সরবরাহ স্বাভাবিক, তবুও অস্থির কাঁচাবাজার

- আপডেট সময় : ০১:০৩:২৭ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৮ মে ২০২৫ ৭ বার পড়া হয়েছে
-
মসলার দাম নাগালের বাইরে
-
মধ্যস্বত্বভোগীদের কারসাজি
-
কৃষক ন্যায্য পাওনা বঞ্চিত
-
ভোক্তারা দিচ্ছেন বাড়তি দাম
চাল, পেঁয়াজ, আদা, রসুন, মসলা, এলাচ ও তেলের মতো নিত্যপণ্যের যথেষ্ট সরবরাহ থাকা সত্ত্বেও বাড়ছে দাম। নিত্যপণ্যের দামের উর্ধ্বগতির কারণে কাঁচাবাজারে অস্থিরতা বিরাজ করছে। মাসের ব্যবধানে এসব পণ্যের দাম ৩ টাকা থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)। বাজার তদারকি এবং নজরদারির অভাবেই এ অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে বলে মনে করছে সংগঠনটি।
রমজান মাসে বাজার কিছুটা নিয়ন্ত্রণে থাকলেও এরপরই শুরু হয়েছে নতুন করে দাম বাড়ার প্রবণতা। চাল, ডাল, তেল, মাছ, মসলা, সবজি-সবই এখন মধ্যবিত্তের জন্য হয়ে উঠেছে হিসেব কষে কেনার পণ্য। অনেকের জন্য তা একরকম বিলাসও বটে। অভিযোগ রয়েছে, আড়তদারদের দাপট, চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্য, অতিরিক্ত কমিশন ও কারসাজির মাধ্যমে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করা হচ্ছে। অথচ এসব রোধে সরকারের কার্যকর কোনো তৎপরতা নেই।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, মাঝারি মানের চাল মূল্যস্ফীতিতে প্রভাব ফেলেছে ১৬.৭৩ শতাংশ। খাদ্যপণ্যের তালিকায় আরও আছে ইলিশ মাছ ১১.৩৭ শতাংশ, বেগুন ও আলু ১০-১২ শতাংশ, ভোজ্যতেল ৯ শতাংশ এবং মুরগির মাংস ৮.৫ শতাংশ।
খাদ্যপণ্যের পর মূল্যস্ফীতিতে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে ঘরভাড়ার খরচে-১৩.০৯ শতাংশ। এছাড়া পোশাকে ৯.৩৭ শতাংশ, ধূমপান ও অ্যালকোহলে ৭.৪৭ শতাংশ, পরিবহনে ৬.৪০ শতাংশ, শিক্ষা খাতে ৩.৮৩ শতাংশ এবং আসবাবপত্রে ৩.৬২ শতাংশ প্রভাব রয়েছে।
শুধু রাজধানীতে নয়, খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি গ্রামের মানুষের জীবনেও মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। শহরাঞ্চলে মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর অবস্থা আরও সংকটাপন্ন, বিশেষ করে যেসব পরিবারে একাধিক সন্তান রয়েছে। তাদের মাসিক খরচ নিয়ন্ত্রণে রাখা এখন কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়েছে। রাজধানীতে আয়ের বড় একটি অংশই চলে যাচ্ছে ঘর ভাড়ার পেছনে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সরবরাহে বড় ঘাটতি নেই, কিন্তু বাজার ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা রয়েছে। মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য ও সিন্ডিকেটের কারণে দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে।
গতকাল শুক্রবার রাজধানীর কাওরান বাজার ও উত্তর বাড্ডা বাজার ঘুরে দেখা যায়, মধ্যবিত্তের আটাশ চালের ৫০ কেজির বস্তা ২ হাজার ৮০০ টাকা থেকে ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত। বিভিন্ন নামে বিক্রি হওয়া মিনিকেট; ৫০ কেজির বস্তা ৩ হাজার ৫০০ থেকে ৪ হাজার টাকা উপরে বিক্রি হচ্ছে। খুচরা দোকানে আটাশ চালের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৬৫ টাকা এবং মিনিকেট ৭৮ থেকে ৮৫ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। সরেজমিনে পাঁচ লিটার সয়াবিন তেলের বোতল এখন দোকানে নেই বললে চলে। যেসব দোকানে পাওয়া যাচ্ছে, সেখানে পাঁচ লিটারের বোতল বিক্রি হচ্ছে ৯২০ টাকায় এবং এক লিটারের বোতল বিক্রি হচ্ছে ১৯০ টাকায়। পেঁয়াজ প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৫৫ থেকে ৬০ টাকা পর্যন্ত।
একই চিত্র মুরগি ও মাংসের বাজারেও। গত সপ্তাহের তুলনায় গরুর মাংসের দাম বেড়েছে ৫০ টাকা পর্যন্ত এবং মুরগির দাম ১০ থেকে ২০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। সোনালি, লাল লেয়ার ও দেশি মুরগির দাম বেড়েছে। প্রতি কেজি গরুর মাংস আগে বিক্রি হতো ৭৫০ টাকায়, এখন বিক্রি হচ্ছে ৭৮০ থেকে ৮০০ টাকা পর্যন্ত। সোনালি মুরগি বিক্রি হচ্ছে ২৭০-২৮০ টাকায়। তবে ব্রয়লার এখনও আগের ১৭০-১৮০ টাকাতেই বিক্রি হচ্ছে।
এছাড়া প্রতি কেজি দেশি মুরগি ৬৫০-৭০০ টাকা, সাদা লেয়ার ২৮০ টাকা ও লাল লেয়ার বিক্রি হচ্ছে ৩০০ টাকায়। জাতভেদে প্রতি পিস হাঁস বিক্রি হচ্ছে ৬০০-৭০০ টাকায়। ডিমের দামও ঊর্ধ্বমুখী। প্রতি ডজনে ১০ টাকা পর্যন্ত বেড়ে, লাল ডিম ১৩০-১৪০ টাকা, সাদা ডিম ১২০-১২৫ টাকা, হাঁসের ডিম ১৮০-২০০ টাকা ও দেশি মুরগির ডিম ২২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
ডিম ব্যবসায়ী রফিক মিয়া বলেন, গত বছর এ সময় ডিমের দাম আরও বেশি ছিল। তীব্র গরমে অনেক খামারে মুরগি মারা যাওয়ায় বাজারে সরবরাহ কমেছে। তাই কিছুটা দাম উঠানামা করছে। যদি সরবরাহ ঠিক থাকে তাহলে ডিমের দাম কমতে পারে।
বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিএ) সভাপতি জানান, তীব্র তাপপ্রবাহে হিটস্ট্রোকে প্রান্তিক খামারগুলোতে ৫ থেকে ১০ শতাংশ মুরগি মারা গেছে। ফলে ৭০ হাজার খামারির প্রতিদিন ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা করে ক্ষতি হয়েছে। দিনে ৫০ হাজার টাকা ধরে গত এক মাসে প্রান্তিক খামারিদের লোকসান দাঁড়ায় ৩০০ কোটি টাকায়। তবে ভিন্ন চিত্র সবজির বাজারে। গেল কয়েক সপ্তাহ ধরে সবজির দাম বাড়তি থাকলেও এখন কিছুটা কমেছে। ৭০-৮০ টাকার ঘরে থাকা সবজির দাম নেমে এসেছে ৫০-৬০ টাকায়।
প্রতি কেজি বরবটি ৬০ টাকা, শসা ৬০, করলা ৫০, মুলা ৫০, লম্বা বেগুন ৭০, গোল বেগুন ৮০, পটল ৬০, ঢেঁড়স ৫০, টমেটো ৬০, কাঁকরোল ৮০, ধন্দুল ৬০, চিচিঙ্গা ৫০, ঝিঙা ৬০, জালি প্রতি পিস ৫০, কলা প্রতি হালি ৫০, লাউ প্রতি পিস ৬০, মিষ্টি কুমড়া প্রতি কেজি ৪০, কঁচুর লতি ৬০, পেঁপে ৭০ এবং কাঁচা মরিচ ৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
কাওরান বাজারের সবজি বিক্রেতা মঞ্জুর আলম বলেন, গত সপ্তাহের তুলনায় এখন সবজির দাম অনেক কম। রমজানে সরবরাহ বেশি থাকায় দাম কম ছিল। তবে ঈদের পর উৎপাদন কম এবং সরবরাহ কম থাকায় দাম কিছুটা বেড়েছিল। সামনে আরও কমতে পারে।
মূল্যস্ফীতি সম্পর্কে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন বলেন, দেশের বাজার ব্যবস্থায় মধ্যস্বত্বভোগীদের কারসাজির কারণে কৃষক ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন এবং ভোক্তারা গুণতে হচ্ছে বাড়তি দাম।
