ঢাকা ০১:২১ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২২ এপ্রিল ২০২৫

রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েলে বড় অস্ত্র মামলা

মহিউদ্দিন তুষার
  • আপডেট সময় : ০৪:৪৮:২৯ অপরাহ্ন, সোমবার, ২১ এপ্রিল ২০২৫ ২৯ বার পড়া হয়েছে
দৈনিক গনমুক্তি অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

# রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হলে নাম/পদবি পরিবর্তন হয়, বদলায় না মামলার ধরন
# থানায় দায়ের হওয়া মামলা বেশিরভাগই মিথ্যা ও গায়েবি
# মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা করলে ব্যবস্থা : স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়

ঢালাও মামলা বাংলাদেশে নতুন কিছু নয়। বিগত সরকারের তিন মেয়াদের শেষ সাট-আট বছর ঢালাও মামলা এক ভয়াবহ আকার ধারন করেছিল। পুলিশ মামলা দিয়ে দিতো শত শত মানুষের নামে। মামলা যাদের নামে দেওয়া হতো, তাদের মধ্যে সকলেই বিরোধী দলগুলোর নেতা-কর্মী থাকতো। এরপর গ্রেপ্তার, পুলিশি হয়রানি, মামলা বাণিজ্য এসব মিলে আইন ও পুলিশ পরিণত হয়েছিল নিপীড়নের হাতিয়ারে। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরে ৮ আগস্ট অর্ন্তবর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে। ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থানের মূল চেতনা ছিল রাষ্ট্র সংস্কার। সেই সংস্কারের কেন্দ্রে রয়েছে আইনের শাসন ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা, পুলিশ, প্রশাসন ও বিচার বিভাগের সংস্কার, সামষ্টিক অর্থনীতির শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা, এবং একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু অর্ন্তবর্তী সরকার তাদের প্রথম চ্যালেঞ্জ স্থিতিশীল আইন-শৃঙ্খলা ব্যবস্থা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত তেমন একটা সফলতার পরিচয় দিতে পারেনি।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত বাংলাদেশের বিভিন্ন থানায় কয়েক শতাধিক মামলা হয়েছে। অধিকাংশ মামলায় শেখ হাসিনা ছাড়া তার সরকারের সাবেক মন্ত্রী, এমপি, সাবেক সামরিক কর্মকর্তা, আওয়ামী লীগের নেতা, পুলিশের সাবেক আইজিপি, ডিএমপির সাবেক কমিশনারসহ পুলিশের বিভিন্ন পদমর্যাদার কর্মকর্তাকে আসামি করা হয়েছে। মামলাগুলোতে অভিযোগ আনা হয়েছে, গত ১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মী ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা গুলি ছোঁড়েন। এতে অনেক আন্দোলনকারী গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন। আহত হন অনেকে।

দেখা যায় হত্যা মামলা যার-তার নামে হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে প্রকৃত বাদীও জানেন না, কোথায় কে তাঁর আপনজন হত্যার বিচার চেয়ে মামলা ঠুকেছে। জীবিত ব্যক্তি হঠাৎ জানতে পারেন তাকে মৃত দেখিয়ে হয়ে গেছে মামলা, চলছে দেদার অর্থ উপার্জন! স্বামীকে হত্যার অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ ১৩০ জনের বিরুদ্ধেমামলা করে এক নারী। মামলা দায়েরের তিন মাস পর ওই নারীর স্বামী থানায় হাজির হয়ে জানান তিনি জীবিত। ঘটনাটা ঘটেছে ঢাকার আশুলিয়ায়। এমন অনেক মামলার খবরও জানা যাচ্ছে, যেখানে একটি হত্যার ঘটনায় একাধিক মামলা হয়েছে। অনেক জায়গায় মামলা নিয়ে বাণিজ্যের অভিযোগও উঠেছে।

শেখ হাসিনার করা মামলা নামক শেঁকল থেকে এখনও মুক্ত হতে পারেননি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা। আদালতের দ্বারে দ্বারে হাজিরা দিয়ে সর্বস্ব হারিয়েছেন কেউ কেউ। পারিবারিক জীবনেও পড়েছে বিরূপ প্রভাব। এরকমই এক ব্যক্তি সম্প্রতি ঢাকার আদালত পাড়ায় গণমাধ্যমের সাথে কথা বলেন। তার নাম মোহাম্মদ মহিউদ্দিন, পেশায় ব্যবসায়ী। পরিবার নিয়ে থাকেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের প্রতিটি কোণা তার পরিচিত। গত দশ বছর ধরে নিয়মিত চলাফেরা করছেন আদালত চত্বরে। তার বিরুদ্ধে থাকা মামলায় অভিযোগ রয়েছে, তিনি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছেন। যদিও তার দাবি রাজনৈতিক পরিচয়ই তার মূল অপরাধ। মহিউদ্দিনের দাবি, পুলিশ তাকে বলতো এমনভাবে মামলা দেবে, যাতে জামিন না পায়। আর সেটাই করেছে তারা। তাতে মহিউদ্দিনের অর্থ, মানসম্মান, কর্মক্ষেত্র সবই শেষ হয়ে গেছে। ১২ দিনের রিমান্ডে নিয়েও তার ওপর অমানবিক নির্যাতন করা হয়েছে। তার দাবি, মিথ্যা স্বীকারোক্তি নিতেই রিমান্ডে নিয়ে ইলেক্ট্রিক শকসহ নানা ধরনের নির্যাতন করা হয়েছে।

যাত্রাবাড়ি থানার সামনে গত ৫ আগস্ট নিহত হন পিকআপ চালক মো. শাহীন ওই ঘটনায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন তার স্ত্রী স্বপ্না বেগম মামলায় ৮৭ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরো ২ হাজার ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে।অথচ স্বপ্না বেগম বলেন, ‘‘আমি মামলায় মাত্র ৪ জনকে আসামি করেছিলাম কিন্তু এত মানুষের নাম কিভাবে মামলায় যুক্ত হলো সেটা আমি জানি না। পুলিশ আমার সঙ্গে কোনো যোগাযোগও করেনি।
আশুলিয়া থানা পুলিশ জানিয়েছে, গত ২৪ অক্টোবর কুলসুম বেগম (২১) নামের এক নারী তার স্বামীকে হত্যার অভিযোগ এনে ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা করেন। এতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ১৩০ জনকে আসামি করা হয়। তিন মাস পরে থানায় হাজির হন তার স্বামী আল আমিন। সেখানে উপস্থিত সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ৫ আগস্ট সে (স্ত্রী) আমার সঙ্গে সিলেটেই ছিল। এর তিন-চার দিন পর ঝগড়া করে মানিকগঞ্জে বাবার বাড়ি চলে যায়। এরপর আর তার সঙ্গে আমার কোনো যোগাযোগ হয়নি। তিন-চার দিন আগে একজনের কাছ থেকে জানতে পারি, আমি ৫ তারিখের (৫ আগস্ট) আন্দোলনে মারা গেছি উল্লেখ করে সে একটা মামলা করেছে। ওই মামলার একজন আসামি আমাকে ফোন দিয়া ঘটনাটি বলছে। এরপরই আমি পুলিশের কাছে যাই। আমি জীবিত আছি। আমার স্ত্রী মিথ্যা মামলা করেছে। আমি এখনো মারা যাইনি। আমি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতেছি।

রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে এই প্রশাসনিক মামলা অস্ত্রের ব্যবহার পুরোনো। আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ হিসেবে যারাই মাঠে ছিলেন, গত পনেরো বছরে তারা তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন। আদালত চত্বরে আরও কয়েকজন রাজনৈতিক নেতাকর্মী গণমাধ্যমের সাথে কথা বলেন। তাদের মধ্যে অনেকের ঘাড়ে রয়েছে শতাধিক মামলা। অনেকে আবার হত্যা মামলারও আসামি হয়েছেন। ১৫ বছর ধরে আর্থিক ও সামাজিকভাবে হেয় হচ্ছেন। কিছু মামলা প্রত্যাহার হলেও এখনও অনেকের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে বলে অভিযোগ তাদের।
বিএনপির দাবি, তাদের নেতাকর্মীদের নামে লক্ষাধিক মামলা হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিচারিক প্রক্রিয়ায় বড় বড় নেতাদের বিরুদ্ধে করা বেশ কিছু মামলা বাতিল হয়েছে। রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তে ঢাকার আরও প্রায় হাজারখানেক মামলা প্রত্যাহারের অপেক্ষায় রয়েছে। কিন্তু কেন্দ্র পর্যন্ত যাদের পৌঁছানোর সক্ষমতা নেই, তাদের অনেকেই রয়ে গেছেন হিসেবের বাইরে।

আওয়ামী লীগ এখন দাবি করছে, তাদের নেতাকর্মীদের ওপর নির্যাতন চালানো হচ্ছে। তৃণমূল থেকে সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত নেতাকর্মীদের নামে মিথ্যা মামলা দেওয়া হচ্ছে। বর্তমান সরকার বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতনের স্টিম রোলার চালাচ্ছে। রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে হয়রানিমূলক মামলা দিচ্ছে। সারা দেশে বাছ-বিচার ছাড়াই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে গণগ্রেপ্তার চালানো হচ্ছে। যাদের নামে মামলা নেই, তাদের গ্রেপ্তার করে মামলায় অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। নেতাকর্মীদের সংগঠন করার সাংবিধানিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে। এতে এ সংগঠনের প্রতি সরকারের হিংসাত্মক ও বিদ্বেষমূলক মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ ঘটছে।

