ঢাকা ০৫:০০ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫
সংবাদ শিরোনাম ::

বিলুপ্তির পথে ফেনীর পাটি পাতা শিল্প

শাখাওয়াত হোসেন টিপু, দাগনভূঞা
  • আপডেট সময় : ৪৫ বার পড়া হয়েছে

Oplus_131072

দৈনিক গনমুক্তি অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

ফেনীতে গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্য নারীদের নিপুন হাতে তৈরি শীতল পাটির কাঁচামাল পাটিপাতা বাগান অনেকটা বিলুপ্তির পথে। একসময় গ্রামের নারীরা অবসর সময়ে নয় শুধু পেশা হিসেবেও পাটিপাতা দিয়ে শীতল পাটি তৈরির কাজে ব্যস্ত ছিলেন। হাজার বছরের এ শিল্প হারিয়ে যেতে বসেছে।
শীতলপাটি বাংলার সুপ্রাচীন একটি কুটির শিল্পের নাম। শীতলপাটি আমাদের কৃষি ও ঐতিহ্যের অংশ। একসময় জগৎ জুড়ে ছিল শীতলপাটির খ্যাতি। গরমের সময় এ পাটির ঠান্ডা পরশে ক্লান্তি ও শ্রান্তি দূর হয়।
বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার এযুগে এসেও এই শিল্পের কদর বা প্রয়োজনীয়তা কোন অংশে কমে যায়নি।
ফেনীর পাটি পাতা শিল্প ফেনীর আর্থসামাজিক উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে। সোনাগাজী উপজেলার ৯টি ইউনিয়নের প্রায় চল্লিশটি গ্রামে, ফেনী সদর উপজেলার প্রায় ৩০ টি গ্রামের তিন হাজার পরিবার পাটি শিল্পের মাধ্যমে তাদের জীবিকা নির্বাহ করছেন। অসম্ভব ধৈর্য এবং নৈপুণ্যতার সমাহারে সমৃদ্ধ একটি শিল্পকর্ম শীতলপাটি। গ্রামাঞ্চলে নারীরাই মূলত এই শিল্পকে ধরে রেখেছে নিজেদের জীবিকার তাগিদে।
উপকরণঃ নলখাগড়া জাতীয় একপ্রকার ঘাস থেকে মোরতা নামক কাঁচামাল দিয়ে শীতল পাটি তৈরি হয়। ফেনী অঞ্চলে এটিকে পাটি পাতা গাছ বলে।
জন্মঃ সাধারণত অপেক্ষাকৃত নিচু ও সমতল ভূমিতে এ গাছের বেশি আবাদ হয়ে থাকে। বর্তমানে এই পাতার দাম বৃদ্ধির কারণে অনেকেই কৃষিজমিতে ব্যাপকহারে এই পাতার চাষে আগ্রহী হয়ে উঠছেন।
তৈরি প্রক্রিয়াঃ পাটিকরেরা অর্থাৎ যারা পার্টি তৈরি করেন – প্রতিটি পাতা গাছ জমি থেকে কেটে আনার পর এটিকে দা, বঁটি, ছুরি দিয়ে লম্বালম্বি তিন ভাগে কেটে নিপুণ হাতে “বেতি” তৈরি করেন। পানির মিশ্রণে‌ বেতিকে সিদ্ধ করা হয়। সিদ্ধ বেত পরিষ্কার পানি দিয়ে ধুয়ে, রোদে শুকিয়ে শুরু হয় পাটি বোনার কাজ।
পাটি পাতার উপরের অংশ দিয়ে তৈরি করা হয় শীতলপাটি, চাটাই, ধাড়া ইত্যাদি।
ব্যবহারঃ শীতলপাটি বিছানার উপর ব্যবহার করা হয়। গরমকালে এতে একটা শীতল ও ঠাণ্ডা অনুভূতি আসে। এছাড়া রুচিশীল সাজসজ্জার উপকরণ, বাতির শেড,কার্পেটের বদলে নকশি মাদুর, পাপোশ, খাওয়ার টেবিলে নকশী ম্যাট, ওয়ালমেট, ছবির ফ্রেম ইত্যাদি তৈরিতে পাটির ব্যবহার চোখে পড়ার মতো। কারুশিল্প হিসেবেও এই শিল্পটি শোভাবর্ধক ও সর্ব মহলে সমাদৃত।