তিনি বলেন, কৃষক উৎপাদন করে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, আর আমরা ভোক্তা হিসেবে দ্বিগুণ দামে কিনতে বাধ্য হচ্ছি। কারণ, মাঝখানে মধ্যস্বত্বভোগীরা পুরো লাভ আত্মসাৎ করছেন। এই দুষ্টচক্র নিয়ন্ত্রণে না আনলে কৃষি খাত ও ভোক্তা-দু’পক্ষই চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) পূর্বাভাস দিয়েছে, চলতি অর্থবছরে গড় মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের কাছাকাছি থাকতে পারে। তবে মজুরি না বাড়ায় কমেছে মানুষের প্রকৃত আয় ও ক্রয়ক্ষমতা, ফলে সাধারণ মানুষ চাপে রয়েছেন।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে, খাদ্যপণ্যের অবদান ৪২.৭১ শতাংশ। এই খাদ্যপণ্যের মধ্যেই সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছে চাল, যার একক প্রভাব ৩৪.১৪ শতাংশ। অর্থাৎ দেশের সামগ্রিক মূল্যস্ফীতির এক-তৃতীয়াংশই চালের কারণে। গত মার্চ মাসে দেশে মূল্যস্ফীতির হার পৌঁছেছে ৮.৯৩ শতাংশে। তবে সংখ্যাটির অন্তরালে আছে এক বড় সত্য-এই মূল্যস্ফীতির প্রায় অর্ধেকই এসেছে খাদ্যপণ্যের লাগামছাড়া দাম থেকে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্রসঙ্গে ক্যাব কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট বলেন, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর উৎপাদনের সঙ্গে সরাসরি জড়িত বললেও বাস্তবে তাদের কার্যকর উপস্থিতি সীমিত। ফলে কৃষক উৎসাহ হারাচ্ছেন। একবার কৃষক পেছনে সরে গেলে, পরের বছর উৎপাদন সংকটে পড়বে, আর তাতে ভোক্তারা আরও ভুগবে। সরকারের উচিত কৃষকের ন্যায্য মূল্য ও ভোক্তার জন্য সহনীয় দাম নিশ্চিত করা। এর জন্য সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সমন্বিত ও কঠোর ভূমিকা প্রয়োজন।
তিনি আরও বলেন, ‘চাঁদাবাজি ও আইন প্রয়োগে দুর্বলতার কারণেই নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে। অনেক সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু সদস্য এসব অপকর্মের সঙ্গে জড়িত থাকায় কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হয় না। আইন প্রয়োগে শিথিলতা থাকলে অপরাধীরা বেপরোয়া হয়ে ওঠে। আজ যে চাঁদাবাজি ছোটভাবে চলছে, কাল তা ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।
আসন্ন ঈদুল আজহাকে ঘিরে মসলার দাম বাড়ার আশঙ্কার প্রসঙ্গে এস এম নাজের হোসাইন বলেন, ‘প্রতিবছরই কোরবানির ঈদের আগে মসলার দাম বাড়ে। এবারও ব্যতিক্রম নয়। পুরনো সিন্ডিকেট নতুন রূপে সক্রিয় হয়েছে। সরকারের নীরবতার সুযোগে তারা বাজার নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। মানুষের পকেট কাটা যেন এখন উৎসবে পরিণত হয়েছে। যেসব চক্র অনিয়মে জড়িত, তারা বারবার সুবিধা পেলেও সরকারের পক্ষ থেকে কোনো কঠোর পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। ফলে তারা আরও উৎসাহী হয়ে উঠেছে। তিনি বলেন, যখন প্রশাসন নীরব থাকে, তখনই এই চক্রগুলো দাম বাড়িয়ে দেয়, আর সাধারণ মানুষের ভোগান্তি বাড়ে। এখনই ব্যবস্থা না নিলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে।