শত কোটি টাকার গন্ধ চারপাশে

- আপডেট সময় : ১৩২ বার পড়া হয়েছে
বিআইডব্লিউটিএ’র অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আইয়ুব আলী মোল্লা দীর্ঘদিন ধরেই দুর্নীতির অভিযোগের কেন্দ্রবিন্দু। এখনো তিনি বহাল তবিয়তে ক্ষমতার বলয়ে অবস্থান করছেন। তার পরিবারের সদস্যরাও এখন সম্পদে ফুলে ফেঁপে উঠেছেন
সরকারি চাকরির চেয়ারে বহাল থাকা একজন প্রকৌশলীর চারপাশে ঘুরপাক খাচ্ছে শত কোটি টাকার গন্ধ। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) -এর অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (যান্ত্রিক/মেরিন) আইয়ুব আলী মোল্লা দীর্ঘদিন ধরেই দুর্নীতির অভিযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন। এখনো তিনি বহাল তবিয়তে নিজের চেয়ারে নিঃশব্দে, কিন্তু নিঃশর্ত ক্ষমতার বলয়ে অবস্থান করছেন।
বিআইডব্লিউটিএ ও সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, বিশ্বব্যাংক ও সরকারি অর্থায়নে পরিচালিত একাধিক ড্রেজিং প্রকল্পে শত কোটি টাকার অস্বচ্ছ বিল জারি, ভুয়া ভাউচার এবং কাজ না করেই টাকা উত্তোলনের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। প্রকল্পের আড়ালে, ঘুষ-বাণিজ্যের ছায়ায়, ক্ষমতার আশ্রয়ে গড়ে তুলেছেন বিপুল সম্পদের পাহাড় এমন অভিযোগ তুলেছেন তার নিজ গ্রামের বাড়ির স্থানীয় বাসিন্দারা।
বিশ্বস্ত সূত্র জানায়, আইয়ুব আলীর দুই সন্তান বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ায় স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। অভিযোগ রয়েছে, তিনি লন্ডন ও নিউইয়র্কে বাড়ি কিনেছেন, এবং পৈত্রিক গ্রাম যশোর জেলার বাঘার পাড়া উপজেলার বলরামপুর গ্রাম (নারকেলবাড়িয়া) এলাকায় প্রতিমাসে তাঁর পরিবারের কাছে এক লাখ টাকা পাঠান। তাঁর শৈশবের শুরু নারকেল বাড়িয়া বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে। ১৯৮৩ সালে ওখান থেকেই তিনি এসএসসি পাস করেন।
তাঁর পিতা, মরহুম নুরুল হক মোল্লা, ছিলেন একজন সাধারণ গৃহস্থ-দারিদ্র্য ও টানাপোড়েনের মধ্যেই কাটিয়েছেন জীবন যাত্রা। অথচ আজ তাঁর সন্তান কোটি টাকার মালিক! প্রশ্ন উঠেছে—এই ‘উৎপত্তি’ কীভাবে? তার গ্রামের বাসিন্দা আফজাল হোসেন বলেন, নুরুল হক মোল্লার ৩ নম্বর ছেলে হয়েও আইয়ুব আলী বড় সন্তানের মতোই দায়িত্বশীল ছিলেন। এখন শুনি তিনি ৫ লাখ টাকা বেতন পান! ভাইদের জন্যও লাখ লাখ টাকা পাঠান।
স্থানীয়দের অভিযোগ আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিহীন সম্পদের উত্থান এবং পরিবারের সদস্যদের নামে গোপনে সম্পদ স্থানান্তরের মাধ্যমে একটি ‘অদৃশ্য অর্থনৈতিক সাম্রাজ্য’ গড়ে উঠেছে।
অধিদপ্তর সূত্র বলছে ড্রেজিং প্রকল্পসহ প্রায় সকল ধরনের সংরক্ষণ ড্রেজিং কাজের জন্য ব্যয় হয়ে থাকে প্রতি ঘনমিটার ১৪৫-১৬০.টাকা করে। কিন্তু প্রকৌশলী আইয়ুব আলী বিশ্বব্যাংক প্রকল্পে ঠিকাদারদের সাথে যোগসাজশ করে প্রতি ঘনমিটার ড্রেজিং এর জন্য ৫০০-৫৫০-টাকা পর্যন্ত বিল-ভাউচার করেছেন। অর্থাৎ প্রতি ঘনমিটার ড্রেজিং এর জন্য ঠিকাদারকে ৩৫০-৪০০ টাকা বেশী বিল প্রদান করা হয়েছে।