দামঃ বাজারে প্রতিটি পাতার বান্ডিল আঁটি ৪০০ থেকে ১০০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। কৃষকের বাড়ি থেকে পাতা সংগ্রহ করে বিভিন্ন পণ্য সামগ্রী তৈরি করা হয়। শীতলপাটি, চাটাই, ধাড়া আকৃতি, ডিজাইন ও গুণগতমান ভেদে প্রতিটি ৫০ টাকা থেকে ৪০০০ টাকা পর্যন্ত ফেনীর পাটি বাজারগুলোতে বিক্রি হয়ে থাকে। তবে মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণে মূল কারিগরেরা এই দাম পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
প্রশিক্ষণঃ হারিয়ে যাওয়া এই শিল্পকে ধরে রাখতে ২০১১ সালে ২০ জন মহিলাকে সরকারি ম্যাট- ২ এর প্রকল্পের উদ্যোগে এলআইএফডি এর সমন্বয়ে দুই মাসব্যাপী হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়।
চাহিদাঃ ফেনীর এই শীতলপাটি পণ্যটি এলাকার চাহিদা মিটিয়ে বরিশাল, নওগাঁ, সিলেট, কুমিল্লা, ভৈরব, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, রাজশাহী, সিরাজগঞ্জ, ফরিদপুর, রংপুর-ঢাকা সহ বেশকিছু জেলা ও উপজেলায় প্রচুর চাহিদা রয়েছে।
হাট/বাজারঃ ফেনী থেকে প্রতি সপ্তাহে ট্রাক বোঝাই করে পাইকারেরা অত্র অঞ্চলে এই পাটি পণ্য সরবরাহ করে থাকে। সাপ্তাহিক শনি থেকে মঙ্গলবার সোনাগাজীর বক্তারমুন্সী বাজারের সবচাইতে বড় পাটি পাতার হাটে ভোর থেকে বিশাল হাট বসে। দূর-দূরান্ত থেকে পাইকাররা এ সকল পণ্য মাথায় করে, রিক্সা, ভ্যান এর মাধ্যমে বাজারে নিয়ে আসে।
মৌসুমঃ ফেনী জেলার বাইরে ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে গড়ে প্রতি সপ্তাহে ৩০ থেকে ৪০ লাখ টাকার মতো পাটি পণ্য চালান হয়। এছাড়া ফাল্গুন, চৈত্র, বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ মাসে বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুমে এসকল হাট-বাজারে ৫০ লাখ টাকারও বেশি চালান হয়ে থাকে।
সোনাগাজী উপজেলার বগাদানা ইউনিয়নের বাসিন্দা নজরুল ইসলাম পাটোয়ারী বলেন, তাদের ওই অঞ্চলের মানুষের একসময়ে পরিবারের একমাত্র আয়ের উৎসহ ছিল পাটিপাতা দিয়ে তৈরি শীতল পাটি। শীতল পাটি বিক্রি করে চলতো পরিবারের যাবতীয় ভরন পোষণ।
দাগনভূঞা উপজেলার বাসিন্দা ইসমাইল হোসেন লিটন জানান, পাটিপাতা বাগান তাদের গ্রামে অনেক ছিল। তবে এখন আর চোখে পড়ার মতো নেই। দুই একটা থাকলেও তা নাগালে বাহিরে। তবে এ শিল্প ধ্বংসের পথে। এটিকে বাঁচাতে হলে আবারও পরিকল্পিতভাবে নিচু জায়গায় বাগান তৈরি করতে হবে। তাহলে পাটিপাতা বাগান আবারও ফিরে পারে ঐতিহ্য। নারীরা এ পাটিপাতা দিয়ে নানা রকম শীতল পাটি তৈরি করার দৃশ্য এখন অনেকটা স্বপ্নের মতো।
বাংলাদেশের অন্যান্য হস্তশিল্প কারিগরদের মতোই ফেনীর পাটি কারিগরেরাও দরিদ্র ও অবহেলিত। সরকার যদি অন্যান্য শিল্পের মতো এই শিল্পের দিকেও নজর দিতেন তাহলে ফেনীর এই পাটিপাতা শিল্পের ঐতিহ্য বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও অবদান রাখতে পারতো।এই পণ্যগুলো যাতে বিলুপ্ত না হতে পারে তার জন্য উদ্যোক্তাদের মধ্যে আগ্রহ সৃষ্টি করা এখন সময়ের দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

