শুকিয়ে যাচ্ছে ভাটির দেশ বাংলাদেশ

- আপডেট সময় : ০১:১৩:২৪ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৭ মার্চ ২০২৫ ১৩ বার পড়া হয়েছে
বর্ষায় কিছুদিনের জন্য পদ্মায় পানি থাকলেও আষাঢ়-শ্রাবণ শেষেই কমতে থাকে পানি। এরপর থেকে কমতে কমতে চৈত্রে এসে পরিণত হয় ধু-ধু বালুচরে। শুধু পদ্মা নয়, পদ্মার প্রবাহ ঘিরে এককালের সজাগ থাকা শাখা নদীগুলোরও এখন আর কোনো অস্তিত্ব নেই। মূলত পার্শ্ববর্তী দেশের ফারাক্কার প্রভাবেই গত ৫০ বছরে পানির প্রবাহ কমেছে ৭১ শতাংশ
একসময় রাজশাহী অঞ্চলের সবচেয়ে খরস্রোতা ছিল নদী পদ্মা। অনেক আগেই রূপ হারিয়েছে সেই নদী। কালের পরিক্রমায় এখন ঐতিহ্যটুকুও হারাতে বসেছে। বর্ষায় কিছুদিনের জন্য পদ্মায় পানি থাকলেও আষাঢ়-শ্রাবণ শেষেই কমতে থাকে পানি। এরপর থেকে কমতে কমতে চৈত্রে এসে পরিণত হয় ধু-ধু বালুচরে। শুধু পদ্মা নয়, পদ্মার প্রবাহ ঘিরে এককালের সজাগ থাকা শাখা নদীগুলোরও এখন আর কোনো অস্তিত্ব নেই। মূলত পার্শ্ববর্তী দেশের ফারাক্কার প্রভাবেই গত ৫০ বছরে পানির প্রবাহ কমেছে ৭১ শতাংশ।
বিশেষজ্ঞরা এই পানি হ্রাসের মূল কারণ হিসেবে পদ্মা নদীর জলপ্রবাহ কমে যাওয়া এবং পানির স্তর হ্রাসকে চিহ্নিত করেছেন, যা মূলত ভারতের ফরাক্কা ব্যারেজের কারণে হয়েছে। ১৯৭৫ সালে পশ্চিমবঙ্গে সেচের জন্য গঙ্গা নদী থেকে পানি ব্যবহার করার জন্য এই ব্যারেজ নির্মিত হয়েছিল, যা বাংলাদেশের পরিবেশের ওপর গুরুতর প্রভাব ফেলেছে। বাংলাদেশ, অস্ট্রেলিয়া এবং যুক্তরাজ্যের সাতজন গবেষক রাজশাহীতে একটি গবেষণা পরিচালনা করেন, যা স্প্রিঙ্গার ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়। সেখানে বলা হয়, ১৯৭৪ সালে পদ্মায় শুষ্ক মৌসুমে প্রতি সেকেন্ডে পানিপ্রবাহ ছিল ৩ হাজার ৬৮৫ ঘনমিটার। এরপর ১৯৭৫ সালে ফারাক্কা বাঁধ উদ্বোধন করা হয়। বর্তমানে ২০২৪ সালের শুষ্ক মৌসুমে পানিপ্রবাহ নেমে এসেছে ১০৭৬ ঘনমিটারে। ফলে ৫০ বছরে প্রবাহ কমেছে ২৬০৯ ঘন মিটার। গড়ে ৭১ শতাংশ পানির প্রবাহ কমেছে। বর্তমানে প্রবাহ আছে মাত্র ২৯ শতাংশ।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, বাংলাদেশে পদ্মার প্রবেশদ্বারেই যতদূর চোখ যায় চোখে পড়ে কেবলই ধু-ধু বালুচর। শুষ্ক মৌসুমের আগেই পদ্মায় নৌকা চলাচলের পথরুদ্ধ হওয়ায় মাইলের পর মাইল হেঁটে বালিচর পাড়ি দিয়ে গন্তব্যে পৌঁছাতে হচ্ছে চরবাসীকে। আর মালামাল পরিবহনে দরকার পড়ছে গরুর গাড়ি। পদ্মা নদীতে পানি নেই, মাছ নেই। তাই রাজশাহী অঞ্চলের হাজার হাজার জেলে বেকার হয়ে পড়েছেন। অনেকে বাধ্য হয়ে বাপ-দাদার পুরোনো পেশা ছেড়ে দিচ্ছেন।
