ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন এটা বিনোদনমূলক ভ্রমণ নয়
৩০ ব্যাংকের এমডি’র যুক্তরাষ্ট্র সফর
- আপডেট সময় : ১২:৪৮:৫৫ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৯ মে ২০২৪ ৩৮৩ বার পড়া হয়েছে
বাংলাদেশে সরকারী ও বেসরকারী ব্যাংকগুলোতে যখন ত্রাহিত্রাহি অবস্থা তখন এক সঙ্গে ৩০টি ব্যাংকের ম্যানেজিং ডিরেক্টর (এমডি) যুক্তরাষ্ট্র সফরে যাচ্ছেন। যা নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা হচ্ছে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
ব্যাংকের টাকা ব্যয় করে এতো এমডির একযোগে বিদেশ সফরে যাওয়ায় কেউ কেউ সমালোচনা করলেও শীর্ষস্থানীয় একটি ব্যাংকের এমডি বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, তারা যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগের আমন্ত্রণে যাচ্ছেন। ওই কর্মসূচির শেষে চারটি ব্যাংকের এমডি অফশোর ব্যাংকিং এর আওতায় প্রবাসীরা যাতে দেশের ব্যাংকে ডলার জমা করেন, তা নিয়ে প্রচারণামূলক অনুষ্ঠানে যোগ দিবেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অফশোর ব্যাংকিং এর আওতায় সিঙ্গাপুর বা দুবাইয়ের মতো বাংলাদেশেও ডলার আসলে ভালো। তবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে অফশোর ব্যাংকিংয়ে লাভবান হতে হলে ব্যাংকিং খাতে সুশাসন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরদারি ও ব্যবস্থাপনাগত দক্ষতা উন্নয়ন জরুরি বলে মনে করেন তারা। অর্থনীতিবিদদের কেউ কেউ ব্যাংক কর্মকর্তাদের একযোগে বিদেশ সফরের সমালোচনা করলেও, অন্যরা বাণিজ্যের দিক দিয়ে কিছু সুফল আসতে পারে বলেও মনে করছেন।
যদিও ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, এটা বিনোদনমূলক কোন সফর নয়। বরং ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বার্থেই তারা এই সফরে যাচ্ছেন।
সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসরুর আরেফিন এমডিদের ব্যাংকের অর্থ ব্যয় করে একযোগে বিদেশ সফর নিয়ে প্রকাশিত খবরাখবরের জন্য উষ্মা প্রকাশ করেন।
বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, “যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর বড় ট্রেড পার্টনার। তাদের অ্যান্টি মানিলন্ডারিং, টেররিস্ট ফাইনান্সিং, ট্রেড বেজড লন্ডারিং, কেওয়াইসি, নিষেধাজ্ঞায় থাকা দেশের সঙ্গে ব্যবসার কানুন, ইত্যাদি মেনেই আমরা ব্যাংকিং করি। আমেরিকার ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিসের ডাকে আমরা যাচ্ছি”।
ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিসের সঙ্গে এমডিদের আলোচনা শেষে চারটি ব্যাংকের এমডি নিউইয়র্কে প্রবাসী বাংলাদেশি ও বিদেশিদের অংশগ্রহণে এক অনুষ্ঠানে যোগ দিবেন, ব্যাংকগুলো যার নাম দিয়েছে আউটরিচ প্রোগ্রাম। নিউইয়র্কের ওই অনুষ্ঠানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন ডেপুটি গভর্নরও যোগ দিবেন।
আরেফিন বলছেন, “আমি বিস্মিত যে, মিডিয়া এই ট্রিপ নিয়ে বাঁকা কথা বলছে। ৪৭০ বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতির সাপেক্ষে এইসব কার্যক্রমকে দেখতে হবে। যে দুই কাজে এমডিরা যাচ্ছেন, বা যে সত্যিকারের বড় একটা কাজে ডেপুটি গভর্নর মহোদয় নিউইয়র্ক যাচ্ছেন, তার দুটোই এই অর্থনীতির বিকাশের জন্য জরুরি”।
তিনি বলেন তার ইউরোপে একটি সফরের মাধ্যমে অফশোর ব্যাংক ফিক্সড ডিপোজিট ব্যাল্যান্স সিটি ব্যাংকের একাই এখন বিশ মিলিয়ন ডলারের ওপরে।
“যারা যাচ্ছে সবাই বড় ব্যাংক। এসব ব্যাংক সরকারকে আটশ মিলিয়ন থেকে এক বিলিয়ন ডলার কর দিয়েছে। সেখানে সব এমডির খরচ হবে সোয়া দুই লাখ ডলার। অনেক ট্রেড পার্টনারের সঙ্গে আমাদের আবার অনেক দ্বিপক্ষীয় মিটিং আছে”।
এমডিদের কয়েকজন ইতোমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্যে ঢাকা ছেড়েছেন। বাকীরা আজকালের মধ্যে রওনা দিবেন বলে জানা গেছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক অর্থনীতিবিদ ডঃ মইনুল ইসলাম এমডিদের দল বেধে বিদেশ সফরের তীব্র সমালোচনা করেছেন।
“যেসব কাজে ওনারা যাচ্ছেন এর কোনটার জন্যই এমডিদের দল বেধে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা নেই। সবসময় এমন ভালো কথা শুনি। সব বেড়ানোর আয়োজন”।
অবশ্য পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ডঃ আহসান এইচ মনসুর বিবিসি বাংলাকে বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক খাতের সঙ্গে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের সম্পর্কের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ।
“আউটরিচ প্রোগ্রামটা ব্যাংকের নিজস্ব। অফশোর ব্যাংকিং এর জন্য তারা যদি সোর্স অফ মবিলাইজিং ফান্ডের কাজ করে তাহলে অসুবিধা কোথায়। কিছু আসলে তো লাভ। রাষ্ট্রই লাভবান হবে”।
প্রসঙ্গত, অফশোর ব্যাংকিং সারা পৃথিবীতে প্রচলিত ব্যাংকিং এর একটি অংশ। বিশ্বজুড়ে অনেক ব্যাংকের জন্য এটা বড় আয়ের অংশ। সিঙ্গাপুর ও সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ অনেক দেশ এভাবে লাভবান হয়েছে বলে অনেকে বলে থাকেন।
তবে বাংলাদেশের নাজুক ব্যাংকিং খাতকে বিবেচনায় রেখে এ ধরনের অফশোর ব্যাংকিংয়ের বিষয়ে সুফল পেতে হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীন নজরদারি, মনিটরিং এবং ব্যাংকিং খাতে সুশাসন জরুরি বলে মনে করেন গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান।
“আমাদের দেশের ক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে যে ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনায় যে দুর্বলতা, সুশাসনের ক্ষেত্রে দুর্বলতা, সংস্কারের ক্ষেত্রে শ্লথতা- তার সুযোগে উল্টো দেশের অর্থ পাচার না হয় সে ধরনের সুরক্ষা নিশ্চিত করা দরকার। ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী হলে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্বাধীনভাবে দেখভাল যদি করতে পারে তাহলে অফশোর ব্যাংকিং সাধারণ ব্যাংকিং কর্মকাণ্ড হিসেবেই সংযোজিত হবে”।
“তবে সমস্যা হলো – টাকা পাচার, ঋণ খেলাপি, টাকা বাইরে নিয়ে যাওয়া – এখানে চলমান সমস্যা। এ কারণেই কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সতর্ক ও সাবধান হওয়া দরকার,” বলছিলেন মি. রহমান। বাংলাদেশে বর্তমানে ৩৯ টি ব্যাংক অফশোর ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
একই সাথে অফশোর ব্যাংকিং লেনদেনে যে সুদ আসবে তার উপর কোনও কর আরোপ করা হবে না। অ্যাকাউন্ট পরিচালনার জন্য কোনও সুদ বা চার্জ দিতে হবে না।
নতুন আইনে কোন ঋণসীমা রাখা হয় নি, এতে যে কোনও পরিমাণ লেনদেন করা যাবে।