নিউজটি শেয়ার করুন

ট্যাগস :

বিলুপ্তির পথে ফেনীর পাটি পাতা শিল্প

আপডেট সময় :

ফেনীতে গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্য নারীদের নিপুন হাতে তৈরি শীতল পাটির কাঁচামাল পাটিপাতা বাগান অনেকটা বিলুপ্তির পথে। একসময় গ্রামের নারীরা অবসর সময়ে নয় শুধু পেশা হিসেবেও পাটিপাতা দিয়ে শীতল পাটি তৈরির কাজে ব্যস্ত ছিলেন। হাজার বছরের এ শিল্প হারিয়ে যেতে বসেছে।
শীতলপাটি বাংলার সুপ্রাচীন একটি কুটির শিল্পের নাম। শীতলপাটি আমাদের কৃষি ও ঐতিহ্যের অংশ। একসময় জগৎ জুড়ে ছিল শীতলপাটির খ্যাতি। গরমের সময় এ পাটির ঠান্ডা পরশে ক্লান্তি ও শ্রান্তি দূর হয়।
বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার এযুগে এসেও এই শিল্পের কদর বা প্রয়োজনীয়তা কোন অংশে কমে যায়নি।
ফেনীর পাটি পাতা শিল্প ফেনীর আর্থসামাজিক উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে। সোনাগাজী উপজেলার ৯টি ইউনিয়নের প্রায় চল্লিশটি গ্রামে, ফেনী সদর উপজেলার প্রায় ৩০ টি গ্রামের তিন হাজার পরিবার পাটি শিল্পের মাধ্যমে তাদের জীবিকা নির্বাহ করছেন। অসম্ভব ধৈর্য এবং নৈপুণ্যতার সমাহারে সমৃদ্ধ একটি শিল্পকর্ম শীতলপাটি। গ্রামাঞ্চলে নারীরাই মূলত এই শিল্পকে ধরে রেখেছে নিজেদের জীবিকার তাগিদে।
উপকরণঃ নলখাগড়া জাতীয় একপ্রকার ঘাস থেকে মোরতা নামক কাঁচামাল দিয়ে শীতল পাটি তৈরি হয়। ফেনী অঞ্চলে এটিকে পাটি পাতা গাছ বলে।
জন্মঃ সাধারণত অপেক্ষাকৃত নিচু ও সমতল ভূমিতে এ গাছের বেশি আবাদ হয়ে থাকে। বর্তমানে এই পাতার দাম বৃদ্ধির কারণে অনেকেই কৃষিজমিতে ব্যাপকহারে এই পাতার চাষে আগ্রহী হয়ে উঠছেন।
তৈরি প্রক্রিয়াঃ পাটিকরেরা অর্থাৎ যারা পার্টি তৈরি করেন – প্রতিটি পাতা গাছ জমি থেকে কেটে আনার পর এটিকে দা, বঁটি, ছুরি দিয়ে লম্বালম্বি তিন ভাগে কেটে নিপুণ হাতে “বেতি” তৈরি করেন। পানির মিশ্রণে‌ বেতিকে সিদ্ধ করা হয়। সিদ্ধ বেত পরিষ্কার পানি দিয়ে ধুয়ে, রোদে শুকিয়ে শুরু হয় পাটি বোনার কাজ।
পাটি পাতার উপরের অংশ দিয়ে তৈরি করা হয় শীতলপাটি, চাটাই, ধাড়া ইত্যাদি।
ব্যবহারঃ শীতলপাটি বিছানার উপর ব্যবহার করা হয়। গরমকালে এতে একটা শীতল ও ঠাণ্ডা অনুভূতি আসে। এছাড়া রুচিশীল সাজসজ্জার উপকরণ, বাতির শেড,কার্পেটের বদলে নকশি মাদুর, পাপোশ, খাওয়ার টেবিলে নকশী ম্যাট, ওয়ালমেট, ছবির ফ্রেম ইত্যাদি তৈরিতে পাটির ব্যবহার চোখে পড়ার মতো। কারুশিল্প হিসেবেও এই শিল্পটি শোভাবর্ধক ও সর্ব মহলে সমাদৃত।
দামঃ বাজারে প্রতিটি পাতার বান্ডিল আঁটি ৪০০ থেকে ১০০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। কৃষকের বাড়ি থেকে পাতা সংগ্রহ করে বিভিন্ন পণ্য সামগ্রী তৈরি করা হয়। শীতলপাটি, চাটাই, ধাড়া আকৃতি, ডিজাইন ও গুণগতমান ভেদে প্রতিটি ৫০ টাকা থেকে ৪০০০ টাকা পর্যন্ত ফেনীর পাটি বাজারগুলোতে বিক্রি হয়ে থাকে। তবে মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণে মূল কারিগরেরা এই দাম পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
