ঢাকা ১১:৫৮ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১১ মার্চ ২০২৫
সংবাদ শিরোনাম ::

কত প্রদীপ নিভেছে ঐ বন্দিশালায়

মহিউদ্দিন তুষার
  • আপডেট সময় : ০৯:২৬:৩৬ অপরাহ্ন, রবিবার, ৯ মার্চ ২০২৫ ৫৪ বার পড়া হয়েছে
দৈনিক গনমুক্তি অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি
  • গুম কমিশনে জমা পড়েছে ১ হাজার ৭৫২টি অভিযোগ * আয়না ঘরের প্রকৃত সংখ্যা এখনও জানা যায়নি * গুমের শিকার ৩৩০ ব্যক্তির ফিরে আসার ক্ষীণ * গুমের সর্বোচ্চ নির্দেশদাতা ছিলেন শেখ হাসিনা * গুমের শিকার কেউ ভারতে কিনা খোঁজ নিচ্ছে কমিশন

শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামীলীগ সরকারের সময়ে গড়ে ওঠা আয়নাঘর নামে পরিচিত গোপন নির্যাতনকেন্দ্র (টর্চার সেল) ও বন্দিশালা। বাংলাদেশের ইতিহাসে বিরোধীমত দমনে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর এক নির্যাতন সেলের নাম এই আয়নাঘর। আওয়ামী লীগ সরকারের চোখে চরম শত্রু বলে বিবেচিত হতো যারা তাদের হয় খুন না হয় গুম করে রাখা হতো আয়নাঘরে। ঢাকা সেনানিবাসে অবস্থিত এই আয়নাঘর প্রতিরক্ষা বাহিনীর কাউন্টার টেরোরিজম ইন্টেলিজেন্স ব্যুারো (সিটিআইবি) দ্বারা পরিচালিত একটি গোপন আটক কেন্দ্র। শেখ হাসিনা তার মতের বিরুদ্ধে যাওয়া ব্যক্তিদের শায়েস্তা করতে সারাদেশে আয়নাঘরের মতো নির্যাতন সেল তৈরি করেছিলেন। যারা আয়নাঘরে বিভীষিকাময় নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন তারা এখন একে একে মুখ খুলে আয়নাঘরকে ব্যাপক পরিচিত করেছেন।

শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০১০ সাল থেকে প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী বা লক্ষ্যবস্তু করা ব্যক্তিদের গুম করার প্রবণতা শুরু হয়। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে এটা ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। শুরু থেকেই এ ঘটনায় সরকারি বাহিনী জড়িত বলে অভিযোগ উঠলেও তৎকালীন সরকার সেটা আমলে নেয়নি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পাওনাদারের ভয়ে পালিয়ে আছে বলে উপহাসমূলক বক্তব্য দেওয়া হয়েছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর গুম হওয়া ব্যক্তিদের ফিরিয়ে দেওয়া, গোপন বন্দিশালা বন্ধ করা এবং এর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনার দাবি জোরালোভাবে উঠেছে। এর পরপরই গঠিত হয় গুম কমিশন।

গণআন্দোলনের মুখে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার সরকার গত দেড় দশকে বাংলাদেশে ‘আইয়ামে জাহেলিয়া’ বা অন্ধকার যুগ প্রতিষ্ঠা করেছিল বলে মন্তব্য করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূস। আইয়ামে জাহেলিয়া বলে একটা কথা আছে না, গত সরকার আইয়ামে জাহেলিয়া প্রতিষ্ঠা করে গেছে। এটা তার একটি নমুনা, গোপন বন্দিশালা পরিদর্শন শেষে এমন মন্তব্য করেছিলেন অধ্যাপক ইউনূস। গোপন বন্দিশালাকে এক কথায় বীভৎস বলে বর্ণনা করেন তিনি। যতটাই শুনি মনে হয়, অবিশ্বাস্য, এটা কি আমাদেরই জগৎ, আমাদের সমাজ? যারা নিগৃহীত হয়েছেন, তারাও আমাদের সমাজেই আছেন। তাদের মুখ থেকে শুনলাম। কী হয়েছে, কোনো ব্যাখ্যা নেই বলেন প্রধান উপদেষ্টা।

জানা যায়, আয়নাঘরের মতো সারাদেশে ডিজিএফআই’র নিয়ন্ত্রণে অনেকগুলো বন্দিশালা ছিল। গুম সংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী আয়নাঘর নিয়ে মানুষের বিদ্যমান কৌতূহল খানিকটা মিটিয়েছেন। গুম বিষয়ে প্রাপ্ত সকল অভিযোগের তদন্ত এই কমিশন করবে। এজন্য গত সেপ্টেম্বর মাসেই তারা আনুষ্ঠানিকভাবে কাজ শুরু করে দিয়েছেন। তার নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত কমিশন গত ২৫ সেপ্টেম্বর বহুল আলোচিত আয়নাঘর বা বন্দিশালা পরিদর্শন করে। এরপর তারা ১ অক্টোবর ডিবি ও সিটিটিসি’র নিয়ন্ত্রণে থাকা বন্দিশালা পরিদর্শন করেন। এ সময় তারা আয়নাঘর সম্পর্কিত বেশকিছু বিষয় জনসন্মুখে তুলে ধরেন। তবে আয়নাঘরের প্রকৃত সংখ্যা এখনও জানা যায়নি। গুমের শিকার ৩৩০ ব্যক্তির ফিরে আসার ক্ষীণ আশা বলেও জানিয়েছে গুম তদন্তে গঠিত কমিশন।

গুম কমিশনের প্রধান মইনুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, কমিশনে ১ হাজার ৭৫২টি অভিযোগ জমা পড়েছে, যার মধ্যে ১ হাজারটি অভিযোগ এবং এগুলোতে সংযুক্ত নথিপত্রের যাচাই-বাছাই প্রাথমিকভাবে সম্পন্ন হয়েছে। কমিশনে ২৮০ জন অভিযোগকারীর জবানবন্দি রেকর্ড করা হয়েছে। এ ছাড়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার বিভিন্ন পর্যায়ের প্রায় ৪৫ জন কর্মকর্তার বক্তব্য রেকর্ড করা হয়েছে। গুমের শিকার হয়ে ফিরে না আসা ৩৩০ জনের বর্তমান অবস্থা বা ভাগ্য সম্পর্কে অনুসন্ধান চলমান আছে। তবে সাধারণভাবে বলা যায়, তাদের ফিরে আসার আশা ক্ষীণ। কমিশন প্রধান বলেন, গুমের পক্ষে সর্বোচ্চ নির্দেশদাতা ছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার নির্দেশেই গুমের ঘটনা ঘটেছে।

কমিশনপ্রধান জানান, বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার যেসব সদস্যের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের নাগরিকদের গুম করার অভিযোগ আছে, তাদের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে অনুসন্ধান করছে কমিশন। কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন যে, গুমের সঙ্গে জড়িত কতিপয় ব্যক্তির জন্য পুরো বাহিনী আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার যেসব সদস্য গুমের সঙ্গে জড়িত, তা তাদের ব্যক্তিগত ফৌজদারি দায়। কারণ অপরাধীরা অনেক সময় আইনের হাত থেকে বাঁচতে তার ধর্ম, কমিউনিটি, সামাজিক গ্রুপ ইত্যাদির আড়ালে লুকাতে চেষ্টা করে। কিন্তু বিচার কখনও ব্যক্তির পরিচয় দিয়ে হয় না, তা হয় সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে। কারণ ফৌজদারি অপরাধ একটি ব্যক্তিগত দায়। এতে কমিউনিটিকে দোষারোপ করার কোনো সুযোগ নেই।

বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, গুমের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনা হলে সংশ্লিষ্ট বাহিনীর কালিমা মোচন হবে এবং বাহিনীর ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে। কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়। এটাই আইনের শাসনের মর্মবাণী। এই কমিশন ‘কমিশনস অব ইনকোয়ারি অ্যাক্ট, ১৯৫৬’-এর অনুবলে গঠিত হয়ে সম্পূর্ণ পাপমুক্ত ও স্বাধীনভাবে কাজ করছে। এ জন্য এই কমিশনের কাজে কোনো বাহিনীর দেশপ্রেমিক সদস্যদের নিয়মিত কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ার কোনো কারণ নেই।

কমিশনপ্রধান বলেন, ঢাকা, বগুড়া, নারায়ণগঞ্জ, রাজশাহী, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন জেলায় ডিজিএফআই, সিটিটিসি ও র‌্যাবের নিয়ন্ত্রণাধীন বেশ কিছু গোপন বন্দিশালার সন্ধান পাওয়া মাত্রই তা পরিদর্শন করে অপরিবর্তিত রাখার নির্দেশনা প্রদান করে কমিশন। যেমন- কমিশন গঠনের কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই ডিজিএফআইয়ের জেআইসি (আয়নাঘর) এবং র‌্যাব হেডকোয়ার্টারের টিএফআই পরিদর্শন করে আলামত ধ্বংসের প্রক্রিয়া দ্রুততার সঙ্গে বন্ধ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়।

তিনি জানান, ভারত এক হাজার ৬৭ জনের একটি তালিকা দিয়েছে, সেটি গুমসংক্রান্ত কমিশন মিলিয়ে দেখছে। সেই তালিকায় গুম হওয়া কোনো ব্যক্তি আছে কি না, তা অনুসন্ধান করা হচ্ছে। এ তালিকা ভারত আরও দেবে। তিনি বলেন, সীমান্তবর্তী জেলার পুলিশ সুপার ও বিজিবির সেক্টর কমান্ডারদের কাছ থেকে আগস্টের পর ভারত থেকে বাংলাদেশে পুশ-ইন করা ১৪০ জনের তথ্য পাওয়া গেছে। প্রাথমিক অনুসন্ধানে তাদের মধ্যে গুমের শিকার কোনো ব্যক্তির নাম এখনও পাওয়া যায়নি। ধামরাই থেকে গুম হওয়া মোহাম্মদ রহমত উল্লাহ নামের এক ব্যক্তিকে গত ২২ ডিসেম্বর চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্ত হয়ে বাংলাদেশে পুশ-ইন করা হয়েছে। এ বিষয়ে কমিশন অনুসন্ধান করছে।

পুলিশ লাইনসে গোপন বন্দিশালা প্রাপ্তির তথ্য তুলে ধরে গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের সদস্য নূর খান গণমাধ্যমকে জানান, বগুড়া পুলিশ লাইনসে গোপন বন্দিশালা পাওয়া গেছে। এখানে বন্দিদের জিজ্ঞাসাবাদের নামে নির্যাতন করা হতো। পুলিশ লাইনসের ভেতরে কারাগারের মতো গোপন বন্দিশালা তৈরি করে রাখা হয়েছিল। এটি একেবারেই অ্যাবসার্ড (অযৌক্তিক) একটা ব্যাপার। সেটি আমরা বগুড়ায় পেয়েছি। আমাদের ধারণা, অনেক ক্ষেত্রে এ ধরনের আরও পাব।

বন্দিশালার বিষয়ে নূর খান বলেন, এগুলো গত ১৫ বছরের মধ্যেই বানানো হয়েছে। সম্ভবত গত ১০ থেকে ১২ বছরের মধ্যে। এখানে বিভিন্ন জেলা থেকে বন্দিদের এনে রাখা হতো, জিজ্ঞাসাবাদের নামে নির্যাতন করা হতো। এখান থেকেও অনেকের মৃত্যু ঘটে থাকতে পারে। এর আগে ডিজিএফআইয়ের সদর দপ্তর, সিটিটিসির সদর দপ্তর, র?্যাবের বিভিন্ন ব্যাটালিয়ন ও পুলিশের বিভিন্ন গোয়েন্দা কার্যালয়ে গোপন বন্দিশালার সন্ধান পায় কমিশন। সেগুলো অক্ষত রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

 

নিউজটি শেয়ার করুন

ট্যাগস :

কত প্রদীপ নিভেছে ঐ বন্দিশালায়

আপডেট সময় : ০৯:২৬:৩৬ অপরাহ্ন, রবিবার, ৯ মার্চ ২০২৫
  • গুম কমিশনে জমা পড়েছে ১ হাজার ৭৫২টি অভিযোগ * আয়না ঘরের প্রকৃত সংখ্যা এখনও জানা যায়নি * গুমের শিকার ৩৩০ ব্যক্তির ফিরে আসার ক্ষীণ * গুমের সর্বোচ্চ নির্দেশদাতা ছিলেন শেখ হাসিনা * গুমের শিকার কেউ ভারতে কিনা খোঁজ নিচ্ছে কমিশন

শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামীলীগ সরকারের সময়ে গড়ে ওঠা আয়নাঘর নামে পরিচিত গোপন নির্যাতনকেন্দ্র (টর্চার সেল) ও বন্দিশালা। বাংলাদেশের ইতিহাসে বিরোধীমত দমনে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর এক নির্যাতন সেলের নাম এই আয়নাঘর। আওয়ামী লীগ সরকারের চোখে চরম শত্রু বলে বিবেচিত হতো যারা তাদের হয় খুন না হয় গুম করে রাখা হতো আয়নাঘরে। ঢাকা সেনানিবাসে অবস্থিত এই আয়নাঘর প্রতিরক্ষা বাহিনীর কাউন্টার টেরোরিজম ইন্টেলিজেন্স ব্যুারো (সিটিআইবি) দ্বারা পরিচালিত একটি গোপন আটক কেন্দ্র। শেখ হাসিনা তার মতের বিরুদ্ধে যাওয়া ব্যক্তিদের শায়েস্তা করতে সারাদেশে আয়নাঘরের মতো নির্যাতন সেল তৈরি করেছিলেন। যারা আয়নাঘরে বিভীষিকাময় নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন তারা এখন একে একে মুখ খুলে আয়নাঘরকে ব্যাপক পরিচিত করেছেন।

শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০১০ সাল থেকে প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী বা লক্ষ্যবস্তু করা ব্যক্তিদের গুম করার প্রবণতা শুরু হয়। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে এটা ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। শুরু থেকেই এ ঘটনায় সরকারি বাহিনী জড়িত বলে অভিযোগ উঠলেও তৎকালীন সরকার সেটা আমলে নেয়নি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পাওনাদারের ভয়ে পালিয়ে আছে বলে উপহাসমূলক বক্তব্য দেওয়া হয়েছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর গুম হওয়া ব্যক্তিদের ফিরিয়ে দেওয়া, গোপন বন্দিশালা বন্ধ করা এবং এর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনার দাবি জোরালোভাবে উঠেছে। এর পরপরই গঠিত হয় গুম কমিশন।

গণআন্দোলনের মুখে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার সরকার গত দেড় দশকে বাংলাদেশে ‘আইয়ামে জাহেলিয়া’ বা অন্ধকার যুগ প্রতিষ্ঠা করেছিল বলে মন্তব্য করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূস। আইয়ামে জাহেলিয়া বলে একটা কথা আছে না, গত সরকার আইয়ামে জাহেলিয়া প্রতিষ্ঠা করে গেছে। এটা তার একটি নমুনা, গোপন বন্দিশালা পরিদর্শন শেষে এমন মন্তব্য করেছিলেন অধ্যাপক ইউনূস। গোপন বন্দিশালাকে এক কথায় বীভৎস বলে বর্ণনা করেন তিনি। যতটাই শুনি মনে হয়, অবিশ্বাস্য, এটা কি আমাদেরই জগৎ, আমাদের সমাজ? যারা নিগৃহীত হয়েছেন, তারাও আমাদের সমাজেই আছেন। তাদের মুখ থেকে শুনলাম। কী হয়েছে, কোনো ব্যাখ্যা নেই বলেন প্রধান উপদেষ্টা।

জানা যায়, আয়নাঘরের মতো সারাদেশে ডিজিএফআই’র নিয়ন্ত্রণে অনেকগুলো বন্দিশালা ছিল। গুম সংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী আয়নাঘর নিয়ে মানুষের বিদ্যমান কৌতূহল খানিকটা মিটিয়েছেন। গুম বিষয়ে প্রাপ্ত সকল অভিযোগের তদন্ত এই কমিশন করবে। এজন্য গত সেপ্টেম্বর মাসেই তারা আনুষ্ঠানিকভাবে কাজ শুরু করে দিয়েছেন। তার নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত কমিশন গত ২৫ সেপ্টেম্বর বহুল আলোচিত আয়নাঘর বা বন্দিশালা পরিদর্শন করে। এরপর তারা ১ অক্টোবর ডিবি ও সিটিটিসি’র নিয়ন্ত্রণে থাকা বন্দিশালা পরিদর্শন করেন। এ সময় তারা আয়নাঘর সম্পর্কিত বেশকিছু বিষয় জনসন্মুখে তুলে ধরেন। তবে আয়নাঘরের প্রকৃত সংখ্যা এখনও জানা যায়নি। গুমের শিকার ৩৩০ ব্যক্তির ফিরে আসার ক্ষীণ আশা বলেও জানিয়েছে গুম তদন্তে গঠিত কমিশন।

গুম কমিশনের প্রধান মইনুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, কমিশনে ১ হাজার ৭৫২টি অভিযোগ জমা পড়েছে, যার মধ্যে ১ হাজারটি অভিযোগ এবং এগুলোতে সংযুক্ত নথিপত্রের যাচাই-বাছাই প্রাথমিকভাবে সম্পন্ন হয়েছে। কমিশনে ২৮০ জন অভিযোগকারীর জবানবন্দি রেকর্ড করা হয়েছে। এ ছাড়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার বিভিন্ন পর্যায়ের প্রায় ৪৫ জন কর্মকর্তার বক্তব্য রেকর্ড করা হয়েছে। গুমের শিকার হয়ে ফিরে না আসা ৩৩০ জনের বর্তমান অবস্থা বা ভাগ্য সম্পর্কে অনুসন্ধান চলমান আছে। তবে সাধারণভাবে বলা যায়, তাদের ফিরে আসার আশা ক্ষীণ। কমিশন প্রধান বলেন, গুমের পক্ষে সর্বোচ্চ নির্দেশদাতা ছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার নির্দেশেই গুমের ঘটনা ঘটেছে।

কমিশনপ্রধান জানান, বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার যেসব সদস্যের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের নাগরিকদের গুম করার অভিযোগ আছে, তাদের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে অনুসন্ধান করছে কমিশন। কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন যে, গুমের সঙ্গে জড়িত কতিপয় ব্যক্তির জন্য পুরো বাহিনী আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার যেসব সদস্য গুমের সঙ্গে জড়িত, তা তাদের ব্যক্তিগত ফৌজদারি দায়। কারণ অপরাধীরা অনেক সময় আইনের হাত থেকে বাঁচতে তার ধর্ম, কমিউনিটি, সামাজিক গ্রুপ ইত্যাদির আড়ালে লুকাতে চেষ্টা করে। কিন্তু বিচার কখনও ব্যক্তির পরিচয় দিয়ে হয় না, তা হয় সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে। কারণ ফৌজদারি অপরাধ একটি ব্যক্তিগত দায়। এতে কমিউনিটিকে দোষারোপ করার কোনো সুযোগ নেই।

বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, গুমের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনা হলে সংশ্লিষ্ট বাহিনীর কালিমা মোচন হবে এবং বাহিনীর ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে। কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়। এটাই আইনের শাসনের মর্মবাণী। এই কমিশন ‘কমিশনস অব ইনকোয়ারি অ্যাক্ট, ১৯৫৬’-এর অনুবলে গঠিত হয়ে সম্পূর্ণ পাপমুক্ত ও স্বাধীনভাবে কাজ করছে। এ জন্য এই কমিশনের কাজে কোনো বাহিনীর দেশপ্রেমিক সদস্যদের নিয়মিত কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ার কোনো কারণ নেই।

কমিশনপ্রধান বলেন, ঢাকা, বগুড়া, নারায়ণগঞ্জ, রাজশাহী, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন জেলায় ডিজিএফআই, সিটিটিসি ও র‌্যাবের নিয়ন্ত্রণাধীন বেশ কিছু গোপন বন্দিশালার সন্ধান পাওয়া মাত্রই তা পরিদর্শন করে অপরিবর্তিত রাখার নির্দেশনা প্রদান করে কমিশন। যেমন- কমিশন গঠনের কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই ডিজিএফআইয়ের জেআইসি (আয়নাঘর) এবং র‌্যাব হেডকোয়ার্টারের টিএফআই পরিদর্শন করে আলামত ধ্বংসের প্রক্রিয়া দ্রুততার সঙ্গে বন্ধ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়।

তিনি জানান, ভারত এক হাজার ৬৭ জনের একটি তালিকা দিয়েছে, সেটি গুমসংক্রান্ত কমিশন মিলিয়ে দেখছে। সেই তালিকায় গুম হওয়া কোনো ব্যক্তি আছে কি না, তা অনুসন্ধান করা হচ্ছে। এ তালিকা ভারত আরও দেবে। তিনি বলেন, সীমান্তবর্তী জেলার পুলিশ সুপার ও বিজিবির সেক্টর কমান্ডারদের কাছ থেকে আগস্টের পর ভারত থেকে বাংলাদেশে পুশ-ইন করা ১৪০ জনের তথ্য পাওয়া গেছে। প্রাথমিক অনুসন্ধানে তাদের মধ্যে গুমের শিকার কোনো ব্যক্তির নাম এখনও পাওয়া যায়নি। ধামরাই থেকে গুম হওয়া মোহাম্মদ রহমত উল্লাহ নামের এক ব্যক্তিকে গত ২২ ডিসেম্বর চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্ত হয়ে বাংলাদেশে পুশ-ইন করা হয়েছে। এ বিষয়ে কমিশন অনুসন্ধান করছে।

পুলিশ লাইনসে গোপন বন্দিশালা প্রাপ্তির তথ্য তুলে ধরে গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের সদস্য নূর খান গণমাধ্যমকে জানান, বগুড়া পুলিশ লাইনসে গোপন বন্দিশালা পাওয়া গেছে। এখানে বন্দিদের জিজ্ঞাসাবাদের নামে নির্যাতন করা হতো। পুলিশ লাইনসের ভেতরে কারাগারের মতো গোপন বন্দিশালা তৈরি করে রাখা হয়েছিল। এটি একেবারেই অ্যাবসার্ড (অযৌক্তিক) একটা ব্যাপার। সেটি আমরা বগুড়ায় পেয়েছি। আমাদের ধারণা, অনেক ক্ষেত্রে এ ধরনের আরও পাব।

বন্দিশালার বিষয়ে নূর খান বলেন, এগুলো গত ১৫ বছরের মধ্যেই বানানো হয়েছে। সম্ভবত গত ১০ থেকে ১২ বছরের মধ্যে। এখানে বিভিন্ন জেলা থেকে বন্দিদের এনে রাখা হতো, জিজ্ঞাসাবাদের নামে নির্যাতন করা হতো। এখান থেকেও অনেকের মৃত্যু ঘটে থাকতে পারে। এর আগে ডিজিএফআইয়ের সদর দপ্তর, সিটিটিসির সদর দপ্তর, র?্যাবের বিভিন্ন ব্যাটালিয়ন ও পুলিশের বিভিন্ন গোয়েন্দা কার্যালয়ে গোপন বন্দিশালার সন্ধান পায় কমিশন। সেগুলো অক্ষত রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।