ইলিশ রক্ষার লড়াইয়ে ভোলার জেলেরা

- আপডেট সময় : ০২:১৭:২৯ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৩ মার্চ ২০২৫ ১৫ বার পড়া হয়েছে
দেশের ছয়টি অভয়াশ্রমের ৪৩২ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে সকল প্রকারের মাছ ধরা বন্ধ রয়েছে। জাটকা রক্ষায় পহেলা মার্চ থেকে ৩১ এপ্রিল এই নিষেধাজ্ঞা চলবে। এই সময়ে ইলিশ রক্ষায় উপকূলবর্তী অভয়াশ্রম এলাকার বিভিন্ন স্থানে জনসচেতনতা সভার আয়োজন করা হয়ে থাকে। ভোলা জেলার সদর উপজেলার কাচিয়া-মাঝেরচর ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ড স্কুল প্রঙ্গণে সচেতনতা সভায় স্থানীয় জেলেরা উপস্থিত ছিলেন। ইলিশ আমাদের সম্পদ আমরাই রক্ষা করবো, আয়াশ্রমে দুই মাস জাটকা সরক্ষণে সচেতনতা সভায় স্থানীয় মৎস্য কর্মকর্তা ও মৎস্যজীবীরা বক্তব্য রাখেন। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র মৎস্যজীবী জেলে সমিতির ভোলা জেলার সভাপতি এরশাদ ফরায়জি ও সাধারণ সম্পাদক আল মামুন শেখের নেতৃত্বে উপজেলা মৎস্য কর্তকর্তা, মেরিণ ফিরারিজ অফিসারসহ স্থানীয় জেলে প্রতিনিধিরা সচেতনতা সভায় বক্তব্য রাখেন। ইলিশ রক্ষায় জেলেরা ঐক্যবদ্ধ থাকলেও নিষিদ্ধকালীন সময়ে তাদের চাল না পাওয়ায় অনেকেই নদীতে মাছ শিকারে যান বলেও স্বীকার করেন তারা।
মৎস্যজীবীরা অভিযোগ করেন, মাছ ধরা বন্ধে সরকারী নিষেধাজ্ঞাকালীন সরকারের তরফে যে চাউল দেওয়া কথা রয়েছে, তা তারা পাচ্ছেন না। যারা পাচ্ছেন তাদের পুরো চাল দেওয়া হয় না। বিগত আওয়ামী লীগ সরকার আমলে জেলেদের চাউল বরাদ্দ নিয়ে যে অরাজকতার সৃষ্টি করা হয়েছিলো, সেই ধারাবাহিকতা এখনও চলছে। জেলেরা বলেন, আমাদের সন্তান যখন খাবারের জন্য কান্নাকাটি করে, তখন একজন বাবা হিসাবে মাছ ধরা থেকে বিরত থাকতে পারি না। জেলের চাউল নিয়ে চাল বাজি আগের মতোই চলছে। এই পরিস্থিতি থেকে বেড়িয়ে আসছেন চান তারা।
মাথার উপরে খোলা আকাশ আর নির্ভেজাল রোদ মাথায় নিয়ে সচেতনতা সভায় উপস্থিত জেলের অনেকের গায়ে কাপড় ছিলো না। লুঙ্গি পড়া কাধে গামছা নিয়ে সহজ-সরল মানুষগুলোর চোখেমুখে অপ্রাপ্তির ছাপ। অনেকে বক্তব্য দিয়ে গিয়ে সোজাসাপ্টা বলেন, নদীতে অভিযান চালিয়ে আমাদের সম্বল জাল ধরে পুড়িয়ে দিচ্ছে। অথচ আমাদের নামে সরকারের বরাদ্দকৃত চালের কোন নিশ্চয়তা দিতে পারছে না মৎস্য কর্মকর্তা। মাছ ধরতে না পেরে আমরা অনাহারে-অর্ধারে দিন কাটাচ্ছি। আর আমাদের চাল খাচ্ছে প্রশাসনের লোকদের পেটে।
কাচিয়া-মাঝেরচর ইউনিয়নের ৭, ৮ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডের শেল্টার সেন্টারে সচেতনতা সভায় অংশ নেওয়া সভার শুরুতেই সমস্বরে বলেন, আমাদের চাউল আমরা চাই। আমাদের প্রতিনিধিদের মাধ্যমে চাউল দিতে হবে। মো. শহিদ, সোহরাব হোসেন, খোকন মাঝি, সাগর জেলেরা চাউল পাচ্ছেন না। বিগত ১৫ বছরে জেলের চাউল নিয়ে যে নয়-ছয় হয়েছে, এখনও হচ্ছে। সেই পরিস্থিতির পরিবর্তন চান জেলেরা। বলেন, সরকার জেলেদের নামে চাল বরাদ্দ দিলেও মোটাদাগের জেলেরা চাউল পাচ্ছে না। একারণে শতভাগ সফল হচ্ছে নিষেধাজ্ঞা। পেটের