ঢাকা মহানগর আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর আইনজীবী ওমর ফারুক ফারুকী জানিয়েছেন, কিছু মামলা আইনি প্রক্রিয়ায় আর কয়েকটি রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তে প্রত্যাহার করা হচ্ছে। এর মধ্যে অনেকগুলো মামলা শেষও হয়েছে। থানায় দায়ের হওয়া মামলাগুলো মিথ্যা ও গায়েবি উল্লেখ করে তিনি বলেন, সরকার চাইলে সেগুলো তদন্ত কর্মকর্তাদের মাধ্যমে চূড়ান্ত রিপোর্ট দিয়ে শেষ করতে পারেন। এদিকে, রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হলেও মামলা নামক রাজনৈতিক এ অস্ত্রের ব্যবহার বন্ধ হয়নি। অভিযোগ রয়েছে, এবার রাজনৈতিক মামলার শিকার হচ্ছেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা।

কাউকে হয়রানির জন্য মিথ্যা মামলা দায়ের করলে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এক সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তিতে মন্ত্রণালয় বলেছে, চাঁদাবাজি, ব্ল্যাকমেইলিংসহ নানারকম হয়রানির উদ্দেশ্যে বিভিন্ন ব্যক্তির বিরুদ্ধে হত্যা মামলাসহ বিভিন্ন ধরনের মিথ্যা মামলা দেওয়া হচ্ছে। এ ধরনের উদ্দেশ্যমূলক মামলা দায়ের বাংলাদেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী ফৌজদারি অপরাধ। এ সকল কর্মকাণ্ডে জড়িতদের কঠোরভাবে হুঁশিয়ারি প্রদানসহ তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে ইতোমধ্যে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। মিথ্যা মামলাকারীদের বিরুদ্ধে জাতীয় জরুরি সেবা নম্বর ৯৯৯ এ অভিযোগ বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জানানোর অনুরোধ করা হয়েছে বিজ্ঞপ্তিতে।

এমটি/ এএটি

নিউজটি শেয়ার করুন

রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েলে বড় অস্ত্র মামলা

আপডেট সময় : ০৪:৪৮:২৯ অপরাহ্ন, সোমবার, ২১ এপ্রিল ২০২৫

# রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হলে নাম/পদবি পরিবর্তন হয়, বদলায় না মামলার ধরন
# থানায় দায়ের হওয়া মামলা বেশিরভাগই মিথ্যা ও গায়েবি
# মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা করলে ব্যবস্থা : স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়

ঢালাও মামলা বাংলাদেশে নতুন কিছু নয়। বিগত সরকারের তিন মেয়াদের শেষ সাট-আট বছর ঢালাও মামলা এক ভয়াবহ আকার ধারন করেছিল। পুলিশ মামলা দিয়ে দিতো শত শত মানুষের নামে। মামলা যাদের নামে দেওয়া হতো, তাদের মধ্যে সকলেই বিরোধী দলগুলোর নেতা-কর্মী থাকতো। এরপর গ্রেপ্তার, পুলিশি হয়রানি, মামলা বাণিজ্য এসব মিলে আইন ও পুলিশ পরিণত হয়েছিল নিপীড়নের হাতিয়ারে। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরে ৮ আগস্ট অর্ন্তবর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে। ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থানের মূল চেতনা ছিল রাষ্ট্র সংস্কার। সেই সংস্কারের কেন্দ্রে রয়েছে আইনের শাসন ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা, পুলিশ, প্রশাসন ও বিচার বিভাগের সংস্কার, সামষ্টিক অর্থনীতির শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা, এবং একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু অর্ন্তবর্তী সরকার তাদের প্রথম চ্যালেঞ্জ স্থিতিশীল আইন-শৃঙ্খলা ব্যবস্থা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত তেমন একটা সফলতার পরিচয় দিতে পারেনি।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত বাংলাদেশের বিভিন্ন থানায় কয়েক শতাধিক মামলা হয়েছে। অধিকাংশ মামলায় শেখ হাসিনা ছাড়া তার সরকারের সাবেক মন্ত্রী, এমপি, সাবেক সামরিক কর্মকর্তা, আওয়ামী লীগের নেতা, পুলিশের সাবেক আইজিপি, ডিএমপির সাবেক কমিশনারসহ পুলিশের বিভিন্ন পদমর্যাদার কর্মকর্তাকে আসামি করা হয়েছে। মামলাগুলোতে অভিযোগ আনা হয়েছে, গত ১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মী ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা গুলি ছোঁড়েন। এতে অনেক আন্দোলনকারী গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন। আহত হন অনেকে।

