ঢাকা ০৮:৩৪ অপরাহ্ন, সোমবার, ০৪ অগাস্ট ২০২৫
সংবাদ শিরোনাম ::
Logo পটুয়াখালী জেলা বিজেপির আহবায়ক শাওন ও সদস্য সচিব রুমী Logo জকসু নির্বাচনসহ ২ দাবিতে জবি শিক্ষার্থীদের অবস্থান কর্মসূচি Logo নওগাঁয় বর্ণাঢ্য আয়োজনে সপ্তাহব্যাপী বৃক্ষ মেলা শুরু Logo বছরের সাত মাস পানি বন্ধী বিদ্যালয় তিন যুগ ধরে নৌকায় যাতায়াত শিক্ষক-শিক্ষার্থীর Logo ঝিনাইগাতীতে সামান্য বৃষ্টিতেই প্রধান রাস্তায় হাঁটুপানি, দুর্ভোগে পথচারীরা Logo ভান্ডারিয়ায় খাল থেকে যুবকের হাত-পা বাঁধা মরদেহ উদ্ধার,পায়ে বাঁধা ছিল ইট Logo রক্তস্নাত মাগুরার ৪ আগস্ট: যেদিন কলমে রক্ত জমেছিল, চোখে জমেছিল মৃত্যুর আলপনা Logo জয়পুরহাটে গণঅভ্যুত্থানের বর্ষপূতি উপলক্ষে প্রতিবন্ধী মেলা Logo প্রতিবছর নদী ভাঙ্গনে কমছে জমি, গৃহহীন হচ্ছেন হাজারো পরিবার Logo নাটোরে নাহার ফুড প্রোডাক্টস এর পক্ষ থেকে ন্যায্য বাজার মূল্যের বিনিময় পণ্য বিক্রয়

রক্তস্নাত মাগুরার ৪ আগস্ট: যেদিন কলমে রক্ত জমেছিল, চোখে জমেছিল মৃত্যুর আলপনা

প্রতিনিধির নাম
  • আপডেট সময় : ৬৪ বার পড়া হয়েছে
দৈনিক গনমুক্তি অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

তারিখটা শুধু একটা দিন নয়, আমার জীবনের ক্যালেন্ডারে একটা গভীর ছায়া, একটা রক্তাক্ত অধ্যায়।
সেদিন সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে আমি শুধু রিপোর্টার ছিলাম না, হয়ে উঠেছিলাম একজন মানুষ—রক্তমাখা শরীরের পাশে বসে থাকা, মায়ের বুকফাটা কান্না শোনার সাহস রাখা, নিজের চোখে এক যুবকের নিথর দেহ দেখে ঘুম হারানো এক মানুষ।
সেদিন সকালটা ছিল অস্বাভাবিক শান্ত।
শান্তির মতোই শুরু, কিন্তু বুকের ভেতর কেমন যেন ছটফট করছিল।
ভায়নার মোড়ে গিয়ে দেখি—আকাশের নিচে, মাটির ওপরে, মানুষের হৃদয়ে নেমে এসেছে এক বিশাল ঢল।
মুক্তিকামী তৌহিদী জনতা নামছে হাতে পতাকা, বুকে কালেমা, চোখে প্রতিজ্ঞা।
তারা চেয়েছিল ন্যায়, তারা চেয়েছিল মুক্তি।
আর অন্যদিকে—ঢাকা রোড, চৌরঙ্গী মোড়, সরকারি কলেজের সামনে ছিল এক অদৃশ্য ভয়ের জানালা।
সেখানে কেউ কেউ ছিল দম্ভে ভরা—রড, লাঠি, দা হাতে নিয়ে তাদের ছিল অস্ত্রের মহড়া।
আমি বুঝে গিয়েছিলাম, কোনো অদৃশ্য বিভাজন রেখা আজ মাগুরার বুক চিরে ফেটে যাবে।
সেই ভয়ই সত্যি হলো।
দুপুর বারোটার দিকে
এক ভয়াবহ খবর এলো—পার নান্দুয়ালিতে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে ছাত্রনেতা মেহেদী হাসান রাব্বি ও ফরহাদকে।
আমি ছুটলাম।
আর এই “ছোটা” যেন ছিল মৃত্যু দেখতে যাওয়া এক যাত্রা আবার সহকর্মী সালাউদ্দিন শিমুলের মোটরসাইকেল আর যেন গতি পাচ্ছে না শরীরের সমস্ত শক্তি মিসেজ হয়ে গেছে সে শুধু আমাকে বলেছিল মামা আর পারছি না আমি বলেছিলাম মামা এটা সাংবাদিকতা পারতেই হবে ।
তাদের নিথর দেহ পড়ে আছে রাস্তার ধারে।
রক্তে ভিজে গেছে মাটি, আর আমার চোখ দেখে সেই রক্ত এখনো শুকায়নি।
মায়ের কান্না…
স্ত্রীর কণ্ঠে ভাঙা আর্তি…
ভাইয়ের ছুটে আসা আর জড়িয়ে পড়া…
এইসব শব্দ আর দৃশ্য আমাকে ভিতরে ভিতরে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল।
আমি তখন কেবল একজন সংবাদকর্মী ছিলাম না আমি ছিলাম একজন কাঁদতে থাকা ভাই, একজন অসহায় মানুষ।
আমার সহকর্মীরা বলছিল, “ আপনি পাগল? ফিরে আসেন ।”
কেউ কেউ কথা বন্ধ করে দেয়।
আমি বুঝতাম, তারা আমার জন্য ভয় পাচ্ছে।
কিন্তু আমি পারিনি ভাই…
আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে পারিনি, পারিনি চোখ বন্ধ করতে।
আমি গিয়েছি পুলিশ কর্মকর্তার কাছে।
অ্যাডিশনাল এসপি আমাকে বললেন, “ভাই, আমরা কি করবো?”
তাদের চোখেও ছিল ভয়, ক্লান্তি আর অপারগতা।
আমি শুধু বললাম, “সবাই শোকাহত, হয়তো কাল (৫ আগস্ট) আরও কিছু ঘটতে পারে।”
এইটুকুই…
তারপর আবার বেরিয়ে পড়লাম,
নতুন লাশের খবর আসবে কি না, তা জানার আশঙ্কা নিয়েই।
সেদিন পাথরের বৃষ্টিও নেমেছিল আমার ওপর।
সহকর্মীদের বাঁচাতে শরীর দিয়েছি ঢাল।
পিছনে কেউ বলছিল, “তুই কি পাগল? এত দরকার কী?”
হ্যাঁ, দরকার ছিল ভাই…
কারণ সত্য যদি আমার চোখের সামনে আমার কোন সহকর্মী মারা যেত আমি সাংবাদিক নেতা হিসেবে আমার বিবেকের কাছে কি জবাব দিতাম? আজ যদি কেউ না লেখে, কাল কেউই জানবে না,কে কিভাবে হারিয়ে গেল এই রাজপথে।
রাতে জানাজা কাভার করতে গিয়েছিলাম সহকর্মী নাজমুল হাসান মিরাজকে সঙ্গে নিয়ে।
ক্যামেরা হাতে, চোখে পানি, পায়ে ব্যথা… তবুও থেকেছি।
ফেরার পথে পুলিশ আমাদের থামালো—কোথা থেকে আসছি, কেন এসেছি, কোথায় যাচ্ছি।
তবু থামিনি।
কেননা আমার কাছে সেদিন রাত ছিল না—সত্যের দায়িত্ব নিয়ে ঘুরে বেড়ানো ছিল এক উপবাসী আত্মার যাত্রা।
আজও আমি ঘুমাতে গেলেই দেখি সেই চিত্রগুলো।
রাব্বির চোখ, ফরহাদের ঠান্ডা শরীর, ভাঙা জুতো, স্ত্রীর সাদা ওড়নার ভেজা কোণা…
আজও আমি কলম ধরলে সেই রক্ত লেগে যায় আঙুলে।
আজও আমি ক্যামেরা চালু করলে যেন কান্না আসে লেন্সের ওপার থেকে।
হয়তো আবার এমন দিন আসবে…
হয়তো আমার সন্তানেরা একদিন বড় হবে, আর জানবে—তাদের বাবা একদিন রক্তে ভেজা রাজপথে দাঁড়িয়েছিল সত্যের পক্ষে।
হয়তো কেউ বলবে, “ও তো পাগল ছিল”—
আমি মাথা নিচু করবো না।
কারণ এই ভূমি ক্ষমতার নয়, এই ভূমি মানুষের।
আর আমি সেই মানুষের কণ্ঠ হয়ে থাকতে চেয়েছি।
সত্য লিখে কেউ বড় হয় না, সত্য বলেই মানুষ হয়।
আর আমি সেই সত্যের সাক্ষী—
একটি দিনে নয়, এক জীবনে।

এইচ এন কামরুল ইসলাম
মোহনা টেলিভিশন, মাগুরা জেলা প্রতিনিধি
প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি, মাগুরা রিপোর্টার্স ইউনিটি।

নিউজটি শেয়ার করুন

ট্যাগস :

রক্তস্নাত মাগুরার ৪ আগস্ট: যেদিন কলমে রক্ত জমেছিল, চোখে জমেছিল মৃত্যুর আলপনা

আপডেট সময় :

তারিখটা শুধু একটা দিন নয়, আমার জীবনের ক্যালেন্ডারে একটা গভীর ছায়া, একটা রক্তাক্ত অধ্যায়।
সেদিন সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে আমি শুধু রিপোর্টার ছিলাম না, হয়ে উঠেছিলাম একজন মানুষ—রক্তমাখা শরীরের পাশে বসে থাকা, মায়ের বুকফাটা কান্না শোনার সাহস রাখা, নিজের চোখে এক যুবকের নিথর দেহ দেখে ঘুম হারানো এক মানুষ।
সেদিন সকালটা ছিল অস্বাভাবিক শান্ত।
শান্তির মতোই শুরু, কিন্তু বুকের ভেতর কেমন যেন ছটফট করছিল।
ভায়নার মোড়ে গিয়ে দেখি—আকাশের নিচে, মাটির ওপরে, মানুষের হৃদয়ে নেমে এসেছে এক বিশাল ঢল।
মুক্তিকামী তৌহিদী জনতা নামছে হাতে পতাকা, বুকে কালেমা, চোখে প্রতিজ্ঞা।
তারা চেয়েছিল ন্যায়, তারা চেয়েছিল মুক্তি।
আর অন্যদিকে—ঢাকা রোড, চৌরঙ্গী মোড়, সরকারি কলেজের সামনে ছিল এক অদৃশ্য ভয়ের জানালা।
সেখানে কেউ কেউ ছিল দম্ভে ভরা—রড, লাঠি, দা হাতে নিয়ে তাদের ছিল অস্ত্রের মহড়া।
আমি বুঝে গিয়েছিলাম, কোনো অদৃশ্য বিভাজন রেখা আজ মাগুরার বুক চিরে ফেটে যাবে।
সেই ভয়ই সত্যি হলো।
দুপুর বারোটার দিকে
এক ভয়াবহ খবর এলো—পার নান্দুয়ালিতে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে ছাত্রনেতা মেহেদী হাসান রাব্বি ও ফরহাদকে।
আমি ছুটলাম।
আর এই “ছোটা” যেন ছিল মৃত্যু দেখতে যাওয়া এক যাত্রা আবার সহকর্মী সালাউদ্দিন শিমুলের মোটরসাইকেল আর যেন গতি পাচ্ছে না শরীরের সমস্ত শক্তি মিসেজ হয়ে গেছে সে শুধু আমাকে বলেছিল মামা আর পারছি না আমি বলেছিলাম মামা এটা সাংবাদিকতা পারতেই হবে ।
তাদের নিথর দেহ পড়ে আছে রাস্তার ধারে।
রক্তে ভিজে গেছে মাটি, আর আমার চোখ দেখে সেই রক্ত এখনো শুকায়নি।
মায়ের কান্না…
স্ত্রীর কণ্ঠে ভাঙা আর্তি…
ভাইয়ের ছুটে আসা আর জড়িয়ে পড়া…
এইসব শব্দ আর দৃশ্য আমাকে ভিতরে ভিতরে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল।
আমি তখন কেবল একজন সংবাদকর্মী ছিলাম না আমি ছিলাম একজন কাঁদতে থাকা ভাই, একজন অসহায় মানুষ।
