ঢাকা ০৪:১৭ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৮ জুন ২০২৫

শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব প্রকল্পে দুর্নীতি- ১

স্বাক্ষর জালিয়াতি ও ভুয়া ডিও লেটারে সরকারি অর্থ লোপাট

স্টাফ রিপোর্টার
  • আপডেট সময় : ১০:২৪:২১ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৭ জুন ২০২৫ ২১ বার পড়া হয়েছে
দৈনিক গনমুক্তি অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

ল্যাব স্থাপন সংক্রান্ত কাজের নামে যেসব ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে অর্থ প্রদান করা হয়েছে, তাদের অনেকেই অস্তিত্বহীন। কিছু প্রতিষ্ঠান আবার প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের আত্মীয় কিংবা ঘনিষ্ঠজনের নামে খোলা হয়, যাতে টাকা সহজেই ভাগাভাগি করা যায়

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) অধিদপ্তরের আওতাধীন শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব স্থাপন প্রকল্পে ভয়াবহ আর্থিক দুর্নীতির চিত্র উদঘাটিত হয়েছে। অডিট ও তদন্ত প্রতিবেদনের বরাতে জানা গেছে, প্রকল্প পরিচালকসহ পাঁচজন কর্মকর্তার একটি চক্র ভুয়া ডিও (ডেম্যান্ড অর্ডার) লেটার তৈরি করে প্রায় ২০০ কোটি টাকা লোপাট করেছে। পুরো ঘটনা সংঘটিত হয়েছে ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে।
প্রকল্পের প্রাক্তন ও বর্তমান কর্মকর্তাদের মধ্যে অন্যতম অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা প্রকল্প পরিচালক মির্জা মুরাদ হাসান বেগ, সহকারী প্রোগ্রামার শরিফুল ইসলাম, সহকারী প্রোগ্রামার মোঃ জাহিদুল ইসলাম, সহকারী প্রোগ্রামার মোঃ মাহবুবুর রহমান, অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা হিসাবরক্ষক মোঃ আনিছুর রহমান সহ আরো বেশ কয়েকজন।
বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়, এই কর্মকর্তারা হাজার হাজার ভুয়া ডিও লেটার তৈরি করে কোনো ল্যাব স্থাপন না করেই সরকার থেকে কোটি কোটি টাকা উত্তোলন করে আত্মসাৎ করেন। অডিট বিভাগ এসব ডিও লেটার দেখতে চাইলে, তা চক্রটি গায়েব করে দেয় বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
বিশেষ করে হিসাবরক্ষক মোঃ আনিছুর রহমান এবং সহকারী প্রোগ্রামার মোঃ মাহবুবুর রহমান-এর বিরুদ্ধে স্বাক্ষর জালিয়াতি ও কাগজপত্র ভুয়া করার সুস্পষ্ট অভিযোগ রয়েছে। সরোজমিন অনুসন্ধানে দেখা গেছে, প্রকল্পে ঘোষিত ২০০-৩০০ কোটি টাকার কাজ বাস্তবে হয়নি বললেই চলে। শুধুমাত্র কাগজে-কলমেই পরিচালিত হয়েছে পুরো প্রকল্প।
সবচেয়ে বিস্ময়কর বিষয় হলো, এত বড় দুর্নীতির পরও অভিযুক্তরা এখনো বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় কর্মরত রয়েছেন, কারো বিরুদ্ধে দৃশ্যমান শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। সংশ্লিষ্টদের দাবি, ফ্যাসিস্ট সরকারের ছত্রচ্ছায়ায় গত তিন বছরেই এই চক্র আরও ৫০০ কোটি টাকার দুর্নীতি করেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। দ্রুত তদন্ত এবং অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে দেশের আইসিটি খাতে জনগণের আস্থা ভেঙে পড়বে বলে মত প্রকাশ করেছেন দুর্নীতি বিরোধী সংগঠনগুলো।
এই দুর্নীতির ঘটনা নিয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের ভেতরে-বাইরে নানামুখী চাপ ও আলোচনা চললেও এখন পর্যন্ত আইসিটি অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে কোনও আনুষ্ঠানিক বিবৃতি বা অভ্যন্তরীণ তদন্ত কমিটির খবর প্রকাশ করা হয়নি। বরং একাধিক বিশ্বস্ত সূত্র জানিয়েছে, ঘটনাটি ধামাচাপা দিতে ভেতরে ভেতরে প্রভাবশালী মহল তৎপর হয়ে উঠেছে।
অভিযোগ রয়েছে, প্রকল্পের আর্থিক ছাড়, ভুয়া ডিও লেটারের অনুমোদন এবং বিল পরিশোধের ক্ষেত্রে যে-যে বিভাগে কাগজপত্র যাচাইয়ের কথা, সেখানে চক্রটি সিন্ডিকেট গড়ে তোলে। ডিজিটাল ল্যাব স্থাপন, কম্পিউটার সরবরাহ, প্রশিক্ষণ বা অবকাঠামোগত কোনো কাজই বাস্তবায়ন হয়নি— কিন্তু বিল উঠেছে শত কোটি টাকার!
অভিযোগ রয়েছে, ল্যাব স্থাপন সংক্রান্ত কাজের নামে যেসব ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে অর্থ প্রদান করা হয়েছে, তাদের অনেকেই অস্তিত্বহীন। কিছু প্রতিষ্ঠান আবার প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের আত্মীয় কিংবা ঘনিষ্ঠজনের নামে খোলা হয়, যাতে টাকা সহজেই ভাগাভাগি করা যায়। স্থানীয় পর্যায়ে তদন্তে উঠে আসে, বেশিরভাগ উপজেলার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাবের কোনও কার্যক্রমই দৃশ্যমান নয়। অনেক শিক্ষক ও প্রতিষ্ঠান প্রধান জানিয়েছেন, “ডিজিটাল ল্যাবের নাম শুনেছি, কিন্তু আমাদের এখানে কোনো সরঞ্জাম কিংবা লোকই আসেনি।
বিশ্লেষকদের মতে, এটা শুধুমাত্র আর্থিক নয়, বরং প্রযুক্তি শিক্ষাকে ধ্বংস করে দেওয়ার এক গভীর ষড়যন্ত্র। এর ফলে শিক্ষার্থীরা আধুনিক প্রযুক্তির সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছে, যা দীর্ঘমেয়াদে দেশের ডিজিটাল উন্নয়নকে পিছিয়ে দেবে।
দাবি উঠেছে- ১. অবিলম্বে সকল ডিও লেটারের ডিজিটাল কপি সংগ্রহ ও যাচাই করা হোক।
২. অভিযুক্তদের সাময়িক বরখাস্ত করে বিভাগীয় এবং ফৌজদারি তদন্ত শুরু হোক। ৩. দুর্নীতির শিকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর তালিকা প্রকাশ করে ক্ষতিপূরণ ও প্রকৃত ল্যাব স্থাপনের ব্যবস্থা হোক। ৪. প্রকল্পটির জন্য দায়ী উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সম্পদের হিসাব তদন্ত করা হোক। দুর্নীতির এমন নজিরবিহীন ঘটনার পরও যদি ন্যায়বিচার না হয়, তবে দেশের ডিজিটাল শিক্ষা প্রকল্পের ভবিষ্যৎ অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে বলেই মনে করছেন সচেতন নাগরিক সমাজ।