জানা যায় এপর্যন্ত কর্নফুলীসহ দুটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের প্রায় ১৪০ লাখ ঘনমিটার মাটির বিল বাবদ ৭০০ কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। সেই হিসেবে অতিরিক্ত বিল পরিশোধ করা হয়েছে ৪৭৬ কোটি টাকা। অধিদপ্তর সূত্র বলছে অতিরিক্ত ৪৭৬ কোটি টাকা ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ভাগবাটোয়ারা করে নিয়েছেন আইয়ুব আলী। আইয়ুব আলীর ছোট ভাই মোশারফ হোসেন মোল্লা বর্তমানে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সহকারী পরিচালক (প্রশাসন) পদে কর্মরত। তাঁর বিরুদ্ধেও উঠেছে তদবির বাণিজ্য, বদলি বাণিজ্য, ও হুমকি, ক্ষমতার অপব্যবহার গোপন সম্পদ বণ্টনের অভিযোগ।
স্থানীয় বাসিন্দা আকবর বলেন,শুনেছি, আইয়ুব আলী আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা সাইফুজ্জামান শেখরের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। তাই সবকিছু তাঁর ইশারায় হয়। অভিযোগ রয়েছে, সরকারি পদমর্যাদার সুযোগ নিয়ে প্রশাসনিক কর্তৃত্বের মোড়কে অসংখ্য মানুষকে হুমকি, চাপ, বদলি ও হয়রানির মুখোমুখি করা হয়েছে।
একাধিক সূত্রে জানা গেছে, মোশারফ হোসেনের স্ত্রী ও কন্যার নামে ঢাকার অভিজাত এলাকায় জমি ও ফ্ল্যাট রয়েছে যা বর্তমানে তদন্তাধীন। পরিবারের উত্থান,প্রশ্নবিদ্ধ স্বচ্ছতা এক সময়ের খালি ভিটে এখন পরিণত হয়েছে বহুতল ভবনের সম্পত্তিতে।
এক প্রতিবেশী (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) বলেন, ওদের একসময় কিছুই ছিল না। এখন তো দেশের বাইরে পর্যন্ত ফ্ল্যাট, জমি সবই কিনেছেন দেখার কেউ নেই।অভিযোগ আছে, দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তাদের শুধু বহাল রাখাই নয়, অনেকক্ষেত্রে তাদের পুরস্কৃতও করা হচ্ছে। সচিব বা উপদেষ্টাদের কাছে একাধিক অভিযোগ থাকার পরও কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।
২০১৮ সালের বিআইডব্লিউটিএ বঙ্গবন্ধু পরিষদের সহ-সভাপতি হিসেবে আইয়ুব আলীর নাম দেখা যায়, ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার উপর নিপীড়নের আওয়ামী লীগের অর্থ যোগানদাতা তিনি নিজেই। অভিযোগ রয়েছে, তিনি তাঁর সন্তান ও ভাইদের নামে আলাদাভাবে জমি কিনে দিয়েছেন। ছোট ভাই ড. ইউনুস মোল্লার নামেও উল্লেখযোগ্য সম্পদের তথ্য মিলেছে।
এই পরিবারের সদস্যরা হচ্ছে, মরহুম নুরুল হক মোল্লা (পিতা), মাতা মরহুমা ফুলজান বেগম, বড় ভাই মৃত গোলাম সরোয়ার মোল্লা, মেজ ভাই ওলিয়ার রহমান মোল্লা, সেজ ভাই প্রকৌশলী আইয়ুব আলী মোল্লা, চতুর্থ ভাই মোশারফ হোসেন মোল্লা (স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়), ছোট ভাই ড. ইউনুস মোল্লা ও একমাত্র বোন হালিমা বেগম। আইয়ুব আলী ও তাঁর পরিবারের সম্পদের বিস্তার শুধু একজন প্রকৌশলীর বিত্তের প্রশ্ন নয়, বরং এটি প্রশ্ন তোলে দেশের সরকারি কাঠামো, জবাবদিহিতা ও নিয়ন্ত্রণব্যবস্থার উপর। যে পদ্ধতিতে একজন কর্মকর্তা হয়ে দেশে-বিদেশে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলা সম্ভব, সেটি আমাদের রাষ্ট্রীয় নৈতিক কাঠামোকেই চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে।