টেলকো পলিসি: প্রজন্মগত রূপান্তরের নীতিমালা – ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব

- আপডেট সময় : ১২২ বার পড়া হয়েছে
গতকাল (১২ জুলাই) রাজধানীর হলিডে ইন হোটেলে “টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্ক এবং লাইসেন্সিং অবকাঠামো” শীর্ষক একটি গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে বিভিন্ন স্টেকহোল্ডার অংশগ্রহণ করেন এবং নতুন টেলিকম নীতিমালা নিয়ে নিজেদের মতামত তুলে ধরেন।
প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে প্রধান উপদেষ্টার ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব স্টেকহোল্ডারদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন এবং নীতিমালার দৃষ্টিভঙ্গি পরিষ্কারভাবে তুলে ধরেন।
যুগোপযোগী পলিসি প্রণয়ন:
বৈঠকে জিপি, বাংলালিংক, টেলিটক এই পলসিকে সময়োপযোগী বলে স্বাগত জানিয়েছেন।
রবি ফ্যাসিস্ট রেজিমের পলিসিকে রেফার করলে তা নিয়ে বিভ্রান্ত না হতে স্টেক হোল্ডারদের অনুরোধ করেন ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব। তিনি বলেন, যুগোপযোগী এই পলিসি স্টাব্লিশের মাধ্যমে পূর্বতন পলিসিটি বাতিল করা হবে।
A Generational Transformative Policy:
ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব বলেন,
বাংলাদেশ সমতল ভূমি হওয়া স্বত্তেও জলবায়ুর অভিঘাত, অত্যন্ত বেশি জনঘনত্ব বিদ্যমান থাকার কারণে টেলিকমিউনিকেশন নেটওয়ার্ক এর সুবিধা নিতে পারেনি। শহর ও গ্রামের সুনির্দিষ্ট স্ট্রাকচারাল প্লানিং না থাকার কারনে রেডিও প্রপাগেশন ইঞ্জিনিয়ারিং এফিশিয়েন্ট হতে পারেনি। তদুপরি বিগত সরকারের আমলে পলিটিক্যালি মোটিভেটেড হয়ে অর্থ ও ক্ষমতার বিনিময়ে প্রায় ৩,৪০০ টির অধিক লাইসেন্স ইস্যু করা হয় এই সেক্টরে – সারা বিশ্বে এরকম উদাহরণ খুজে পাওয়া দায়। এমতাবস্থায় পূর্বতন ILTDS পলিসিটি পরিস্থিতি আরো জটিল করে ব্যাবসা বান্ধব পরিবেশ বজায় রাখতে পারেনি। অত্যধিক লাইসেন্স প্রদান ও কিছু প্রতিষ্ঠানের অকার্যকারিতা টেলিকম সার্ভিসের গুণগত পরিবর্তনের অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই জঞ্জালময় পরিস্থিতির উপর দাঁড়িয়ে একটি Generational Transformative Policy গ্রহণ করা অর্থাৎ Connectivity থেকে Digital Service বান্ধব নেটওয়ার্ক এর রূপরেখা প্রণয়ন সত্যিই একটি দূরুহ কাজ। Connectivity সম্প্রসারণের সাথে সাথে তার Usefulness নিয়ে প্রগ্রেস নেই বললেই চলে । এখন পর্যন্ত শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি খাতে টেলিকমিউনিকেশনের Significant অবদান দেখা যাচ্ছে না। এজন্যই এই সময়ে একটি Prescriptive Policy কাঠামো গ্রহণ করার উদোগ নেয়া হয়েছে যার সফল বাস্তবায়ন ইকোসিস্টেমের সমস্ত প্লেয়ারদের হাতে ন্যস্ত।
এই উত্তরনের একটি পথ রেডিও তরঙ্গ ব্যবস্থাপনা – বিশেষত Lower Band অবমুক্তকরণ। ইন্টারনেট সঞ্চারিত করতে হলে তার গুণগত মান বজায় রাখতে হয় যেটি বহুদিন থেকে উপেক্ষিত। 4G/LTE এর সম্প্রসারণ হয়েছে উল্টা পথে – যেমন Lower Band তরঙ্গ 2G তে ব্যবহার হবার ফলে একই সাইটে যখন Higher Band এ 4G নেটওয়ার্ক দেয়া হয়েছে তখন তার কাভারেজ এক তৃতীয়াংশ কমে গেছে। যেখানে 4G নেটওয়ার্ক Lower Band এ দিয়ে সম্প্রসারণ করা যেত সেখানে তা দেয়া হয়েছে Higher Band Coverage লেয়ারে। অর্থাৎ উল্টো পথে হাটছে আমাদের টেলিকমিউনিকেশন নেটওয়ার্ক বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
তিনি আরো বলেন, উত্তরনের অপর একটি পথ ‘ফাইবারাইজেশন’ । টেলকো সেবার QoS মানোন্নয়ন, ডিজিটাল সার্ভিসের প্রসার, এবং জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবেলায় বেইজ স্টেশন ফাইবারাইজেশন করা অত্যন্ত জরুরি। যা বর্তমানে মাত্র ৩৫% তা আগামী ২ বছরে ৮০% করার প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। এই পরিবর্তন বাংলাদেশকে গ্লোবাল ডিজিটাল ইন্ডেক্সে উন্নত করবে এবং একই সাথে সেবা প্রদান সহজতর করবে।
পলিসি পরিবর্তন বিষয় তিনি বলেন,
পরিবর্তন তিন ভাবে হতে পারে – (১) Optimization, (২) Change Management, (৩) Reform Agenda – এই পলিসি Reform Agenda ভিত্তিক অর্থাৎ বিদ্যমান অচল ইকোসিস্টেমকে রিপ্লেসিং করা। মূলত এতে সবার স্বার্থে আঘাত আসতে পারে এটাই স্বাভাবিক। এ নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে উত্তরণের পথ খুঁজতে হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
বিদ্যমান লাইসেন্সে বৈদেশিক বিনিয়োগ সম্পর্কে ফয়েজ আহমদ বলেন,
বিদ্যমান লাইসেন্স ব্যবস্থাপনার আরোও একটি মারাত্বক দিক হচ্ছে এটি একদিকে যেমন FDI বান্ধব নয় অন্যদিকে লোকাল ইনভেস্টমেন্ট কেও প্রমোট করেনা। এখানে একটি বৈষম্য রয়েছে। যেমন মোবাইল অপেরেটররা সামষ্ঠিকভাবে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকার অধিক বিনিয়োগ করলেও তাদের গ্রস প্রফিটাবিলিটি ইনফ্লেশন এডজাস্ট করার পরে নেগেটিভ। অন্যদিকে non value adding লাইসেন্স অপারেটর রা মাত্র ৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে বছরে প্রায় ৮০০ কোটি টাকা রেভিনিউ পায় যার ৫০% তাদের মুনাফা। অর্থাৎ তারা এক বছরেই ৪০০ কোটি টাকা মুনাফা করে। এবং এই সমুদয় অর্থ গ্রাহকের পকেট থেকে নেয়া হচ্ছে। অর্থাৎ তারা রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্যবহার করে Toll Collector হিসেবে মার্কেট থেকে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। এ ব্যবস্থার পরিবর্তন প্রয়োজন। সে লক্ষ্যে এই পলিসিতে এই লেয়ারগুলো পর্যায়ক্রমে বাতিল করা হবে। অর্থাৎ লাইসেন্সধারী এই সব প্রতিষ্ঠান তাদের লাইসেন্স এর মেয়াদ থাকা অবস্থায় কার্যক্রম পরিচালন করতে পারবেন কিন্তু লাইসেন্সের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে তাদের নতুন পলিসির আয়তায় আনা হবে। এটি করা হয়েছে ইনভেস্টমেন্ট সুরক্ষা এবং বিজনেস ট্রান্সফর্মেশন এর লক্ষ্যে।
এমন একটি স্তরের লাইসেন্সধারীরা প্রায়শই বিভ্রান্ত হচ্ছেন –
প্রকৃতপক্ষে লাইসেন্স ডি-রেগুলেশন বিজনেস ট্রান্সফর্মেশন এর একটি সুযোগ তৈরি করে । কারন লাইসেন্স শুধুমাত্র এই লেয়ারটি ডি-রেগুলেট করেছে, প্রায়গিক দিকগুলোকে নয়। অর্থাৎ তারা তাদের স্থাপনা সমূহ শেয়ারিং এর মাধ্যমে বিজনেস ট্রাইন্সফর্মেশন করতে পারবেন। এরূপ শেয়ারিং কে স্বাগত জানানো হয়েছে এই পলিসির অন্তর্নীহিত প্রস্তাবনায়। তারা তাদের Softswitch, TMSC শেয়ার করতে পারেন অপারেটরদের সাথে শুধুমাত্র একটি দ্বিপাক্ষিক চুক্তির মাধ্যমে। লাইসেন্স তাদের কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্থ করবে না বরং মার্কেট একটি ভলান্টারি পার্টিসিপেশনের দিকে এগিয়ে যাবে বলে উল্লেখ করেন বিশেষ সহকারী।
ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব বলেন,আমরা এই ভলান্টারি পার্টিসিপেশনকে স্বাগত জানাই। ইন্ডাস্ট্রির ভিন্ন ভিন্ন লেয়ারের ইকোসিস্টেমের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধানের দিকে জোর তাগিদ দেয়া হচ্ছে। পলিসি প্রণয়নের কাজটি সম্পাদন করার পরে বিভিন্ন প্রায়গিক বিষয় নিয়ে গাইডলাইন প্রকাশ করা হবে।
ISPAB এর তরফ থেকে ব্যান্ডউইথ পারচেজ প্রাইস নিয়ে MNO এর তুলনায় বৈষম্যের সম্মুখীন হচ্ছে জানালে তাদের ধারনা পরিষ্কার করতে তিনি বলেন, MNO দের উচ্চ মূল্যে স্পেকট্রাম লাইসেন্স নিতে হয় যা ISPAB দের নিতে হয় না। তাই ব্যান্ডউইথ প্রাইসের এই তারতম্য যৌক্তিক।
টেলকোকে ইকোসিস্টেমের সবাইকে বিভিন্ন বিষয়ে নিজ নিজ স্বার্থ ছাড় দিয়ে পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধান করার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়। নিজেদের মধ্যে সমঝোতা না থাকলে সরকার সবচেয়ে ভালো নীতিমালা দিলেও তা কার্যকর হবে না বলেও বিশেষ সহকারী মন্তব্য করেন।
টেলকোকে সার্ভিস ওরিয়েন্টেড করা:
বাংলাদেশে টেলকো এখন পর্যন্ত সার্ভিস ওরিয়েন্টেড হতে পারেনি। এই পলিসির মাধ্যমে ডিজিটাল সার্ভিস প্রদানের ক্ষেত্র তৈরি করা হচ্ছে। এছাড়াও ইনইকুয়েলিটি, ক্লাইমেট চেঞ্জ, ইত্যাদি বিষয়গুলোকে পলেসিতে বিবেচনায় আনা হয়েছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
পলিসিতে লাইসেন্সের সংখ্যা কত হবে এমন প্রশ্নের জবাবে ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব বলেন,পলিসিতে আইএসপি লাইসেন্সের সংখ্যা কত হবে তা নির্ভর করবে লাইসেন্স অবলিগেশন এন্ড কেপিআই পারফরমেন্সের উপর। তবে বিটিআরসি বেসরকারি গবেষণা সংস্থার মাধ্যমে জানতে পারবে কি পরিমাণ লাইসেন্স লাগবে বা কি পরিমাণ লাইসেন্স থাকলে অপটিমাল হয়।
নতুন বিনিয়োগকারীদের জন্য সুযোগ তৈরি প্রসঙ্গে তিনি বলেন,পলিসিতে নতুন বিনিয়োগকারীদের জন্য ব্যবসা করার সুযোগ তৈরি হবে। তবে লাইসেন্স সংখ্যার অজুহাতে নতুন বিনিয়োগকারীদের বাধা দেওয়া যাবে না। নতুন লাইসেন্স নিয়ে যারা আসবে তারা আরও বেশি শক্তিশালী হয়ে কাজ করবে। লাইসেন্স লিমিটেড হবেনা।
বিদেশি কোম্পানির দেশীয় প্রতিনিধিদের দেশের স্বার্থ রক্ষার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন,
নতুন পলিসিতে বিদেশি কোম্পানির দেশীয় প্রতিনিধিরা দেশের বৃহত্তম স্বার্থ রক্ষায় কাজ করার প্রত্যয় নিয়ে এগিয়ে যাবেন বলে তিনি প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন।
তরঙ্গ বরাদ্দ – লাইসেন্স প্রাইসকে পলিসিতে অর্ন্তভুক্ত করার বিষয়ে তিনি বলেন,
নতুন পলিসিতে তরঙ্গ বরাদ্দ প্রাইসকে রোলআউট কষ্ট হিসেবে অর্ন্তভুক্ত করা হয়েছে।
ডেমোক্রেটিক উপায়ে পলিসি প্রণয়ন প্রসঙ্গে তিনি জানান,
সম্পূর্ণ ডেমোক্রেটিক উপায়ে পলিসি প্রণয়ন করা হচ্ছে। তিনি পলিসি নিয়ে ব্যক্তিগতভাবে সবার সাথে কথা বলেছেন। সকলের যৌক্তিক মতামত গ্রহণ করে পলিসি প্রণয়ন করা হচ্ছে। তারপরও নতুন পলিসি প্রণয়নে নেগোসিশনের জায়গা সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
পরিশেষে তিনি এই নতুন রিফর্মর্ড টেলিকমিউনিকেশন পলিসিতে সব প্লেয়াররা একটি সাসটেইনেবল, যুগোপযোগী, ডিজিটাল সার্ভিস সঞ্চালনে মনোযোগী এবং সর্বোপরি নাগরিক কেন্দ্রিক সেবা প্রদানে সচেষ্ট থাকবেন বলে প্রত্যাশা ব্যক্ত করে তিনি অনুষ্ঠানের পরিসমাপ্তি জ্ঞাপন করেন।