২৮ বছর বিরোধীদলীয় নেতা শূন্য বাড়িটি…

- আপডেট সময় : ১২:১০:৩৯ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৫ মার্চ ২০২৫ ১৪ বার পড়া হয়েছে
- মিন্টু রোডের জরাজীর্ণ বাড়ি সংস্কারের উদ্যেগ
- দশম সংসদ অধিবেশনে আলোচনা
- হেরিটেজ ভবন ভাঙনে আদালতের নিষেধাজ্ঞা
স্বাধীন দেশে ২৯ মিন্টো রোডের বাড়িটি বিরোধীদলীয় নেতার জন্য বরাদ্দ করা হয় দীর্ঘ ত্রিশ বছর আগে। কিন্তু গত প্রায় ২৮ বছরে কোনো বিরোধীদলীয় নেতা ওই বাসায় বসবাস করেননি। পড়েনি কোনো রাজনৈতিক নেতা বা সরকারী কর্মকর্তা এবং জনপ্রতিনিধির পদচিহ্ন। সম্প্রতি জরাজীর্ন ভবনটি সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট গর্ণপুত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী কাজের জন্য ঠিকাদারের সঙ্গে আলাপ আলোচনাও করেছেন। কি পরিমান অর্থ ব্যয় এবং কতদিন সময় লাগবে একাজ সম্পন্ন করতে এ সংক্রান্ত কথা হচ্ছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতার সরকারি বাসভবনে প্রবেশে কোনো বাধা নেই। যে কেউ যখন তখন প্রবেশ করতে পারেন। রাজধানীর মিন্টো রোডে আড়াই একর জমির ওপর বাড়িটির পেছনের অংশে বেশ কয়েকটি আধাপাকা টিনশেড ঘর। সেখানে পরিবার নিয়ে বসবাস করছেন দুজন পরিচ্ছন্নতাকর্মী ও একজন পানির লাইনের মিস্ত্রী।
এ ছাড়াও সেখানে বসবাস করছেন কয়েকটি সরকারি দপ্তরের মালি, গাড়িচালক ও পাহারাদারদের পরিবার। আরও দুটি টিনশেড ঘরে ১০-১২ জন ব্যাচেলর থাকেন। মূল ভবনটি বসবাস অনুপোযোগী। দরজা-জানালা ভাঙা। বেশিরভাগ আসবাবপত্র নষ্ট। বৃষ্টি হলে ছাদ চুইয়ে পানি পড়ে। বাড়িটি দেখে বোঝার কোনো উপায় নেই এটি একটি দেশের বিরোধী দলের নেতার সরকারি বাসভবন। আদালতের নির্দেশনা সত্ত্বেও বাড়িটি সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি, যে কারণে জাতীয় পার্টি বিরোধী দলে আসার পর দুই দফা বাড়িটি বরাদ্দের আবেদন করেও পায়নি। প্রায় ১২০ বছর আগে ব্রিটিশ সরকারের কর্তাদের বসবাসের জন্য রাজধানীর মিন্টো রোডে কয়েকটি বাড়ি তৈরি করা হয়েছিল। সে বাড়ির মধ্যে এটি একটি। যা বিরোধীদলের নেতার জন্য নির্ধারিত ছিল।
এদিকে ২০০৯ সালের ২ ফেব্রুয়ারি পুরান ঢাকার শাঁখারীবাজার, সূত্রাপুর, ফরাশগঞ্জ ও রমনা এলাকার পাঁচটি বাড়িকে ঐতিহ্য বা হেরিটেজ হিসেবে ঘোষণা করে গেজেট প্রকাশ করে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), যার মধ্যে বিরোধীদলীয় নেতার বাড়িটি রয়েছে। এরপর ২০১২ সালে এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হেরিটেজ ভবন ভাঙনে উচ্চ আদালত নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। বাড়িটি ভেঙে নতুন ভবন তৈরির উদ্যোগও থমকে যায়। আবার বাড়িটি রক্ষণাবেক্ষণে আদালতের নির্দেশনা বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। ফলে বাড়িটি বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, ১৯০৫ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার বাড়িটি নির্মাণ করে। এখানে প্রায় আড়াই একর জমি, দোতলা মূল ভবনের প্রত্যেক তলায় চারটি করে কক্ষ। ভবনটি দূর থেকে চাকচিক্যময় দেখা গেলেও ভেতরে জরাজীর্ণ। দেয়ালগুলো স্যাঁতসেঁতে, প্লাস্টার খসে পড়ছে। বৃষ্টি হলে পানিও পড়ে এই বাড়িতে। বেশির ভাগ আসবাব এরই মধ্যে নষ্ট হয়ে গেছে।
১৯৯৬ সালের পর বাড়িটিতে কোনো বিরোধীদলীয় নেতা বসবাস করেননি। তাই এর রক্ষণাবেক্ষণ কিংবা সংস্কারে গণপূর্ত বিভাগের উদ্যোগ ছিল না। এ বিষয়ে ঢাকা গণপূর্ত মেট্রোপলিটন জোনের নির্বাহী প্রকৌশলী বলেন, গত ১৭ বছরের বেশি সময় ওই বাড়িতে কেউ বসবাস করছেন না। বাড়িটির অনেক বয়স হয়েছে। দেয়ালের সিমেন্ট ও ছাদ খসে পড়ছে। ফলে বিরোধীদলীয় নেতাকে নতুন করে বরাদ্দ দেওয়া হলেও সংস্কার না করে সেখানে বসবাস করা যাবে না। যার কারণে তৎকালিন বিরোধীদলীয় নেতা গোলাম মোহাম্মদ কাদের (জি এম কাদের) বাড়িটিতে উঠার ইচ্ছাপোষন করেছিলেন। তবে জরাজীর্ণ অবস্থায় বাড়িটি বরাদ্দ দেওয়া সম্ভব নয় বলে জানিয়েছে গণপূর্ত বিভাগ। এদিকে ওই বাড়িটিকে ২০০৯ হেরিটেজ ঘোষণা করে গেজেট প্রকাশ করে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। যে কারণে উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা থাকায় বাড়িটি ভেঙ্গে নতুন করে বানানো যাচ্ছে না।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ১৯৯১ সালে বিএনপি সরকার গঠনের পর প্রথম বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে মিন্টো রোডের ওই বাড়িতে ওঠেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া বিরোধীদলীয় নেতা হলেও তিনি ওই বাড়িতে ওঠেননি। তবে তাঁর নামে বরাদ্দ থাকায় তিনি বাড়িটি রাজনৈতিক কাজে ব্যবহার করতেন। এরপর ২০০১ সালে চারদলীয় জোট ক্ষমতায় এলে বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনা বাড়িটি বরাদ্দ পেলেও তিনি ওঠেন ধানম-ির সুধা সদনে।
২০০৯ সালে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বিরোধীদলীয় নেতা হলেও তিনি ক্যান্টনমেন্টের মঈনুল রোডের বাড়িতে বসবাস করতেন। ওই বাড়িটির জন্য আবেদনও করেননি বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া। তবে ২০১৪ সালে রওশন এরশাদ ও ২০১৯ সালে এইচ এম এরশাদ বিরোধীদলীয় নেতা নির্বাচিত হওয়ার পর বাড়িটি বরাদ্দে পাওয়ার জন্য আবেদন করেন। কিন্তু ভবনটি সংস্কারের অজুহাতে বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। দশম সংসদে বিষয়টি অধিবেশনেও তোলা হয়।
জানা গেছে, ২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লাল ভবনগুলো ভেঙে নতুন নকশায় সেগুলো নির্মাণের নির্দেশনা দেন। এই নির্দেশনার পরই স্থাপত্য অধিদপ্তর নকশা প্রণয়নসহ প্রয়োজনীয় অন্যান্য পদক্ষেপ গ্রহণ করে। বিরোধীদলীয় নেতার বাড়িটির নতুন নকশা প্রণয়নের কাজ শুরু করেন স্থাপত্য অধিদপ্তরের সাবেক প্রধান স্থপতি কাজী গোলাম নাছির। কিন্তু কাজ কিছুদূর এগোনোর পর তিনি অবসরে চলে যাওয়ায় সেই কাজের প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়।
মিন্টু রোডের ওই ভবনের মালি আবুল কালাম বলেন, দুই যুগের বেশি সময় ফাঁকা পড়ে আছে মিন্টোরোডের বিরোধীদলীয় নেতার সরকারী বাসভবন। বিরোধীদলীয় নেতাদের কেউ বাড়ি বরাদ্দ পেয়েও ওঠেননি, কেউ বা আবার বরাদ্দ চেয়েও পাননি। বাড়িটি পরিত্যক্ত পড়ে থাকলেও সংস্কারের কোনো উদ্যোগ নেই।
১৯৯১ সালে প্রথম বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে বাড়িটিতে ওঠেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। তবে ২০০১ সালে বরাদ্দ পেয়েও তিনি ওঠেননি। আর ১৯৯৬ সালে বরাদ্দ পেয়েও ওঠেননি খালেদা জিয়া।
তবে ২০১৪ সালে রওশন এরশাদ বাড়িটি বরাদ্দ চেয়েও পাননি। ২০১৮ সালে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বরাদ্দ পেয়েও ওঠেননি। সবশেষ জিএম কাদের বরাদ্দ পেলেও বাড়িটি জরাজীর্ণ বাসের অযোগ্য থাকায় ওঠা হয়নি।
তবে গণপূর্ত বিভাগ বলছে, বাড়িটি সংস্কার করতে ঠিকাদার খোঁজা হচ্ছে। গণপূর্ত অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী বলেন, বাড়িটির সংস্কার কাজের জন্য ঠিকাদার দেখা হচ্ছে। কাজ শেষ হতে তিন থেকে চার মাস লাগতে পারে।