হাসিনা হাত ধরে ১ লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ
- আপডেট সময় : ০৮:৩৫:৩৯ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১২৮ বার পড়া হয়েছে
সাড়ে ১৫ বছরে খেলাপি ঋণ নথিপত্রে যতটা বেড়েছে, তা আর্থিক খাতের ভয়ংকর এক চিত্র তুলে ধরছে। এই সময়ে শুধু ব্যাংক খাতেই খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১ লাখ ৮৮ হাজার ৯১০ কোটি টাকা। এই ঋণের বড় অংশই আদায় অযোগ্য। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত জুন মাস শেষে খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ২ লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা
দেশের ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ চলতি বছরের জুন শেষে রেকর্ড দুই লাখ ১১ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। খেলাপি ঋণ গোপন করার সংস্কৃতি থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে করে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধিতে আগের সব রেকর্ড ভেঙে গেছে। এই খেলাপি ঋণের বেশির ভাগ বেড়েছে শেখ হাসিনার সরকারের সর্বশেষ চার আমালে। শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকার গত সাড়ে ১৫ বছর ক্ষমতা থাকাকালীন খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১ লাখ ৮৯ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা।
সাড়ে ১৫ বছরে ঋণখেলাপি ও প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের একের পর এক ছাড় দেয়া হয়েছে। এই ছাড় নীতি বাস্তবায়ন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক দুই গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার ও ফজলে কবির। এসব ছাড় নীতির কারণেই খেলাপি ঋণ বেড়েছে মতামত দেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, বাংলাদেশে খেলাপি ঋণ বাড়ার প্রধান কারণ রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা। এখানে বছরের পর বছর ধরে খেলাপিদের নানা ধরনের ছাড় দেয়া হয়েছে। খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা বদলানো হয়েছে বারবার। আইন সংশোধন করে একাধিকবার ঋণ তফসিলের সুবিধা দেয়া হয়েছে। আর এসব সুযোগ-সুবিধা নিয়েই খেলাপির তালিকা থেকে বড় বড় ঋণখেলাপি বাইরে থেকে গেছেন, হয়েছেন আরও ক্ষমতাবান।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, জুন শেষে ব্যাংক খাতে ঋণ বিতরণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৬ লাখ ৮৩ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়েছে ২ লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা, যা মোট ঋণ বিতরণের ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশ। গত ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ শেখ হাসিনার সরকারের চতুর্থ মেয়াদের ছয় মাসেই খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৬৫ হাজার ৭৫৮ কোটি টাকা। আওয়ামী লীগ গত জানুয়ারিতে টানা চতুর্থবারের মতো সরকার গঠন করে। তবে গত ৫ আগস্ট গণ-আন্দোলনের মুখে আওয়ামী সরকারের পতন হয়।
বর্তমানে সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে। জুন শেষে এসব ব্যাংকে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে এক লাখ দুই হাজার ৪৮৩ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণকৃত ঋণের ৩২ দশমিক ৭৭ শতাংশ। বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে দাঁড়িয়েছে ৯৯ হাজার ৯২১ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণকৃত ঋণের ৭ দশমিক ৯৪ শতাংশ। বিদেশি ব্যাংকগুলোর তিন হাজার ২২৯ কোটি বা ৪ দশমিক ৭৪ শতাংশ এবং বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর ৫ হাজার ৭৫৬ কোটি বা ১৩ দশমিক ১১ শতাংশ।
আইএমএফের ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের জন্য বিভিন্ন শর্ত দিয়েছে সংস্থাটি। তাদের শর্ত মেনে ২০২৬ সালের মধ্যে বেসরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৫ শতাংশের নিচে এবং সরকারি ব্যাংকের ১০ শতাংশের নিচে নামানোর কথা। তবে ঘটছে উল্টোটা। অর্থাৎ খেলাপি ঋণ আরও বেড়েছে। শেখ হাসিনার ক্ষমতার প্রথম পাঁচ বছরে খেলাপি বাড়ে ১৮ হাজার কোটি টাকা শেখ হাসিনার সরকারের প্রথম পাঁচ বছরে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছিল ১৮ হাজার ১০০ কোটি টাকা। ২০০৯ সালে খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮০ কোটি টাকা। ২০১০ সালে তা সামান্য বেড়ে হয় ২২ হাজার ৭১০ কোটি টাকা। ২০১১ সালে খেলাপি ঋণ কিছুটা কমে। ওই বছর শেষে খেলাপি ঋণ কমে হয় ২২ হাজার ৬৪০ কোটি টাকা। ২০১২ সালে খেলাপি ঋণ ২০ হাজার কোটি টাকা বেড়ে হয় ৪২ হাজার ৯০ কোটি টাকা। ২০১৩ সাল শেষে খেলাপি ঋণ দেড় হাজার কোটি টাকা কমে হয় ৪০ হাজার ৫৮০ কোটি টাকা।
দ্বিতীয় মেয়াদের পাঁচ বছরে ৫৩ হাজার কোটি টাকার বেশি আওয়ামী লীগ সরকারের দ্বিতীয় আমলে ব্যাংক খাতে সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ বেড়েছিল। দ্বিতীয় আমলের পাঁচ বছরে খেলাপি ঋণ বাড়ে ৫৩ হাজার ৩৪০ কোটি টাকা। তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সালে ৯ হাজার ৫৮০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ বেড়ে হয় ৫০ হাজার ১৬০ কোটি টাকা। ২০১৫ সালে ৯ হাজার ২৪০ কোটি বেড়ে হয় ৫৯ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। ২০১৬ সালে দুই হাজার ৭৮০ কোটি বৃদ্ধি পেয়ে হয় ৬২ হাজার ১৮০ কোটি টাকা। ২০১৭ সালে ১২ হাজার ১৩০ কোটি বেড়ে হয় ৭৪ হাজার ৩১০ কোটি টাকা। ২০১৮ সালে ১৯ হাজার ৬১০ কোটি বেড়ে দাঁড়ায় ৯৩ হাজার ৯২০ কোটি টাকা। তৃতীয় মেয়াদে পাঁচ বছরে ৫২ হাজার কোটি টাকার বেশি শেখ হাসিনার ক্ষমতার তৃতীয় মেয়াদে পাঁচ বছরে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ বাড়ে ৫২ হাজার ৫৭ কোটি টাকা। তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে মাত্র ৪০০ কোটি বেড়ে হয় ৯৪ হাজার ৩২০ কোটি টাকা। ২০২০ সালে পাঁচ হাজার ৫৯০ কোটি টাকা কমে হয় ৮৮ হাজার ৭৩০ কোটি টাকা। আবার ২০২১ সালে ১৪ হাজার ৫৪০ কোটি বৃদ্ধি পেয়ে হয় এক লাখ তিন হাজার ২৭০ কোটি টাকা। এছাড়া ২০২২ সালে ১৭ হাজার ৩৮৬ কোটি বেড়ে হয় এক লাখ ২০ হাজার ৬৫০ কোটি টাকা। ২০২৩ সালে ২৪ হাজার ৯৭৭ কোটি বেড়ে হয় এক লাখ ৪৫ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা।
চতুর্থ মেয়াদের ছয় মাসেই বেড়েছে ৬৫ হাজার কোটি টাকার বেশি আওয়ামী লীগ গত বছরের জানুয়ারিতে চতুর্থবারের মতো পাঁচ বছরের জন্য সরকার গঠন করে। তবে ছয় মাসের মাথায় গণ-আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশে থেকে পালিয়ে যান। এই সরকারের পতনের আগে জুন পর্যন্ত ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ রেখে যান দুই লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা।
ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ বাড়াতে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা তৈরি করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক দুই গভর্নর। তারা হলেনÑ ফজলে কবির এবং আব্দুর রউফ তালুকদার। সরকার পতনের পর থেকেই পালিয়ে বেড়াচ্ছেন আব্দুর রউফ তালুকদার। অজ্ঞাত স্থান থেকে গত ৯ আগস্ট পদত্যাগ করেন। এই গভর্নর নিয়ম না মেনে এস আলমের ব্যাংকগুলোকে নানারকম সুযোগ তৈরি করে দিয়েছেন। এর মাধ্যমে নামে-বেনামে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যাংক থেকে বের করে নিয়েছে এস আলম গ্রুপ। বর্তমানে এসব ব্যাংকের অবস্থা নাজকু। তাই ব্যাংকগুলোর পর্ষদ ভেঙে দিয়ে এস আলম মুক্ত করেছে নতুন গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর।
রউফের ২ বছরে বাড়ে ৮৬ হাজার কোটি টাকা: পদত্যাগ করা গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের দুই বছরে খেলাপি ঋণ বাড়ে ৮৬ হাজার ১৩৪ কোটি টাকা। ২০২২ সালের ১২ জুলাই দায়িত্ব নেন আব্দুর রউফ তালুকদার। ওই সময় অর্থাৎ ২০২২ সালের জুন শেষে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের আকার ছিল এক লাখ ২৫ হাজার ২৫৭ কোটি টাকা। পদত্যাগের আগে জুনে শেষে খেলাপি রেখে যান ২ লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা। ফজলে কবিরের ৭ বছরে বাড়ে ৬৫ হাজার কোটি টাকার বেশি ফজলে কবির গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব নেন ২০১৬ সালের ২২ মার্চ। ওই সময় ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৫৯ হাজার ৪১১ কোটি টাকা। তার দুই মেয়াদের দায়িত্ব শেষ হয় ২০২২ সালের ৩ জুলাই। অবসরে যাওয়ার আগে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ দাঁড়ায় এক লাখ ২৫ হাজার ২৫৭ কোটি টাকা। তার দুই মেয়াদে সবচেয়ে বেশি ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৬৫ হাজার ৮৪৬ কোটি টাকা।
ঋণখেলাপিদের যত সুবিধা ২০০৯ সালে সরকার গঠন করার পর শুরুতে আন্তর্জাতিক মান অনুসরণ করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। যেমন, ২০১২ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক সার্কুলার জারি করে বলেছিল, কোনোভাবেই তিনবারের বেশি ঋণ পুনঃতফসিল করা যাবে না। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক নীতিমালাটিও ধরে রাখতে পারেনি। প্রভাবশালীদের তদবির ও চাপে পিছু হটে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা পরিবর্তন করে তিন মাস সময় বাড়িয়ে দেয়া হয়।
প্রভাবশালী ঋণখেলাপি ব্যবসায়ীদের রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার সবচেয়ে বড় ঘটনা ঘটে ২০১৫ সালে। সে সময় খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের বিশেষ এক স্কিম হাতে নেয়া হয়। তখন নিয়ম ছিল তিনবারের বেশি ঋণ পুনঃতফসিল করা যায় না। কিন্তু বেশির ভাগ প্রভাবশালী উদ্যোক্তাই তিনবার সুযোগটি নিয়েও খেলাপি হয়ে পড়েছিলেন। এরপরেই ঋণ পুনর্গঠন নামে নতুন এক সুবিধা দেয়া হয়।
ওই সুবিধার আওতায় দেশের বড় ১১টি শিল্প গ্রুপের প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ পুনর্গঠন করা হয়েছিল। তারপরও এসব গ্রুপের বেশির ভাগই ঋণের কিস্তি আর পরিশোধ করেনি।
২০১৮ সালে খেলাপি ঋণের সংজ্ঞার আবার বদল হয়। ঋণ পরিশোধের সময় আরও তিন মাস বাড়ানো হয়। একই সময় ঋণ অবলোপন বা রাইট অফের ক্ষেত্রেও বিশেষ ছাড় দেয়া হয়। তবে ২০১৯ সালে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল দেশের ইতিহাসে ঋণখেলাপিদের জন্য সবচেয়ে বড় সুবিধাটি দেন। সে সময় দুই শতাংশ কিস্তি দিয়ে খেলাপি ঋণ নিয়মিত করার সুযোগ রাখা হয়। নতুন নিয়মে ঋণ পরিশোধের জন্য ১০ বছর সময় দেয়া হয়, এর মধ্যে প্রথম এক বছর কোনো কিস্তি দিতে হয়নি। সেই সুযোগ নেয়া বেশির ভাগই পরে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে।
এছাড়া করোনা মহামারির কারণে এর আগে ঋণ পরিশোধে বড় ছাড় দিয়ে রেখেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক, যা চলতি বছরে তুলে নেয়া হয়। এর ফলে দুই বছর ঋণ পরিশোধ না করেও অনেকেই ভালো গ্রাহকের তালিকায় ছিল। আর এখন ছাড় ওঠে যাওয়ার পর অনেকেই ঋণ পরিশোধ করছেন না। আবার যেসব ঋণ এর আগে খেলাপি হওয়ার কারণে পুনঃতফসিল করা হয়েছিল, সেই ঋণের কিস্তিও শোধ হচ্ছে না। এতেও বাড়ছে খেলাপি ঋণ। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করছে।