট চট বিছিয়ে বসে রতন অপেক্ষা করেন কখন কে জুতা বা স্যান্ডেল মেরামতের জন্য আসবে। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানান, সকাল ৯টা থেকে বিকেল পর্যন্ত নিয়মিত এখানে বসে থাকেন। পাশের ঔষধ দোকানদার ডা. মহসিন আলী বলেন, ‘রতন শারীরিক ও মানসিকভাবে কিছুটা অসুস্থ হলেও কাজের প্রতি মনোবল অসাধারণ। তিনি নিয়মিত পত্রিকাও পড়েন।’
রতন কুমার কোন সাধারণ শ্রমজীবী নন। তিনি এক নারী মুক্তিযোদ্ধা, বীরাঙ্গনা ফুলমতির ছেলে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনারা ও তাদের সহযোগীরা তাকে সাদুল্লাপুরের উত্তরপাড়ার বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায়। সেখানে দীর্ঘদিন নির্যাতনের শিকার হতে হয়। মুক্তিযুদ্ধ শেষে শুরু হয় ফুলমতির সংগ্রামী জীবন, যা আজও চলমান।
রতন একা নয়, তাঁর পরিবারে স্ত্রী, দুই ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছেন। বড় মেয়ে তৃষ্ণা রাণী দাস লক্ষী সাদুল্লাপুর সরকারি কলেজে ডিগ্রী প্রথম বর্ষে পড়ছেন, ছোট ছেলে জীবন কুমার দাস একাদশ শ্রেণিতে, আর বড় ছেলে স্বপন কুমার দাস পড়েছেন চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত।
রতনের বাবা কুশিরাম সরকার ফসিয়ার মৃত্যু হয় ১৯৮৮ সালে। স্ত্রী, পাঁচ ছেলে ও দুই মেয়ে রেখে যান তিনি। পরে এক ছেলে ও এক মেয়ে মারা যায়। সংসারের ভার একা বহন করতে হয় ফুলমতিকে। বড় ছেলে রতন ও নিরঞ্জন কখনো জুতা সেলাই কখনো দিনমজুরের কাজ করেন। ছোট ছেলে সুজন কুমার সরকারি দপ্তরে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী। অপর ছেলে মনিরাজ ২০১৭ সালে রংপুর কারমাইকেল কলেজ থেকে মাস্টার্স পাস করেছেন। এখন তিনি বাড়ির সামনে ছোট্ট দোকানঘরে কম্পিউটার বসিয়ে ভুমি সেবা ও অনলাইন কাজ করেন।
রতনের ছোট ভাই মনিরাজ কুমার জানান, ছোটবেলা থেকেই রতন দায়িত্বশীল ছিলেন। প্রতিবেশির সঙ্গে জমি বিরোধে মারপিটে আহত হয়ে তিনি শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। চিকিৎসা করেও স্বাভাবিকভাবে চলতে বা কথা বলতে পারেন না। তবুও জীবিকার তাগিদে জুতা সেলাই করছেন। মা মৃত্যুশয্যায়, আর রতন ও নিরঞ্জন দীর্ঘদিন অসুস্থ। সামান্য ভাতা দিয়েই সংসার চলে, মা ও ছোট ভাই সুজন আলাদা করে খাবার ব্যবস্থা করেন, অন্য দুই ভাই স্ত্রী-সন্তান নিয়ে আলাদা সংসার করছেন।
মনিরাজ আরও জানান, তিনি ও ছোট ভাই সুজন অনেক কষ্ট করে লেখাপড়া শেষ করেছেন। সুজন বর্তমানে চতুর্থ শ্রেণির নৈশ্য প্রহরির চাকরি করছেন। কয়েক বছর আগে তিনি ভাড়া করা দোকানঘরে জুতা তৈরি ও সেলাইয়ের কাজও করতেন। মনিরাজ নিজেও মাস্টার্স শেষ করেও চাকরি পাননি। শেষ পর্যন্ত বাড়ির সামনে ছোট্ট দোকানঘরে কম্পিউটার বসিয়ে ভূমি সেবা ও অনলাইনভিত্তিক কাজ শুরু করেছেন। এতে যা আয় হয়, তা দিয়েই সংসার চলে।
বর্তমানে ৮২ বছরের বীরাঙ্গনা ফুলমতি স্ট্রোক ও বয়সজনিত কারণে শয্যাশায়ী। পরিবারকে সামান্য ভাতা দিয়েই চলতে হয়। ২০১৭ সালে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় তাকে পাকা ঘর দিয়েছে। ২০২০ ও ২০২৩ সালে রতন ও নিরঞ্জনকে সরকারী খাসের জমি দিয়ে ঘর দেওয়া হয়েছে। ফুলমতি নারী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পেলেও এখন তিনি প্রায় অবহেলিত। বিশেষ দিবসে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানানো আর মাসিক ভাতার টাকাই তাঁর জীবনের অবলম্বন।
অন্যদিকে, একজন নারী মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হয়েও রতন কুমারের জীবন কাটছে ক্ষুধা, কষ্ট আর অবহেলায়। রতন জীবন সংগ্রামে অবিরাম লড়াই করেছেন। ছেলে মেয়েকে লেখাপড়া শিখিয়ে বড় করছেন। যেটা অনেকে পারেন না, সেটা রতন দেখিয়েছেন সন্তানকে কিভাবে বড় করতে হয়। অথচ স্বাধীনতার পাঁচ দশক পরও রতনসহ তাঁর পরিবার প্রাপ্য সম্মান ও মর্যাদা পাননি।
স্থানীয়রা দাবি করছেন, রতন ও ফুলমতির পাশে প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের এগিয়ে আসা উচিত। সমাজের বিত্তবানদেরও আহ্বান—রতনকে একটি দোকানঘর দিলে তিনি আরও ভালোভাবে কাজ করতে পারবেন। চিকিৎসা দিলে স্বনির্ভর হয়ে সংসারে কিছুটা স্বচ্ছলতা ফিরবে, লাঘব হবে অন্তত কিছুটা দুঃখকষ্ট।
সাদুল্লাপুর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রশিদ আজমীর সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান, বার্ধক্যজনিত কারণে বীর মুক্তিযোদ্ধা রাজকুমারী রবিদাস ফুলমতি নানা রোগে ভুগছেন। আমি নিজেও বিভিন্ন সমস্যায় ভুগছি। হার্ড অপারেশনের পর নিয়মিত চিকিৎসা নিতে হয় আমাকে। কিন্তু ফুলমতির চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থা নেই, কেউ তার খোঁজও নেয় না। মৃত্যুর আগে তার চিকিৎসা জরুরি।
তিনি আরও জানান, রাজকুমারী রবিদাস ফুলমতির জীবন-যাপন এবং বীরাঙ্গনা স্বীকৃতির বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে একাধিক সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। তার রাষ্ট্রীয় মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি, বসতঘর ও অন্যান্য সহায়তার জন্য তিনি নিজে প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। অবশেষে ২০১৬ সালে মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) ৩৩তম সভায় ফুলমতিসহ ২৬ জন বীরাঙ্গনাকে সরকারি স্বীকৃতি দেওয়া হয়।





















