ভেস্তে গেছে বিকল্প পাটের ব্যাগ প্রকল্প

- আপডেট সময় : ৯ বার পড়া হয়েছে
অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর নিষিদ্ধ পলিথিন বন্ধে বেশ তোড়জোড় শুরু করে। সুপারশপে পলিথিন বন্ধের পদক্ষেপ প্রায় সফল। খোলাবাজারে বন্ধ হয়নি পলিথিন। বাজারে যা অন্য সময়ের মতোই দেখা যাচ্ছে। এমন প্রেক্ষাপটে পরিবেশসম্মত ব্যাগ উৎপাদনে এগিয়ে এসেছেন বেশ কিছু উদ্যোক্তা। কিন্তু তাঁরা কারখানা স্থাপনের পর বর্তমানে অসহায়। ভুট্টার স্টার্চ দিয়ে তৈরি ব্যাগ উৎপাদনের অনুমতিই পাচ্ছেন না তাঁরা। ঘুরতে হচ্ছে পরিবেশ অধিদপ্তরের দ্বারে দ্বারে। অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা উদ্যোক্তাদের নানা অজুহাত দেখাচ্ছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অন্তত তিনজন উদ্যোক্তা ভুট্টার স্টার্চ দিয়ে বায়ো ডিগ্রেডেবল বা পচনশীল ব্যাগ তৈরি করতে আগ্রহী। কিন্তু তিন বছর ধরে চেষ্টা করেও তাঁরা এখনো পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র পাননি। এর মধ্যে রয়েছে রাজশাহীর ক্রিস্টাল বায়োটেক নামের একটি প্রতিষ্ঠান।
তিন বছর ধরে ঘুরেও ভুট্টার স্টার্চে তৈরি ব্যাগ উৎপাদনের অনুমতি পায়নি প্রতিষ্ঠানটি। অন্যদিকে গোপালগঞ্জের জে কে পলিমার নামের আরেকটি প্রতিষ্ঠান কারখানা স্থাপন করেছে। এখন চলছে ট্রায়াল। ওই প্রতিষ্ঠানটিও মাসখানেক আগে পরিবেশ অধিদপ্তরে আবেদন করে এখনো ছাড়পত্র পায়নি। বিষয়টি নিয়ে রাজশাহীর ক্রিস্টাল বায়োটেকের স্বত্বাধিকারী ইফতেখারুল হক বলেন, আবেদন করার পর প্রায় তিন বছর হয়ে গেছে। পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে আমাদের ছাড়পত্র দেয়নি। আমাদের আবেদনপত্রটি বর্তমানে ঢাকায় আছে। কিসের জন্য ছাড়পত্র দিচ্ছেন না, উনারাই ভালো জানেন। একেক সময় একেক ধরনের অজুহাত দেখাচ্ছেন। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কিংবা অন্য কিছুও হতে পারে। আমি পরিবেশের জন্য কাজ করছি, অথচ পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র পাচ্ছি না। আমাদের কারখানা থেকে কোনো বর্জ্য নির্গত হয় না, সবুজ ক্যাটাগরির অন্তর্গত। আমাদের এই ব্যাগ পরিবেশ সম্মত। মাটিতে এক মাসের মধ্যে পচে যায়। ব্যাগে ব্যবহৃত উপাদান মাটির ক্ষতিও করে না। কিন্তু তার পরও আমরা কেন ছাড়পত্র পাচ্ছি না তা আমার বোধগম্য নয়।
বিষয়টি নিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তাঁরা ভুট্টার স্টার্চ থেকে তৈরি ব্যাগের ছাড়পত্রের বিষয়ে পরিষ্কার করে কিছু বলতে রাজি হননি।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বছর গত বছর ৯ সেপ্টেম্বর জানিয়েছিলেন, ২০২৪ সালের ১ অক্টোবর থেকে সুপারশপে কোনো পলিথিন বা পলিপ্রপাইলিনের ব্যাগ ব্যবহার করা যাবে না। বিকল্প হিসেবে কাগজ, পাট ও কাপড়ের ব্যাগ ক্রেতাদের দিতে হবে। আর ১ নভেম্বর থেকে খুচরা বাজারেও এসব ব্যাগ ব্যবহার করা যাবে না। সেই ঘোষণা অনুযায়ী দেশের বেশির ভাগ সুপারশপই সরকারের ওই নির্দেশনা মেনে চলার চেষ্টা করছে। বছর ঘুরে এলেও এ প্রকল্প বাস্তবতার মুখ দেখেনি। বন্ধ হয়নি পলিথিন। কাঁচাবাজার থেকে শুরু করে সর্বত্রই গিলে খাচ্ছে পলিথিন। দখলে রেখেছে পলিথিন। তা ছাড়া পুরনো ঢাকার চকবাজার, চুড়িহাট্টা, লালবাগ, ইসলামবাগ, উর্দুরোড, নাজিম উদ্দিন রোড, তাঁতখানা লেন এলাকায় দিনরাতে পুরোদমে চলছে পলিথিন উৎপাদন। সেখান থেকে রাতে থানা পুলিশ ম্যানেজ করে শত শত ট্রাক বোঝাই করে পলিথিন চলে যাচ্ছে দেশের জেলা, বিভাগ, উপজেলাসহ প্রত্যন্ত অঞ্চলে। দেখার কেউ নেই।
সম্প্রতি রিজওয়ানা হাসান বলেছিলেন, পাহাড় কাটা, বায়ুদূষণ এবং নিষিদ্ধ পলিথিনের বিরুদ্ধে যৌথ অভিযান জোরদার করা হবে। এ লক্ষ্যে জেলা প্রশাসন, সিটি করপোরেশন ও পরিবেশ অধিদপ্তর যৌথভাবে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করবে। পলিথিন উৎপাদনকারীদের তালিকা করে তাদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হবে। তিনি আরো বলেছিলেন, পাট-চট দিয়ে আমরা পলিথিনের বিকল্প করব। তাহলে আমাদের দেশীয় শিল্প উঠে আসবে। বায়োপ্লাস্টিক ব্যাগ (উৎপাদনকারীদের) নিয়ে আমরা বসব। এবং এটাকে সনদ দেওয়া যায় কি না আমরা সেটা দেখব। সনদ ছাড়া মার্কেটে এটাকে ঢুকতে দেব না। পাট আর চট নিয়ে কেন অনীহা।