প্রশিক্ষণঃ হারিয়ে যাওয়া এই শিল্পকে ধরে রাখতে ২০১১ সালে ২০ জন মহিলাকে সরকারি ম্যাট- ২ এর প্রকল্পের উদ্যোগে এলআইএফডি এর সমন্বয়ে দুই মাসব্যাপী হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়।
চাহিদাঃ ফেনীর এই শীতলপাটি পণ্যটি এলাকার চাহিদা মিটিয়ে বরিশাল, নওগাঁ, সিলেট, কুমিল্লা, ভৈরব, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, রাজশাহী, সিরাজগঞ্জ, ফরিদপুর, রংপুর-ঢাকা সহ বেশকিছু জেলা ও উপজেলায় প্রচুর চাহিদা রয়েছে।
হাট/বাজারঃ ফেনী থেকে প্রতি সপ্তাহে ট্রাক বোঝাই করে পাইকারেরা অত্র অঞ্চলে এই পাটি পণ্য সরবরাহ করে থাকে। সাপ্তাহিক শনি থেকে মঙ্গলবার সোনাগাজীর বক্তারমুন্সী বাজারের সবচাইতে বড় পাটি পাতার হাটে ভোর থেকে বিশাল হাট বসে। দূর-দূরান্ত থেকে পাইকাররা এ সকল পণ্য মাথায় করে, রিক্সা, ভ্যান এর মাধ্যমে বাজারে নিয়ে আসে।
মৌসুমঃ ফেনী জেলার বাইরে ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে গড়ে প্রতি সপ্তাহে ৩০ থেকে ৪০ লাখ টাকার মতো পাটি পণ্য চালান হয়। এছাড়া ফাল্গুন, চৈত্র, বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ মাসে বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুমে এসকল হাট-বাজারে ৫০ লাখ টাকারও বেশি চালান হয়ে থাকে।
সোনাগাজী উপজেলার বগাদানা ইউনিয়নের বাসিন্দা নজরুল ইসলাম পাটোয়ারী বলেন, তাদের ওই অঞ্চলের মানুষের একসময়ে পরিবারের একমাত্র আয়ের উৎসহ ছিল পাটিপাতা দিয়ে তৈরি শীতল পাটি। শীতল পাটি বিক্রি করে চলতো পরিবারের যাবতীয় ভরন পোষণ।
দাগনভূঞা উপজেলার বাসিন্দা ইসমাইল হোসেন লিটন জানান, পাটিপাতা বাগান তাদের গ্রামে অনেক ছিল। তবে এখন আর চোখে পড়ার মতো নেই। দুই একটা থাকলেও তা নাগালে বাহিরে। তবে এ শিল্প ধ্বংসের পথে। এটিকে বাঁচাতে হলে আবারও পরিকল্পিতভাবে নিচু জায়গায় বাগান তৈরি করতে হবে। তাহলে পাটিপাতা বাগান আবারও ফিরে পারে ঐতিহ্য। নারীরা এ পাটিপাতা দিয়ে নানা রকম শীতল পাটি তৈরি করার দৃশ্য এখন অনেকটা স্বপ্নের মতো।
বাংলাদেশের অন্যান্য হস্তশিল্প কারিগরদের মতোই ফেনীর পাটি কারিগরেরাও দরিদ্র ও অবহেলিত। সরকার যদি অন্যান্য শিল্পের মতো এই শিল্পের দিকেও নজর দিতেন তাহলে ফেনীর এই পাটিপাতা শিল্পের ঐতিহ্য বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও অবদান রাখতে পারতো।এই পণ্যগুলো যাতে বিলুপ্ত না হতে পারে তার জন্য উদ্যোক্তাদের মধ্যে আগ্রহ সৃষ্টি করা এখন সময়ের দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে।