সোমপুর মহাবিহার যেভাবে পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার
- আপডেট সময় : ১০ বার পড়া হয়েছে
সময়ের পরিক্রমায় সোমপুর মহাবিহার যেভাবে পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার। ইউনেসকো ঘোষিত বিশ্বের ৭৫০টি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মধ্যে পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার ঐতিহাসিক বাংলাদেশের একটি গৌরবময় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য।
সোমপুর মহাবিহার
আজ থেকে প্রায় ১২০০ বছর আগে সম্রাট ধর্মপাল কর্তৃক নির্মিত হয়েছিল সোমপুর মহাবিহার। তিব্বতীয় তথ্য সূত্রে জানা যায়, সোমপুর মহাবিহার ছাড়াও জগদ্বিখ্যাত নালন্দা, ওদন্তপুর, বিক্রমশীল ও জগদ্দল মহাবিহার পরিচালিত হতো পাল রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায়। আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো এসব বৌদ্ধবিহারে দেশ-বিদেশের শিক্ষক-শিক্ষার্থী বৌদ্ধধর্ম ও দর্শন ছাড়াও চিকিৎসাবিজ্ঞান, রসায়ন, জ্যোতির্বিদ্যা, কৃষিপ্রযুক্তি, গণিত প্রভৃতি চর্চা করতেন। কিন্তু ১২ শতক থেকে নানান কারণে সোমপুর মহাবিহারের যশ-খ্যাতি কমতে শুরু করে এবং ধীরে ধীরে লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যায় এই প্রতিষ্ঠানটি। বর্তমান নওগাঁ জেলার বদলগাছী উপজেলার ঐতিহাসিক পাহাড়পুর ইউনিয়নের সমতল ভূমিতে একটি ঢিবিতে পরিণত হয় জগদ্বিখ্যাত সোমপুর (চাঁদের শহর) মহাবিহার (উচ্চমার্গের মঠ)। সমতল ভূমি থেকে প্রায় ৮০ ফুট উঁচু ঢিবি স্থানীয় লোকজনের কাছে পাহাড় সমতুল্য মনে হতো, তাই তাঁদের কাছে এর আধুনিক নাম হয় পাহাড়পুর। প্রত্নতাত্ত্বিক খননে পাহাড়পুরে আবিষ্কৃত হয় উপমহাদেশের একক সর্ববৃহৎ বৌদ্ধবিহার। ২৭৪ মি: ২৭৪ মি: বর্গাকৃতি পরিকল্পনায় ৪টি বাহুতে ১৭৭টি ভিক্ষুকোঠা নির্মিত হয়েছিল সোমপুর মহাবিহারে। অধিকাংশ ভিক্ষুকোঠার মেঝেতে নিরেট মঞ্চ, মূর্তিধারক ফোকর ও কুলুঙ্গি ছিল। ভিক্ষুকো ঠাগুলোর সামনে ছিল লম্বা টানা বারান্দাও। বারান্দাটার মাঝখানে ছিল অসাধারণ এক মন্দির। ক্রুশাকৃতির মন্দির, ভারতীয় বাস্তুশাস্ত্র ও শিল্পশাস্ত্রে সর্বতোভদ্র মন্দির নামে পরিচিত। মন্দিরের তলপত্তন ৬৩টি পাথরের মূর্তি দ্বারা সুশোভিত ছিল(‘তলপত্তন’ বলতে সাধারণত একটি মন্দিরের নিচের ভিত্তি বা স্থাপত্যের মূল কাঠামোকে বোঝায়,বা একটি স্থাপত্যের নিচের স্তরকে নির্দেশ করে)। এটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ যে এদের মধ্যে মাত্র একটি মূর্তি বৌদ্ধ, বাকি ৬২টি হিন্দুধর্মাবলম্বীদের। প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে,পঞ্চম শতকের একটি জৈন বিহারের ওপর পাল আমলের বৌদ্ধবিহারটি নির্মিত হয়েছিল।
১৯৮৫ সালে ইউনেসকো ‘পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার ধ্বংসাবশেষ’ নামে সোমপুর মহাবিহারকে বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে। ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনুধাবন না করে আবিষ্কৃত বিহারের নামকরণ করা হয়েছে ‘পাহাড়পুর বিহার’। প্রাচীন লিপিতে বিহারের নাম ‘সোমপুর মহাবিহার’ সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ থাকলেও শুধু স্থান নাম বিবেচনায় পাহাড়পুর বিহার নামকরণ যৌক্তিক নয়। পেশাদার প্রত্নতাত্ত্বিক ও সংরক্ষণবিদের অভাবে সোমপুর মহাবিহারের সংরক্ষণ ‘যথাবস্থায় মেরামত’ প্রত্নতত্ত্বের নীতিমালা অনুযায়ী সম্পন্ন হয়নি। বিশ্ব ঐতিহ্যের অন্তর্ভুক্তির পর পাহাড়পুর বিহারের সংরক্ষণ কাজে অনেক অর্থ ব্যয় করা হয়েছে সত্য, কিন্তু সার্বিকভাবেই অবস্থার উন্নতির চেয়ে অবনতি হয়েছে আরও বেশি । সিমেন্ট, নয়া ইট, নয়া পোড়ামাটির ফলক ইত্যাদি ব্যবহার বিধিতে যোগ করে প্রাচীন বৌদ্ধবিহারের আদি বৈশিষ্ট্য খর্ব করা হয়েছে অনেকাংশেই। জলাবদ্ধতা, লবণাক্ততা প্রভৃতি সমস্যাও প্রকট আকার ধারণ করেছে। মিলিয়ন বিলিয়ন টাকা ব্যয় হয় ঠিকই কিন্তু কাজের কাজ হয় না মোটেও। প্রজেক্ট বিবেচনায় অনেকের কাছে পাহাড়পুর বিহার যেন শিয়ালের কাছে মুরগী আদি দেওয়ার।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধি,সচেতনমহল এবং ভ্রমনে আসা দেশি-বিদেশি পর্যটকরা সম্মিলিতভাবে একমত প্রকাশ করে বলেন, প্রাচীন লিপিতে বিহারের নাম ‘সোমপুর মহাবিহার’ সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ থাকলেও শুধু স্থান নাম বিবেচনায় পাহাড়পুর বিহার নামকরণ যৌক্তিক নয়। সুতরাং ‘সোমপুর মহাবিহার’ নামকরণই যৌক্তিক। সে কারণে বর্তমান নাম করন সংশোধন করে আদি নামে ফিরে যাওয়ায় ইতিহাসের মূলভিত্তি।



