তবে বর্তমানে যারা পাটের ব্যাগ তৈরি করছেন, তাদের মধ্যে একজন উদ্যোক্তা জানান, বাজারে পর্যাপ্ত পাট পাওয়া যাচ্ছে না। ব্যাগের যে পরিমাণ চাহিদা রয়েছে, তা পাটের অভাবে প্রস্তুত করা যাচ্ছে না। অন্যদিকে পলিথিনের ব্যবহার কমাতে খুচরা বাজারে তেমন পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না, খুচরা বাজারে বাড়েনি পলিথিনের দাম। কমেনি সরবরাহ। এক কথায় কাঁচাবাজার গিলে খাচ্ছে পলিথিনে। আর ভুট্টার স্টার্চ দিয়ে যেসব উদ্যোক্তা পরিবেশসম্মত ব্যাগ তৈরিতে কারখানা স্থাপন করছেন, তাঁরা পাচ্ছেন না পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র।
এবিষয়ে চট্টগ্রামের আর্থ ম্যাটারস লিমিটেড ভুট্টার স্টার্চের তৈরি পচনশীল ব্যাগ উৎপাদনের অনুমতি পেয়েছে। তাদের ব্যাগ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ও আমেরিকায় গার্মেন্ট পণ্যের প্যাকেট হয়ে রপ্তানি হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশের বাজারে প্রতিষ্ঠানটি আনুষ্ঠানিকভাবে বিক্রির অনুমতি পায়নি। এ নিয়ে পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের সঙ্গে তাঁরা বৈঠক করেছেন। এই ব্যাগ আনুষ্ঠানিকভাবে বাজারজাত করার অনুমতি দেওয়া যায় কি না তা দেখবেন বলে জানিয়েছেন উপদেষ্টা।
আর্থ ম্যাটারস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আজিমুল ইসলাম বলেন, আমাদের এই ব্যাগ তৈরিতে যেসব উপাদান ব্যবহার করা হয়, তা বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) পরীক্ষা করা হয়। বুয়েট পরীক্ষায় ৯ ধরনের পদার্থের উপস্থিতি পরীক্ষা করে, যা আমেরিকান মান অনুযায়ী সর্বোচ্চ উপস্থিতির চেয়ে অনেক কম মাত্রায় রয়েছে। সুতরাং এই ব্যাগ আনুষ্ঠানিকভাবে দেশের বাজারে পলিথিনের বিকল্প হিসেবে বাজারজাত করার অনুমতি দেওয়া উচিত। অন্যদিকে আমাদের উৎপাদিত ব্যাগের দাম তিন থেকে ১৫ টাকার মধ্যে।
অপরদিকে পাটের হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনতে সমন্বিত উদ্যোগের আহ্বান জানান বানিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশির উদ্দীন। বশিরউদ্দীন বলেছেন, বাংলাদেশকে পরিবেশ বান্ধব পণ্যের বিশ্ববাজারে একটি কেন্দ্রস্থল হিসেবে গড়ে তুলতে পাট খাতকে নতুন করে জাগিয়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যে গবেষণা, বিনিয়োগ এবং বিপণনে সরকার ও বেসরকারি খাতের মধ্যে সমন্বিত প্রচেষ্টার প্রয়োজন। গত বুধবার জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এফএও সদর দপ্তরে সংস্থাটির সাউথ-সাউথ অ্যান্ড ট্রায়াঙ্গুলার কো-অপারেশন বিভাগের পরিচালক আনপিং ইয়ি-এর সঙ্গে এক বৈঠকে তিনি এ কথা বলেন।
বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেন, আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে পাটের সোনালি অতীত ফিরিয়ে আনা এবং বাংলাদেশকে বিশ্বব্যাপী পরিবেশবান্ধব পণ্যের একটি প্রধান উৎপাদক ও রপ্তানিকারক দেশে পরিণত করা। পাট ও পাটজাত পণ্যের সঙ্গে দেশের সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য ও অর্থনীতির গভীর সম্পর্ক রয়েছে। এক সময় পাটই ছিল আমাদের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি, এখনও এর গুরুত্ব অপরিসীম।
বৈঠকে আনপিং ইয়ি বলেন, বাংলাদেশ পাট পণ্যের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা বাংলাদেশের পাট খাতে সক্ষমতা বৃদ্ধিতে এবং বাজার সম্প্রসারণে সহযোগিতা করতে আগ্রহী। বর্তমানে বাংলাদেশে একটি অফিস রয়েছে যেখানে দুই শতাধিক জনবল কাজ করছেন, যাদের অধিকাংশই বাংলাদেশি নাগরিক।
তিনি আরও বলেন, পাট পণ্যের উৎপাদন ও বাজার সম্প্রসারণে প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা দেওয়ার ক্ষেত্রে এফএও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ওই বৈঠকে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের সচিব আব্দুর রউফ এবং বাংলাদেশে নিযুক্ত এফএও প্রতিনিধি জিয়াওকুন শি উপস্থিত ছিলেন।