নিউজটি শেয়ার করুন

ট্যাগস :

শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব প্রকল্পে দুর্নীতি- ১

স্বাক্ষর জালিয়াতি ও ভুয়া ডিও লেটারে সরকারি অর্থ লোপাট

আপডেট সময় : ১০:২৪:২১ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৭ জুন ২০২৫

ল্যাব স্থাপন সংক্রান্ত কাজের নামে যেসব ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে অর্থ প্রদান করা হয়েছে, তাদের অনেকেই অস্তিত্বহীন। কিছু প্রতিষ্ঠান আবার প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের আত্মীয় কিংবা ঘনিষ্ঠজনের নামে খোলা হয়, যাতে টাকা সহজেই ভাগাভাগি করা যায়

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) অধিদপ্তরের আওতাধীন শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব স্থাপন প্রকল্পে ভয়াবহ আর্থিক দুর্নীতির চিত্র উদঘাটিত হয়েছে। অডিট ও তদন্ত প্রতিবেদনের বরাতে জানা গেছে, প্রকল্প পরিচালকসহ পাঁচজন কর্মকর্তার একটি চক্র ভুয়া ডিও (ডেম্যান্ড অর্ডার) লেটার তৈরি করে প্রায় ২০০ কোটি টাকা লোপাট করেছে। পুরো ঘটনা সংঘটিত হয়েছে ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে।
প্রকল্পের প্রাক্তন ও বর্তমান কর্মকর্তাদের মধ্যে অন্যতম অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা প্রকল্প পরিচালক মির্জা মুরাদ হাসান বেগ, সহকারী প্রোগ্রামার শরিফুল ইসলাম, সহকারী প্রোগ্রামার মোঃ জাহিদুল ইসলাম, সহকারী প্রোগ্রামার মোঃ মাহবুবুর রহমান, অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা হিসাবরক্ষক মোঃ আনিছুর রহমান সহ আরো বেশ কয়েকজন।
বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়, এই কর্মকর্তারা হাজার হাজার ভুয়া ডিও লেটার তৈরি করে কোনো ল্যাব স্থাপন না করেই সরকার থেকে কোটি কোটি টাকা উত্তোলন করে আত্মসাৎ করেন। অডিট বিভাগ এসব ডিও লেটার দেখতে চাইলে, তা চক্রটি গায়েব করে দেয় বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
বিশেষ করে হিসাবরক্ষক মোঃ আনিছুর রহমান এবং সহকারী প্রোগ্রামার মোঃ মাহবুবুর রহমান-এর বিরুদ্ধে স্বাক্ষর জালিয়াতি ও কাগজপত্র ভুয়া করার সুস্পষ্ট অভিযোগ রয়েছে। সরোজমিন অনুসন্ধানে দেখা গেছে, প্রকল্পে ঘোষিত ২০০-৩০০ কোটি টাকার কাজ বাস্তবে হয়নি বললেই চলে। শুধুমাত্র কাগজে-কলমেই পরিচালিত হয়েছে পুরো প্রকল্প।
সবচেয়ে বিস্ময়কর বিষয় হলো, এত বড় দুর্নীতির পরও অভিযুক্তরা এখনো বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় কর্মরত রয়েছেন, কারো বিরুদ্ধে দৃশ্যমান শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। সংশ্লিষ্টদের দাবি, ফ্যাসিস্ট সরকারের ছত্রচ্ছায়ায় গত তিন বছরেই এই চক্র আরও ৫০০ কোটি টাকার দুর্নীতি করেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। দ্রুত তদন্ত এবং অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে দেশের আইসিটি খাতে জনগণের আস্থা ভেঙে পড়বে বলে মত প্রকাশ করেছেন দুর্নীতি বিরোধী সংগঠনগুলো।
এই দুর্নীতির ঘটনা নিয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের ভেতরে-বাইরে নানামুখী চাপ ও আলোচনা চললেও এখন পর্যন্ত আইসিটি অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে কোনও আনুষ্ঠানিক বিবৃতি বা অভ্যন্তরীণ তদন্ত কমিটির খবর প্রকাশ করা হয়নি। বরং একাধিক বিশ্বস্ত সূত্র জানিয়েছে, ঘটনাটি ধামাচাপা দিতে ভেতরে ভেতরে প্রভাবশালী মহল তৎপর হয়ে উঠেছে।
অভিযোগ রয়েছে, প্রকল্পের আর্থিক ছাড়, ভুয়া ডিও লেটারের অনুমোদন এবং বিল পরিশোধের ক্ষেত্রে যে-যে বিভাগে কাগজপত্র যাচাইয়ের কথা, সেখানে চক্রটি সিন্ডিকেট গড়ে তোলে। ডিজিটাল ল্যাব স্থাপন, কম্পিউটার সরবরাহ, প্রশিক্ষণ বা অবকাঠামোগত কোনো কাজই বাস্তবায়ন হয়নি— কিন্তু বিল উঠেছে শত কোটি টাকার!
অভিযোগ রয়েছে, ল্যাব স্থাপন সংক্রান্ত কাজের নামে যেসব ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে অর্থ প্রদান করা হয়েছে, তাদের অনেকেই অস্তিত্বহীন। কিছু প্রতিষ্ঠান আবার প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের আত্মীয় কিংবা ঘনিষ্ঠজনের নামে খোলা হয়, যাতে টাকা সহজেই ভাগাভাগি করা যায়। স্থানীয় পর্যায়ে তদন্তে উঠে আসে, বেশিরভাগ উপজেলার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাবের কোনও কার্যক্রমই দৃশ্যমান নয়। অনেক শিক্ষক ও প্রতিষ্ঠান প্রধান জানিয়েছেন, “ডিজিটাল ল্যাবের নাম শুনেছি, কিন্তু আমাদের এখানে কোনো সরঞ্জাম কিংবা লোকই আসেনি।
বিশ্লেষকদের মতে, এটা শুধুমাত্র আর্থিক নয়, বরং প্রযুক্তি শিক্ষাকে ধ্বংস করে দেওয়ার এক গভীর ষড়যন্ত্র। এর ফলে শিক্ষার্থীরা আধুনিক প্রযুক্তির সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছে, যা দীর্ঘমেয়াদে দেশের ডিজিটাল উন্নয়নকে পিছিয়ে দেবে।
দাবি উঠেছে- ১. অবিলম্বে সকল ডিও লেটারের ডিজিটাল কপি সংগ্রহ ও যাচাই করা হোক।
২. অভিযুক্তদের সাময়িক বরখাস্ত করে বিভাগীয় এবং ফৌজদারি তদন্ত শুরু হোক। ৩. দুর্নীতির শিকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর তালিকা প্রকাশ করে ক্ষতিপূরণ ও প্রকৃত ল্যাব স্থাপনের ব্যবস্থা হোক। ৪. প্রকল্পটির জন্য দায়ী উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সম্পদের হিসাব তদন্ত করা হোক। দুর্নীতির এমন নজিরবিহীন ঘটনার পরও যদি ন্যায়বিচার না হয়, তবে দেশের ডিজিটাল শিক্ষা প্রকল্পের ভবিষ্যৎ অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে বলেই মনে করছেন সচেতন নাগরিক সমাজ।