আমার সহকর্মীরা বলছিল, “ আপনি পাগল? ফিরে আসেন ।”
কেউ কেউ কথা বন্ধ করে দেয়।
আমি বুঝতাম, তারা আমার জন্য ভয় পাচ্ছে।
কিন্তু আমি পারিনি ভাই…
আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে পারিনি, পারিনি চোখ বন্ধ করতে।
আমি গিয়েছি পুলিশ কর্মকর্তার কাছে।
অ্যাডিশনাল এসপি আমাকে বললেন, “ভাই, আমরা কি করবো?”
তাদের চোখেও ছিল ভয়, ক্লান্তি আর অপারগতা।
আমি শুধু বললাম, “সবাই শোকাহত, হয়তো কাল (৫ আগস্ট) আরও কিছু ঘটতে পারে।”
এইটুকুই…
তারপর আবার বেরিয়ে পড়লাম,
নতুন লাশের খবর আসবে কি না, তা জানার আশঙ্কা নিয়েই।
সেদিন পাথরের বৃষ্টিও নেমেছিল আমার ওপর।
সহকর্মীদের বাঁচাতে শরীর দিয়েছি ঢাল।
পিছনে কেউ বলছিল, “তুই কি পাগল? এত দরকার কী?”
হ্যাঁ, দরকার ছিল ভাই…
কারণ সত্য যদি আমার চোখের সামনে আমার কোন সহকর্মী মারা যেত আমি সাংবাদিক নেতা হিসেবে আমার বিবেকের কাছে কি জবাব দিতাম? আজ যদি কেউ না লেখে, কাল কেউই জানবে না,কে কিভাবে হারিয়ে গেল এই রাজপথে।
রাতে জানাজা কাভার করতে গিয়েছিলাম সহকর্মী নাজমুল হাসান মিরাজকে সঙ্গে নিয়ে।
ক্যামেরা হাতে, চোখে পানি, পায়ে ব্যথা… তবুও থেকেছি।
ফেরার পথে পুলিশ আমাদের থামালো—কোথা থেকে আসছি, কেন এসেছি, কোথায় যাচ্ছি।
তবু থামিনি।
কেননা আমার কাছে সেদিন রাত ছিল না—সত্যের দায়িত্ব নিয়ে ঘুরে বেড়ানো ছিল এক উপবাসী আত্মার যাত্রা।
আজও আমি ঘুমাতে গেলেই দেখি সেই চিত্রগুলো।
রাব্বির চোখ, ফরহাদের ঠান্ডা শরীর, ভাঙা জুতো, স্ত্রীর সাদা ওড়নার ভেজা কোণা…
আজও আমি কলম ধরলে সেই রক্ত লেগে যায় আঙুলে।
আজও আমি ক্যামেরা চালু করলে যেন কান্না আসে লেন্সের ওপার থেকে।
হয়তো আবার এমন দিন আসবে…
হয়তো আমার সন্তানেরা একদিন বড় হবে, আর জানবে—তাদের বাবা একদিন রক্তে ভেজা রাজপথে দাঁড়িয়েছিল সত্যের পক্ষে।
হয়তো কেউ বলবে, “ও তো পাগল ছিল”—
আমি মাথা নিচু করবো না।
কারণ এই ভূমি ক্ষমতার নয়, এই ভূমি মানুষের।
আর আমি সেই মানুষের কণ্ঠ হয়ে থাকতে চেয়েছি।
সত্য লিখে কেউ বড় হয় না, সত্য বলেই মানুষ হয়।
আর আমি সেই সত্যের সাক্ষী—
একটি দিনে নয়, এক জীবনে।

এইচ এন কামরুল ইসলাম
মোহনা টেলিভিশন, মাগুরা জেলা প্রতিনিধি
প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি, মাগুরা রিপোর্টার্স ইউনিটি।