রাজশাহীর গোদাগাড়ী এলাকার বাসিন্দা নুরুল ইসলাম বলেন, আগের মতো পদ্মাতো নেই। এখন কী করার। কষ্ট করে হেঁটেই চরে যেতে হয়। নৌকার মাঝিরাও এখন পেশা বদলাচ্ছে। শান্ত আলী একজন মৎস্যজীবী। একসময় তিনি জীবিকার জন্য পদ্মা নদীর ওপর নির্ভর করতেন। তিনি কয়েক দশক ধরে নদীর জলপথে নৌকা চালিয়ে, জাল ফেলে মাছ ধরতেন এবং সংসার চালাতেন। তবে নদীতে মাছের পরিমাণ ধীরে ধীরে কমে যাওয়ায় তাকে তার ঐতিহ্যবাহী পেশা ত্যাগ করতে হয়েছে এবং জীবিকা নির্বাহের জন্য নতুন পথ খুঁজতে হয়েছে। তিনি বলেন, নদী এখন আর আগের মতো নেই। পদ্মা নদীর জলপ্রবাহ এবং পানির স্তরের সঙ্গে মাছের মজুতও ব্যাপকভাবে কমে গেছে। আমরা আগে পরিবার চলানোর জন্য পর্যাপ্ত মাছ ধরতে পারতাম, কিন্তু এখন সেটা সম্ভব নয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফরাক্কা ব্যারেজের কারণে পদ্মা নদীর জলপ্রবাহ ধীরে ধীরে কমছে। এতে বাংলাদেশে একাধিক সমস্যা সৃষ্টি করেছে। যেমন বারবার বন্যা, পানি সংকট, তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি।
২০২৬ সালে ভারতের সঙ্গে গঙ্গা জলবণ্টন চুক্তি শেষ হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন আগামীতে দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের একটি বড় অংশ ধীরে ধীরে মরুকরণে চলে যেতে পারে। যদি আন্তর্জাতিক পানি-বণ্টন চুক্তি কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন না হয় এবং বর্ষায় পানি সংরক্ষণে বিকল্প পানির উৎসের উন্নয়ন না হয় তাহলে পরিস্থিতি খারাপ হবে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মোস্তফিজুর রহমান বলেন, তিনি কিছু ভারতীয় গবেষকের সঙ্গে ফরাক্কা ব্যারেজের প্রভাব নিয়ে একটি গবেষণা করেছেন। গবেষণায় নদীর প্রবাহ এবং পানির স্তরের বিষয়ে ভবিষ্যৎ যা অনুধাবন করেছিলেন, ২০২৪ সালে তা আরও অনেক বেশি কমে গেছে। তিনি আরও বলেন, নদী ছোট হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পানি প্রবাহ কমে যাওয়ার কারণে নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাচ্ছে, যা ধীরে ধীরে নদীটির তলদেশ পূর্ণ করে ফেলছে। এর ফলে বর্ষার মৌসুমে বারবার বন্যা হচ্ছে, কারণ নদী অতিরিক্ত পানি ধারণ করতে পারছে না। অপরদিকে নদী শুকিয়ে যাচ্ছে এবং দীর্ঘমেয়াদী খরা সৃষ্টি হচ্ছে, যা কৃষি, জীববৈচিত্র্য এবং স্থানীয় জীবিকা বিপর্যস্ত করছে।
তিনি আরও বলেন, যদি দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তাহলে বাংলাদেশ ভবিষ্যতে একটি বিধ্বংসী পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে পারে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব ও খণিজবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক সারওয়ার জাহান বলেছেন, ফরাক্কা ব্যারেজের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো পানির অভাব। পদ্মা নদীর পানির স্তর কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এর সংযুক্ত নদীগুলো যেমন মহানন্দা, আত্রাই, পুনর্ভবা ও বার্নাই নদীও পানিহীন হয়ে পড়ছে। নদী গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী জানান, ফারাক্কা ব্যারেজের কারণে উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের প্রায় ৮ কোটি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কারণ বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে তার নির্ধারিত পানি শেয়ার থেকে বঞ্চিত হয়েছে।