সংবাদ শিরোনাম ::
সোনাইমুড়ী খাদ্য গুদামে ঘুষ ছাড়া ধরে না কৃষকের ধান
অনুপ সিংহ, সোনাইমুড়ী (নোয়াখালী)
- আপডেট সময় : ১৯৮ বার পড়া হয়েছে
নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী উপজেলা খাদ্য গুদামের সামনে বসে কাঁদছেন কৃষক জামাল উদ্দিন। গত ২০ দিন থেকে ৭৫ মন ধান নিয়ে খাদ্য গুদামে ঘুরছেন তবে জমা দিতে পারেননি। ধান বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে গেলে লোকসানের আশঙ্কায় সেটাও পারছেন না। আরেক কৃষক বজরা ইউনিয়নের শিলমুদ গ্রামের আব্দুল কাইয়ুম। তিনিও গত ১ সপ্তাহ থেকে খাদ্য গুদামে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন তবে ধান গুদামে তুলতে পারেননি। খাদ্য গুদামে যেসকল প্রান্তিক কৃষকেরা ধান নিয়ে এসেছেন তাদের অধিকাংশেরই জামাল উদ্দিন আর আব্দুল কাইয়ুম এর মত অবস্থা। স্থানীয় প্রভাবশালী মধ্যসত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য ও খাদ্য গুদামের অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজসে ধান সরকারি গুদামে দিতে পারছেন না বলে অভিযোগ তাদের। এছাড়া পদে পদে হেনস্তার শিকার হয়ে বাধ্য হয়ে ঘুষ-বকশিস দিতে হচ্ছে বলেও অভিযোগ তাদের।
পাপুয়ার কৃষক জাহাঙ্গীর আলম জানান, গত একসপ্তাহ থেকে ধান নিয় গুদামে এসেছেন। আগে সিরিয়াল করে দ্রুত ধান নেওয়ার কথা বলে দারোয়ান কাম অফিস সহকারী কাজী নুরুল ইসলাম তার থেকে দুই হাজার টাকা নিয়েছে। আর প্রতি পদে পদে বকশিষের তো হিসেব নেই। এখন গত দুই দিন থেকে ধান বিক্রির (ওয়েট কোয়ালিটি সার্ভিস সার্টিফিকেট) কাগজের জন্য ঘুরাচ্ছে। বারেবার কাগজের জন্য আসলেও গুরুত্ব দিচ্ছে না।
ভুক্তভোগী কৃষকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, খাদ্য গুদামের গেটের তালা খোলা থেকে শুরু করে ব্যাংকে জমা দেওয়ার রশিদ হাতে নেওয়া পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রে টাকা দিতে হয়। গেট খুলতে বকশিষ দিতে হয় গুদামের গেটম্যানকে। এক কার্ডের ধান দিতে ঘুরতে হয় সপ্তাহের পর সপ্তাহ।
ধান মাপার সময় প্রতি মণে ২-৩ কেজি বেশি দিতে হয়। আদ্রতা বেশি এই অযুহাতে ধান বেশি রেখে দেয় কর্মকর্তারা। এরপরে বস্তাপ্রতি গুদামে ঢুকাতে শ্রমিকদের দিতে হয় ৩০ টাকা। পরে ধান জমা দিয়ে (ওয়েট কোয়ালিটি সার্ভিস সার্টিফিকেট) একাউন্ট পেয়িং হাতে পেতে অফিস সহকারীকে খুশি করতে হয়। এভাবে প্রতি পায়ে পায়ে কৃষকদের টাকা দিতে হয়। আর স্থানীয় মৌসুমি ব্যবসায়ী দালালেরা তো আছেই। তাদের দাপটে সাধারণ কৃষকেরা ধান দেওয়ার সিরিয়াল পায়না। ঘুরতে হয় দিনের পর দিন।
খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, থেকে গত ১৩ এপ্রিল অভ্যান্তরীন বোরো সংগ্রহ উপজেলাওয়ারী লক্ষ্যমাত্রা বিভাজন অনুমোদন দেয়। নোয়াখালীর সোনাইমুড়ীতে ৭৫৬ মেট্রিক টন ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। তারই ধারাবাহিকতায় সোনাইমুড়ীতে গত ৬ মে আনুষ্ঠানিক ভাবে বোরো ধান সংগ্রহের উদ্বোধন করেন উপজেলা ধান সংগ্রহ কমিটির সভাপতি ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাছরিন আকতার। আর গত ৮ মে সরকার সোনাইমুড়ী উপজেলায় ধানের মূল্য পরিশোধের লক্ষ্যে উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের দপ্তরে ৪৩ লাখ ৫২ হাজার ৪০০ টাকা বরাদ্দ দেয় খাদ্য মন্ত্রণালয়। তবে উদ্বোধনের দিন থেকে শুরু করে মৌসুমি ব্যবসায়ী বা ব্যাপারিদের দাপটে ধান বিক্রি করতে হয়রানির শিকার হচ্ছেন প্রান্তিক কৃষকেরা। ধান এনে দিনের পর দিন ঘুরে ঘুরে অনেকে হতাশ হয়ে বসে থাকছেন খাদ্য গুদামের সামনে।
সরেজমিনে দেখা যায়, খাদ্য গুদাম চত্বরে বসে আছেন অনেক কৃষক। আর গুদামের ভেতরে ধান মাপা হচ্ছে। প্রতিবেদককে দেখে মুহুর্তের মধ্যে বন্ধ হয়ে যায় গুদামের সকল কার্যক্রম। খাবারের বিরতির নামে গুদাম ঘরে লাগিয়ে দেওয়া হয় তালা। একে একে খাদ্য গুদাম চত্বর থেকে বেরিয়ে যেতে থাকেন মৌসুমি ব্যবসায়ীরা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক মৌসুমী ব্যবসায়ী জানান, প্রতি কৃষকের এক কার্ডে ৩ টন বা ৭৫ মন ধান দিতে পারে গুদামে। এবারে প্রতি মন ধান ১৪৪০ টাকা দিচ্ছে সরকার। তবে মৌসুমি দালালেরা একসাথে ৮-১০ কার্ডের ধান জমা দিচ্ছে। তাদের প্রতি কার্ডে এক হাজার থেকে ১৫০০ টাকা দিতে হয় বড় স্যারকে। বর্তমানে উপজেলার মধ্যে সবচেয়ে বড় মৌসুমি ব্যবসায়ী বারগাঁও ইউনিয়নের রাজিবপুরের জাফর, এরপরে রয়েছেন সোনাইমুড়ী পৌরসভার ৫নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা রতন, বজরা ইউনিয়নের রশিদপুরের মাইনউদ্দিন, সোনাইমুড়ী পৌরসভার কাঠালি এলাকার আলাউদ্দিন, চাষিরহাট ইউনিয়নের পোরকরার মো:সিরাজসহ আরো বেশ কয়েকজন মৌসুমি ব্যাপারীরা নিয়মিত ধান দিচ্ছেন গুদামে। এমনকি রাতের বেলায় বিভিন্ন ব্যাপারীদের ধান তোলা হচ্ছে গুদামে।
অভিযোগ রয়েছে শ্রমিকদের বস্তা প্রতি ৩০ টাকা দিতে হয় কৃষকদের। তবে খাদ্য অদিপ্তরের মহাপরিচালক স্বাক্ষরিত এক পরিপত্রে বলা হয়েছে, সরকারি গুদামে ধান বিক্রি করতে আসা কৃষকদের ধান বস্তাবন্দি, বস্তা সেলাই, ওজন গ্রহণ, বিক্রিত ধান গুদামে তুলে খামালজাতকরণ ইত্যাদি কাজের জন্য কৃষকদের থেকে শ্রমিকগণ কোন অর্থ দাবি করতে পারবে না। শ্রম ও হ্যান্ডেলিং ঠিকাদারগণ সরকার পক্ষের সাথে স্বাক্ষরিত চুক্তি মোতাবেক শ্রমিকদের কাজের বিলের ৭৫-৮০% দৈনন্দিন পরিশোধ করতে বাধ্য থাকবেন। এই নির্দেশ অমান্য করলে ঠিকাদারের জামানত বাজেয়াপ্ত সহ বরখাস্ত করতে পারবে সরকার।
সেই নির্দেশ অমান্য করে গুদামে ধান বিক্রি করতে আসা কৃষকের থেকে প্রতিবস্তায় ৩০ টাকা নিচ্ছেন শ্রমিকেরা। সেই অভিযোগের বিষয়ে কথা হলে শ্রমিক সরবরাহের ঠিকাদার রাজু জানান তিনি গত ৭ বছর থেকে দায়িত্বে রয়েছেন। সরকার প্রতি টনে শ্রমিকদের জন্য দিচ্ছে ৭০ টাকা। যা দিয়ে শ্রমিক চালানো সম্ভব নয়। আর একারনে শ্রমিকরা কৃষকদের থেকে বস্তাপ্রতি ৩০ টাকা নিচ্ছেন। আর এই অনিয়ম শুধু সোনাইমুড়ী নয় সব খাদ্য গুদামে চলছে। আর এই টাকার ভাগ খাদ্য গুদামের কর্মকর্তা থেকে শুরু করে অনেক উপর পর্যন্ত পৌছায় বলেও জানান তিনি।
শ্রমিকেরা জানান সরকারি ভাবে তাদেরকে কোন বেতন দেয়না ঠিকাদার। এখান থেকে যা পান সেটা দিয়েই সংসার চলে। উল্টে কৃষকদের থেকে নেওয়া ৩০ টাকার ভাগ দিতে হয় গুদামে কর্মকর্তা ইমরান হোসেন তালুকদার ও তাদের সর্দারকে। ৩০ টাকার মধ্যে ১২ টাকা পায় শ্রমিক। বাকি ১৮ টাকার ১৫ টাকা দিতে হয় গুদামের বড় স্যারকে ও তিনটাকা দিতে হয় সর্দারকে।
কৃষক হয়রানি, মৌসুমি ব্যবসায়ীদের থেকে ধান গ্রহণ, আদ্রতার অযুহাতে প্রতি মনে ২-১ কেজি করে অতিরিক্ত ধান নেওয়া ও শ্রমিকদের মাধ্যমে প্রতি বস্তায় কৃষকদের থেকে ৩০ টাকা নেওয়ার অভিযোগের বিষয়ে কথা হয় সোনাইমুড়ী খাদ্য গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ইমরান হোসেন তালুকদারের সাথে। তিনি জানান, মৌসুমি ক্রেতাদের থেকে ধান নেওয়ার সুযোগ নেই। কৃষি অফিসের দেওয়া কৃষক তালিকার বাইরে ধান নেওয়া হচ্ছে না। কৃষকদের বস্তা প্রতি ৩০ টাকা নেওয়ার নিয়ম রয়েছে বলে দাবি করেন তিনি। তবে শ্রমিকদের নেওয়া টাকার ভাগ নেওয়ার অভিযোগটি তিনি অস্বীকার করেন।
এসকল অভিযোগের বিষয়ে নোয়াখালী জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘কৃষকদের বাদ দিয়ে মৌসুম ক্রেতাদের থেকে ধান নেওয়ার সুযোগ নেই। ধান সংগ্রহের জন্য এখনো অনেক সময় রয়েছে রাতের বেলায় ধান গুদামে তোলার কোন নিয়ম নেই। দিনের আলোতে ধান দেখে, আদ্রতা মেপে ধান তুলতে হবে গুদামে। নিদ্রিষ্ট পরিমানের চেয়ে আদ্রতা বেশি থাকলে মাপের অতিরিক্ত ধান নেওয়া যাবে না। এছাড়া কৃষকেদের থেকে বস্তাপ্রতি কোন টাকা নিতে পারবে না শ্রমিকরা। এসব কাজের জন্য সরকার ঠিকাদারের মাধ্যমে শ্রমিকদের মজুরি পরিশোধ করেছে। তিনি এই সকল অভিযোগের প্রমান প্রতিবেদকের কাছ থেকে দেখেন। সেই সাথে সরেজমিনে নিজে গিয়ে তদন্তের মাধ্যমে ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দেন।



