দায়ে বিপদ মাথায় নিয়েও অনেক জেলে নদীতে মাছ শিকারে যান। এসময় কোন কোন জেলে আটক হন। অনেকে জেল খাটেন আবার অনেকে জাল হারিয়ে নিঃশ্ব হন। মেঘনার অথৈ স্রোতে ভাসতে থাকা জেলেদের জীবমান উন্নয়নের উদ্যোগ নেই। মেঘনা-তেতুলিয়া নদীর জোয়ার-ভাটার মতো ভাসতে থাকা জেলেদের ভাগ্য পরিবর্তনের উদ্যোগ আগে পরের কোন সরকারই গ্রহণ করেনি। মৎস্যজীবীরা বলেন, আমাদের মাথা বিক্রি করে স্বার্থান্বেষী মহল লাভবান হলেও জেলেদের ভাগ্য ফেরেনি। ভোলা, দৌলতখান, হিজলা, মেহেন্দীগঞ্জ, চাঁদপুর সর্বত্র চাল না পাওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
ভোলার পূর্ব ইলিশার মো. ইব্রহিম জানালেন, নিজে ১০ বছর দরে মৎস্য আহরণ করে জীবিকা নির্বাহ করলেও চাউলের কোন কার্ড পাননি। বরং বাবা সাহেব আলী মাঝির কার্ডটিও বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। আর বেদে সম্প্রদায়ের মানুষের চোখের জল আর মেঘনা-তেতুলিয়ার জলে মিলেমিশে একাকার। মেঘনা অথৈ জলে ভাসা তাদের জীবন। মেঘনাই তাদের বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন। এই মেঘনায় জন্ম আর এই মেঘনায়ই মৃত্যু। প্রকৃতির দয়ায় তারা বেচে আছেন। তারা না পাচ্ছেন সরকারের বরাদ্দকৃত চাল না পাচ্ছেন সরকারের তরফে কোন উপকরণ।
অভয়াশ্রম : চাঁদপুর জেলার ষাটনল থেকে লক্ষীপুর জেলার চর আলেকজান্ডার পর্যন্ত মেঘনা নদীর নিম্ন অববাহিকার ১০০ কিলোমিটার, লোলা জেলার মদনপুর/চরইলিশা থেকে চর পিয়াল পর্যন্ত মেঘনা নদীর শাহবাজপুর শাখা নদীর ৯০ কিলোমিটার, ভোলা জেলার ভেদুরিয়া থেকে পটুয়াখালী জেলার চর রুস্তম পর্যন্ত তেতুলিয়া নদীর প্রায় ১০০ কিলোমিটার, পরটুয়াখালী জেলার কলাপড়া উপজেলার সমগ্র আন্ধারমানিক নদীর ৪০ কিলোমিটার, শরীয়তপুর জেলার নড়িয়া ও ভেদরগঞ্জ উপজেলা এবং চাঁদপুর জেলার মতলব উপজেলার মধ্যে অবস্থিত পদ্মা নদীর ২০ কিলোমিটার, বরিশাল জেলার হিজলা, মেহেন্দীগঞ্জ ও বরিশাল সদর উপজেলার কালাবদর, গজারিয়া ও মেঘনা নদীর প্রায় ৮২ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে মাছ ধরা নিষিদ্ধকালীন সময়ে মাফিয়া চক্র সক্রিয় রয়েছে।
এসব এলাকার বিভিন্ন আড়তদার, দাদনধার, সমাজপতিসহ আঞ্চলিক মাফিয়াগোষ্ঠী সরকারের নিষেধাজ্ঞা বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে অভয়াশ্রমে মাছ শিকার করে থাকে। যদিও মৎস্য সংরক্ষরণ আইন অনুযায়ী প্রতিবছর নভেম্বর থেকে জুন পর্যন্ত জাটকা ইলিশ ধরা, ক্রয়-বিক্রয়, মজুদ ও পরিবহণ নিষিদ্ধ। ইলিশ অভয়াশ্রম এলাকায় বছরের নির্দিষ্ট সময়ে জাটকাসহ সকল প্রকার মাছ ধরা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। অথচ ৬টি অভয়াশ্রমের ৪৩২ কিলোমিটারজুড়েই মাফিয়াদের দৌরাত্ম্য রয়েছে। নিষেধাজ্ঞাকালীন নৌ-পুলিশ, মৎস্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা নদীতে দায়িত্বপালন করে থাকেন। কিন্তু নৌপুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ তারা অবৈধ মাছ শিকারীদের সঙ্গে যোগসাজ করে থাকে। ফলে মৎস্যজীবীরা সুযোগ বুঝে নদীতে মাছ শিকার করেন থাকেন।