দেখা যায় হত্যা মামলা যার-তার নামে হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে প্রকৃত বাদীও জানেন না, কোথায় কে তাঁর আপনজন হত্যার বিচার চেয়ে মামলা ঠুকেছে। জীবিত ব্যক্তি হঠাৎ জানতে পারেন তাকে মৃত দেখিয়ে হয়ে গেছে মামলা, চলছে দেদার অর্থ উপার্জন! স্বামীকে হত্যার অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ ১৩০ জনের বিরুদ্ধেমামলা করে এক নারী। মামলা দায়েরের তিন মাস পর ওই নারীর স্বামী থানায় হাজির হয়ে জানান তিনি জীবিত। ঘটনাটা ঘটেছে ঢাকার আশুলিয়ায়। এমন অনেক মামলার খবরও জানা যাচ্ছে, যেখানে একটি হত্যার ঘটনায় একাধিক মামলা হয়েছে। অনেক জায়গায় মামলা নিয়ে বাণিজ্যের অভিযোগও উঠেছে।

শেখ হাসিনার করা মামলা নামক শেঁকল থেকে এখনও মুক্ত হতে পারেননি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা। আদালতের দ্বারে দ্বারে হাজিরা দিয়ে সর্বস্ব হারিয়েছেন কেউ কেউ। পারিবারিক জীবনেও পড়েছে বিরূপ প্রভাব। এরকমই এক ব্যক্তি সম্প্রতি ঢাকার আদালত পাড়ায় গণমাধ্যমের সাথে কথা বলেন। তার নাম মোহাম্মদ মহিউদ্দিন, পেশায় ব্যবসায়ী। পরিবার নিয়ে থাকেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের প্রতিটি কোণা তার পরিচিত। গত দশ বছর ধরে নিয়মিত চলাফেরা করছেন আদালত চত্বরে। তার বিরুদ্ধে থাকা মামলায় অভিযোগ রয়েছে, তিনি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছেন। যদিও তার দাবি রাজনৈতিক পরিচয়ই তার মূল অপরাধ। মহিউদ্দিনের দাবি, পুলিশ তাকে বলতো এমনভাবে মামলা দেবে, যাতে জামিন না পায়। আর সেটাই করেছে তারা। তাতে মহিউদ্দিনের অর্থ, মানসম্মান, কর্মক্ষেত্র সবই শেষ হয়ে গেছে। ১২ দিনের রিমান্ডে নিয়েও তার ওপর অমানবিক নির্যাতন করা হয়েছে। তার দাবি, মিথ্যা স্বীকারোক্তি নিতেই রিমান্ডে নিয়ে ইলেক্ট্রিক শকসহ নানা ধরনের নির্যাতন করা হয়েছে।

যাত্রাবাড়ি থানার সামনে গত ৫ আগস্ট নিহত হন পিকআপ চালক মো. শাহীন ওই ঘটনায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন তার স্ত্রী স্বপ্না বেগম মামলায় ৮৭ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরো ২ হাজার ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে।অথচ স্বপ্না বেগম বলেন, ‘‘আমি মামলায় মাত্র ৪ জনকে আসামি করেছিলাম কিন্তু এত মানুষের নাম কিভাবে মামলায় যুক্ত হলো সেটা আমি জানি না। পুলিশ আমার সঙ্গে কোনো যোগাযোগও করেনি।
আশুলিয়া থানা পুলিশ জানিয়েছে, গত ২৪ অক্টোবর কুলসুম বেগম (২১) নামের এক নারী তার স্বামীকে হত্যার অভিযোগ এনে ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা করেন। এতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ১৩০ জনকে আসামি করা হয়। তিন মাস পরে থানায় হাজির হন তার স্বামী আল আমিন। সেখানে উপস্থিত সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ৫ আগস্ট সে (স্ত্রী) আমার সঙ্গে সিলেটেই ছিল। এর তিন-চার দিন পর ঝগড়া করে মানিকগঞ্জে বাবার বাড়ি চলে যায়। এরপর আর তার সঙ্গে আমার কোনো যোগাযোগ হয়নি। তিন-চার দিন আগে একজনের কাছ থেকে জানতে পারি, আমি ৫ তারিখের (৫ আগস্ট) আন্দোলনে মারা গেছি উল্লেখ করে সে একটা মামলা করেছে। ওই মামলার একজন আসামি আমাকে ফোন দিয়া ঘটনাটি বলছে। এরপরই আমি পুলিশের কাছে যাই। আমি জীবিত আছি। আমার স্ত্রী মিথ্যা মামলা করেছে। আমি এখনো মারা যাইনি। আমি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতেছি।

রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে এই প্রশাসনিক মামলা অস্ত্রের ব্যবহার পুরোনো। আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ হিসেবে যারাই মাঠে ছিলেন, গত পনেরো বছরে তারা তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন। আদালত চত্বরে আরও কয়েকজন রাজনৈতিক নেতাকর্মী গণমাধ্যমের সাথে কথা বলেন। তাদের মধ্যে অনেকের ঘাড়ে রয়েছে শতাধিক মামলা। অনেকে আবার হত্যা মামলারও আসামি হয়েছেন। ১৫ বছর ধরে আর্থিক ও সামাজিকভাবে হেয় হচ্ছেন। কিছু মামলা প্রত্যাহার হলেও এখনও অনেকের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে বলে অভিযোগ তাদের।
বিএনপির দাবি, তাদের নেতাকর্মীদের নামে লক্ষাধিক মামলা হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিচারিক প্রক্রিয়ায় বড় বড় নেতাদের বিরুদ্ধে করা বেশ কিছু মামলা বাতিল হয়েছে। রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তে ঢাকার আরও প্রায় হাজারখানেক মামলা প্রত্যাহারের অপেক্ষায় রয়েছে। কিন্তু কেন্দ্র পর্যন্ত যাদের পৌঁছানোর সক্ষমতা নেই, তাদের অনেকেই রয়ে গেছেন হিসেবের বাইরে।

আওয়ামী লীগ এখন দাবি করছে, তাদের নেতাকর্মীদের ওপর নির্যাতন চালানো হচ্ছে। তৃণমূল থেকে সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত নেতাকর্মীদের নামে মিথ্যা মামলা দেওয়া হচ্ছে। বর্তমান সরকার বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতনের স্টিম রোলার চালাচ্ছে। রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে হয়রানিমূলক মামলা দিচ্ছে। সারা দেশে বাছ-বিচার ছাড়াই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে গণগ্রেপ্তার চালানো হচ্ছে। যাদের নামে মামলা নেই, তাদের গ্রেপ্তার করে মামলায় অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। নেতাকর্মীদের সংগঠন করার সাংবিধানিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে। এতে এ সংগঠনের প্রতি সরকারের হিংসাত্মক ও বিদ্বেষমূলক মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ ঘটছে।

ঢাকা মহানগর আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর আইনজীবী ওমর ফারুক ফারুকী জানিয়েছেন, কিছু মামলা আইনি প্রক্রিয়ায় আর কয়েকটি রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তে প্রত্যাহার করা হচ্ছে। এর মধ্যে অনেকগুলো মামলা শেষও হয়েছে। থানায় দায়ের হওয়া মামলাগুলো মিথ্যা ও গায়েবি উল্লেখ করে তিনি বলেন, সরকার চাইলে সেগুলো তদন্ত কর্মকর্তাদের মাধ্যমে চূড়ান্ত রিপোর্ট দিয়ে শেষ করতে পারেন। এদিকে, রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হলেও মামলা নামক রাজনৈতিক এ অস্ত্রের ব্যবহার বন্ধ হয়নি। অভিযোগ রয়েছে, এবার রাজনৈতিক মামলার শিকার হচ্ছেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা।

কাউকে হয়রানির জন্য মিথ্যা মামলা দায়ের করলে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এক সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তিতে মন্ত্রণালয় বলেছে, চাঁদাবাজি, ব্ল্যাকমেইলিংসহ নানারকম হয়রানির উদ্দেশ্যে বিভিন্ন ব্যক্তির বিরুদ্ধে হত্যা মামলাসহ বিভিন্ন ধরনের মিথ্যা মামলা দেওয়া হচ্ছে। এ ধরনের উদ্দেশ্যমূলক মামলা দায়ের বাংলাদেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী ফৌজদারি অপরাধ। এ সকল কর্মকাণ্ডে জড়িতদের কঠোরভাবে হুঁশিয়ারি প্রদানসহ তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে ইতোমধ্যে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। মিথ্যা মামলাকারীদের বিরুদ্ধে জাতীয় জরুরি সেবা নম্বর ৯৯৯ এ অভিযোগ বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জানানোর অনুরোধ করা হয়েছে বিজ্ঞপ্তিতে।

এমটি/ এএটি