ঢাকা ১১:১৪ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫

ডিসি-এসপির পকেটেও যেত পাথরলুটের টাকা

স্টাফ রিপোর্টার
  • আপডেট সময় : ১৬৪ বার পড়া হয়েছে
দৈনিক গনমুক্তি অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

সিলেটের ভোলাগঞ্জে সাদাপাথর উত্তোলনের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সম্পদের ক্ষতিসাধনে স্থানীয় প্রশাসনের অসাধু যোগসাজশ ছিল বলে দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদকের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। কার পকেটে কত টাকা যেত, কীভাবে টাকা আদায় করা হতো, এর সবকিছুই খোলাসা করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
সাদাপাথর লুটপাট নিয়ে দেশজুড়ে তোলপাড় শুরু হলে গত ১৩ আগস্ট সেখানে সরেজমিন তদন্তে যায় দুদকের পাঁচ সদস্যের একটি দল। এর নেতৃত্বে ছিলেন দুদকের সিলেটের সমন্বিত কার্যালয়ের উপ-পরিচালক রাফী মো. নাজমুস সাদাৎ।
তিনি বলেন, সাদাপাথর সরেজমিন তদন্ত করে গত ১৭ আগস্ট আমরা দুদকের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে প্রতিবেদন পাঠিয়েছি। অনুমতি পেলে সার্বিক বিষয়ে তদন্তে নামবো। তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বিজিবির টহল চলমান থাকলেও পর্যটন স্পট থেকে বিগত কয়েক মাসে শত কোটি টাকার পাথর লুটপাট হয়েছে। স্থানীয় প্রশাসন এবং প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গের ইন্ধন ও সরাসরি সম্পৃক্ততায় এ ধরনের কার্যকলাপ চলেছে প্রকাশ্যে।
পাথর কোয়ারিসমূহে পাথর উত্তোলনের অনুমতি না থাকলেও ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট তৎকালীন সরকারের পতনের পর থেকে বিশেষ করে বিগত ৩ মাস যাবৎ পাথর উত্তোলন চলতে থাকে। সংরক্ষিত পরিবেশ এলাকা সত্ত্বেও সাদাপাথর এলাকা থেকে সর্বশেষ ১৫ দিন পূর্ব থেকে নির্বিচারে পাথর উত্তোলন ও আত্মসাৎ হয়েছে, যাতে প্রায় ৮০ শতাংশ পাথর তুলে ফেলা হয়েছে। ফলে এলাকাটি বর্তমানে অসংখ্য গর্ত ও বালুচরে পরিণত হয়েছে মর্মে দেখতে পায় দুদকের টিম।
প্রতিবেদনে বরা হয়েছে, আদায়কৃত অর্থ কোম্পানিগঞ্জ থানার অধীন ছয়টি বিট অফিসে কর্মরত এসআই ও এএসআইকে দেওয়া হতো। ছয়টি বিট অফিসের কর্মকর্তারা আদায়কৃত অর্থ কোম্পানিগঞ্জ থানার ওসিসহ এএসপি সার্কেল ও এসপিকে দিতেন। এছাড়া সিলেট ডিবি পুলিশের ওসিকেও ওই টাকার ভাগ দিতে হতো। প্রাথমিক অনুসন্ধানকালে পুলিশের সিলেট পিআইও শাখার দুইজনের নাম উঠে এসেছে, যারা অবৈধ পাথর উত্তোলন সিন্ডিকেটে জড়িত মর্মে জানতে পারে দুদক। তাদের একজন হচ্ছেন এসআই বানাকান্ত ও আরেকজন কনস্টেবল দেলোয়ার। এছাড়া কোম্পানীগঞ্জ ও গোয়াইনঘাট থানার সম্পূর্ণ সেটআপ এই ক্ষেত্রে জড়িত। দুই থানার মধ্যে বদলি হয়ে বছরের পর বছর কিছু পুলিশ কর্মচারী ওই ঘটনাগুলো সংঘটিত করে যাচ্ছেন। পুলিশ প্রশাসনকে টাকা প্রদান করা হয় যেন ট্রাক না আটকানো, অভিযান না চালানো এবং অবৈধভাবে পাথর উত্তোলনে বাধা প্রদান না করা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সাদাপাথর এলাকায় ৩৩টি বিজিবি ক্যাম্প/পোস্ট রয়েছে। এগুলো হতে ঘটনাস্থলের (সাদাপাথর) দূরত্ব ৫০০ মিটার থেকেও কম। উত্তোলিত পাথর পরিবহনের নৌকাপ্রতি ৫০০ টাকা নিতেন বিজিবির সদস্যরা। পরে পাথর উত্তোলনে নৌকাগুলোকে প্রবেশের অনুমতি দিতেন। এ কারণে পাথর উত্তোলনের সময় কোনোরূপ বাধা দেয়নি বিজিবি। অনুসন্ধানকালে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির দায়দায়িত্ব নির্ধারণ করা যাবে।
বিভাগীয় কমিশনারের ভূমিকা তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকারি নির্দেশে ২০২০ সাল থেকে সাদাপাথর উত্তোলন নিষিদ্ধ রয়েছে। বিভাগীয় কমিশনার খান মো. রেজা-উন-নবী গত ৮ জুলাই তার কার্যালয়ে পাথর সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী, পরিবহন শ্রমিক ও রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে বলেন, ‘সারা দেশে পাথর উত্তোলন করা গেলে, সিলেটে যাবে না কেন? এর সঙ্গে মানুষের জীবন ও জীবিকা জড়িত’। তার এ বক্তব্য বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রচারিত হলে সাদাপাথর লুটপাটের ক্ষেত্রে ব্যাপক উৎসাহ যোগায়। সরকারিভাবে পাথর উত্তোলন নিষিদ্ধ থাকলেও তিনি উক্তরূপ বক্তব্যের মাধ্যমে পাথর লুটপাটকে প্রশ্রয় দিয়েছেন। এক্ষেত্রে তিনি রাষ্ট্রীয় সম্পদ রক্ষার দায়িত্ব পালনের পরিবর্তে পাথর সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী, পরিবহন শ্রমিক ও রাজনৈতিক নেতাদের অবৈধ স্বার্থরক্ষায় ভূমিকা রেখেছেন।
পাথরলুট কাণ্ডে তোলপাড় হলে সম্প্রতি জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদকে প্রত্যাহার করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। তার ভূমিকা প্রসঙ্গে দুদকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জেলা প্রশাসকের সদিচ্ছার অভাব, অবহেলা, ব্যর্থতা ও নিষ্ক্রিয়তা অভিযানকালে প্রতীয়মান হয়েছে। তিনি তার অধীন কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা প্রশাসনকে সাদাপাথর পর্যটন স্পট রক্ষায় সঠিক দিক-নির্দেশনা দিতে অদক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। সাদাপাথর পর্যটন স্পটের বর্তমান অবস্থা একদিনে হয়নি। এটি বিগত ৭/৮ মাস যাবত চললেও জেলা প্রশাসক ও তার অধীন কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছেন। অথচ সরকারি বিধি অনুযায়ী সিলেট জেলায় অবস্থিত পর্যটন স্পটগুলোর নান্দনিক সৌন্দর্য বজায় রাখাসহ পরিবেশ সংরক্ষণে যথাযথ কার্যক্রম জেলা প্রশাসকের দায়িত্ব।
প্রতিবেদনে বলা হয়, গত এক বছরে কোয়ারিতে বিশেষ করে সাদাপাথর পর্যটন এলাকায় উপজেলা প্রশাসনের গোচরেই পাথর লুটপাট হয়েছে। কোম্পানিগঞ্জে উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) আজিজুন্নাহার এখানে গত ১৪ জানুয়ারি থেকে দায়িত্বে ছিলেন। তার পূর্ববর্তী ২০২৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর হতে ২০২৫ সালের ১৪ জানুয়ারি পর্যন্ত মোহাম্মদ আবুল হাছনাত, উর্মি রায় (২৪/১২/২৪ হতে ৩০/১২/২৪), আবিদা সুলতানা (১১/০৭/২৪ হতে ২৪/১২/২৪) কর্মরত ছিলেন। এই ইউএনওরা নামমাত্র ও লোক দেখানো কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ ছাড়া পাথরলুট বন্ধে তেমন কোনো ব্যবস্থা নেননি। অভিযানকালে পর্যটন স্পটে উপস্থিত দর্শনার্থী, স্থানীয় ব্যবসায়ী ও অন্যান্যদের জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, অবৈধভাবে উত্তোলিত পাথর বাণিজ্যের কমিশন বাবদ প্রশাসনের (তহশিলদার, এসি-ল্যান্ড, উপজেলা নির্বাহী অফিসার, জেলা প্রশাসক ও অন্যান্য) জন্য প্রতি ট্রাক হতে ৫ হাজার টাকা এবং প্রত্যেক বারকি নৌকা হতে ৫০০ টাকা প্রদান করা হয়।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, গত ২৭ এপ্রিল স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন ও পরিবহন বন্ধে পুলিশ ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দেন। কিন্তু সিলেট জেলার পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান সাদাপাথর লুটপাটে কোনো ব্যবস্থা নেননি। পুলিশ সুপারের নিষ্ক্রিয়তা ও যোগসাজশের কারণে দুষ্কৃতকারী কর্তৃক সাদাপাথর লুটপাট করা সম্ভব হয়েছে।
প্রতিবেদনে দুদক বলেছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষার পাশাপাশি সরকারি সম্পদ অবৈধ দখল ও লুটপাট রোধের দায়িত্ব থানা পুলিশ তথা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) ওপর বর্তায়। ওই সময়ে কোম্পানিগঞ্জ থানায় ওসি উজায়ের আল মাহমুদ আদনানসহ সংশ্লিষ্ট থানার পুলিশ সদস্যরা অবৈধ পাথর ব্যবসায়ীদের নিকট থেকে বিভিন্ন অঙ্কের কমিশন নিতেন। যে কারণে সাদাপাথর লুটপাটে সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা করেছেন মর্মে অভিযানকালে জানতে পারে দুদক।
দুদকের প্রতিবেদন অনুসারে, অবৈধভাবে উত্তোলিত পাথর প্রতি ট্রাকে প্রায় ৫শ’ ঘনফুট করে লোড করা হতো। পরিবহন ভাড়া ব্যতীত প্রতি ট্রাকের পাথরের দাম ধরা হতো ৫০০-১৮২- ৯১ হাজার টাকা। এর মধ্যে প্রতি ট্রাক হতে ১০ হাজার টাকা পুলিশ ও প্রশাসনের জন্য আলাদা করা হতো। বাকি ৮১ হাজার টাকা অবৈধভাবে পাথর উত্তোলনকারীরা নিজেদের মাঝে বণ্টন করে নিতেন। প্রতি ট্রাক হতে ১০ হাজার টাকার মধ্যে পুলিশের (ওসি, সার্কেল এএসপি, এসপি ও অন্যান্য) জন্য ৫ হাজার টাকা এবং প্রশাসনের (তহশিলদার, এসি-ল্যান্ড, উপজেলা নির্বাহী অফিসার, জেলা প্রশাসক ও অন্যান্য) জন্য ৫ হাজার টাকা নেওয়া হতো। এছাড়া অবৈধভাবে পাথর উত্তোলনকাজে ব্যবহৃত প্রতিটি বারকি নৌকা হতে ১ হাজার টাকা উত্তোলন করা হতো। এর মধ্যে পুলিশ বিভাগ পেত ৫০০ টাকা এবং প্রশাসন (ডিসি ও ইউএনও) পেত ৫০০ টাকা। পুলিশ নির্দিষ্ট সোর্সের মাধ্যমে প্রত্যেক ট্রাক ও নৌকা হতে এসব চাঁদা/অবৈধ অর্থ সংগ্রহ করতো।
দুদকের প্রতিবেদনে পাথর লুটকাণ্ডে ৫০ জন প্রভাবশালী এবং দুটি প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। তালিকায় উঠে আসা রাজনীতিক (ব্যবসায়ী) ৪২ জনের মধ্যে বিএনপির ২০, আওয়ামী লীগের ৭ এবং জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপির দুজন করে নেতার নাম রয়েছে। এতে বলা হয়েছে, তারা রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে স্থানীয় প্রশাসনের যোগসাজশে কয়েক হাজার শ্রমিক দ্বারা অবৈধভাবে রাষ্ট্রীয় সম্পদ সাদাপাথর লুটপাট করে আর্থিকভাবে লাভবান হয়েছেন।

নিউজটি শেয়ার করুন

ট্যাগস :

ডিসি-এসপির পকেটেও যেত পাথরলুটের টাকা

আপডেট সময় :

সিলেটের ভোলাগঞ্জে সাদাপাথর উত্তোলনের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সম্পদের ক্ষতিসাধনে স্থানীয় প্রশাসনের অসাধু যোগসাজশ ছিল বলে দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদকের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। কার পকেটে কত টাকা যেত, কীভাবে টাকা আদায় করা হতো, এর সবকিছুই খোলাসা করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
সাদাপাথর লুটপাট নিয়ে দেশজুড়ে তোলপাড় শুরু হলে গত ১৩ আগস্ট সেখানে সরেজমিন তদন্তে যায় দুদকের পাঁচ সদস্যের একটি দল। এর নেতৃত্বে ছিলেন দুদকের সিলেটের সমন্বিত কার্যালয়ের উপ-পরিচালক রাফী মো. নাজমুস সাদাৎ।
তিনি বলেন, সাদাপাথর সরেজমিন তদন্ত করে গত ১৭ আগস্ট আমরা দুদকের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে প্রতিবেদন পাঠিয়েছি। অনুমতি পেলে সার্বিক বিষয়ে তদন্তে নামবো। তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বিজিবির টহল চলমান থাকলেও পর্যটন স্পট থেকে বিগত কয়েক মাসে শত কোটি টাকার পাথর লুটপাট হয়েছে। স্থানীয় প্রশাসন এবং প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গের ইন্ধন ও সরাসরি সম্পৃক্ততায় এ ধরনের কার্যকলাপ চলেছে প্রকাশ্যে।
পাথর কোয়ারিসমূহে পাথর উত্তোলনের অনুমতি না থাকলেও ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট তৎকালীন সরকারের পতনের পর থেকে বিশেষ করে বিগত ৩ মাস যাবৎ পাথর উত্তোলন চলতে থাকে। সংরক্ষিত পরিবেশ এলাকা সত্ত্বেও সাদাপাথর এলাকা থেকে সর্বশেষ ১৫ দিন পূর্ব থেকে নির্বিচারে পাথর উত্তোলন ও আত্মসাৎ হয়েছে, যাতে প্রায় ৮০ শতাংশ পাথর তুলে ফেলা হয়েছে। ফলে এলাকাটি বর্তমানে অসংখ্য গর্ত ও বালুচরে পরিণত হয়েছে মর্মে দেখতে পায় দুদকের টিম।
প্রতিবেদনে বরা হয়েছে, আদায়কৃত অর্থ কোম্পানিগঞ্জ থানার অধীন ছয়টি বিট অফিসে কর্মরত এসআই ও এএসআইকে দেওয়া হতো। ছয়টি বিট অফিসের কর্মকর্তারা আদায়কৃত অর্থ কোম্পানিগঞ্জ থানার ওসিসহ এএসপি সার্কেল ও এসপিকে দিতেন। এছাড়া সিলেট ডিবি পুলিশের ওসিকেও ওই টাকার ভাগ দিতে হতো। প্রাথমিক অনুসন্ধানকালে পুলিশের সিলেট পিআইও শাখার দুইজনের নাম উঠে এসেছে, যারা অবৈধ পাথর উত্তোলন সিন্ডিকেটে জড়িত মর্মে জানতে পারে দুদক। তাদের একজন হচ্ছেন এসআই বানাকান্ত ও আরেকজন কনস্টেবল দেলোয়ার। এছাড়া কোম্পানীগঞ্জ ও গোয়াইনঘাট থানার সম্পূর্ণ সেটআপ এই ক্ষেত্রে জড়িত। দুই থানার মধ্যে বদলি হয়ে বছরের পর বছর কিছু পুলিশ কর্মচারী ওই ঘটনাগুলো সংঘটিত করে যাচ্ছেন। পুলিশ প্রশাসনকে টাকা প্রদান করা হয় যেন ট্রাক না আটকানো, অভিযান না চালানো এবং অবৈধভাবে পাথর উত্তোলনে বাধা প্রদান না করা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সাদাপাথর এলাকায় ৩৩টি বিজিবি ক্যাম্প/পোস্ট রয়েছে। এগুলো হতে ঘটনাস্থলের (সাদাপাথর) দূরত্ব ৫০০ মিটার থেকেও কম। উত্তোলিত পাথর পরিবহনের নৌকাপ্রতি ৫০০ টাকা নিতেন বিজিবির সদস্যরা। পরে পাথর উত্তোলনে নৌকাগুলোকে প্রবেশের অনুমতি দিতেন। এ কারণে পাথর উত্তোলনের সময় কোনোরূপ বাধা দেয়নি বিজিবি। অনুসন্ধানকালে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির দায়দায়িত্ব নির্ধারণ করা যাবে।
বিভাগীয় কমিশনারের ভূমিকা তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকারি নির্দেশে ২০২০ সাল থেকে সাদাপাথর উত্তোলন নিষিদ্ধ রয়েছে। বিভাগীয় কমিশনার খান মো. রেজা-উন-নবী গত ৮ জুলাই তার কার্যালয়ে পাথর সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী, পরিবহন শ্রমিক ও রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে বলেন, ‘সারা দেশে পাথর উত্তোলন করা গেলে, সিলেটে যাবে না কেন? এর সঙ্গে মানুষের জীবন ও জীবিকা জড়িত’। তার এ বক্তব্য বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রচারিত হলে সাদাপাথর লুটপাটের ক্ষেত্রে ব্যাপক উৎসাহ যোগায়। সরকারিভাবে পাথর উত্তোলন নিষিদ্ধ থাকলেও তিনি উক্তরূপ বক্তব্যের মাধ্যমে পাথর লুটপাটকে প্রশ্রয় দিয়েছেন। এক্ষেত্রে তিনি রাষ্ট্রীয় সম্পদ রক্ষার দায়িত্ব পালনের পরিবর্তে পাথর সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী, পরিবহন শ্রমিক ও রাজনৈতিক নেতাদের অবৈধ স্বার্থরক্ষায় ভূমিকা রেখেছেন।
পাথরলুট কাণ্ডে তোলপাড় হলে সম্প্রতি জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদকে প্রত্যাহার করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। তার ভূমিকা প্রসঙ্গে দুদকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জেলা প্রশাসকের সদিচ্ছার অভাব, অবহেলা, ব্যর্থতা ও নিষ্ক্রিয়তা অভিযানকালে প্রতীয়মান হয়েছে। তিনি তার অধীন কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা প্রশাসনকে সাদাপাথর পর্যটন স্পট রক্ষায় সঠিক দিক-নির্দেশনা দিতে অদক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। সাদাপাথর পর্যটন স্পটের বর্তমান অবস্থা একদিনে হয়নি। এটি বিগত ৭/৮ মাস যাবত চললেও জেলা প্রশাসক ও তার অধীন কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছেন। অথচ সরকারি বিধি অনুযায়ী সিলেট জেলায় অবস্থিত পর্যটন স্পটগুলোর নান্দনিক সৌন্দর্য বজায় রাখাসহ পরিবেশ সংরক্ষণে যথাযথ কার্যক্রম জেলা প্রশাসকের দায়িত্ব।
প্রতিবেদনে বলা হয়, গত এক বছরে কোয়ারিতে বিশেষ করে সাদাপাথর পর্যটন এলাকায় উপজেলা প্রশাসনের গোচরেই পাথর লুটপাট হয়েছে। কোম্পানিগঞ্জে উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) আজিজুন্নাহার এখানে গত ১৪ জানুয়ারি থেকে দায়িত্বে ছিলেন। তার পূর্ববর্তী ২০২৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর হতে ২০২৫ সালের ১৪ জানুয়ারি পর্যন্ত মোহাম্মদ আবুল হাছনাত, উর্মি রায় (২৪/১২/২৪ হতে ৩০/১২/২৪), আবিদা সুলতানা (১১/০৭/২৪ হতে ২৪/১২/২৪) কর্মরত ছিলেন। এই ইউএনওরা নামমাত্র ও লোক দেখানো কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ ছাড়া পাথরলুট বন্ধে তেমন কোনো ব্যবস্থা নেননি। অভিযানকালে পর্যটন স্পটে উপস্থিত দর্শনার্থী, স্থানীয় ব্যবসায়ী ও অন্যান্যদের জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, অবৈধভাবে উত্তোলিত পাথর বাণিজ্যের কমিশন বাবদ প্রশাসনের (তহশিলদার, এসি-ল্যান্ড, উপজেলা নির্বাহী অফিসার, জেলা প্রশাসক ও অন্যান্য) জন্য প্রতি ট্রাক হতে ৫ হাজার টাকা এবং প্রত্যেক বারকি নৌকা হতে ৫০০ টাকা প্রদান করা হয়।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, গত ২৭ এপ্রিল স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন ও পরিবহন বন্ধে পুলিশ ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দেন। কিন্তু সিলেট জেলার পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান সাদাপাথর লুটপাটে কোনো ব্যবস্থা নেননি। পুলিশ সুপারের নিষ্ক্রিয়তা ও যোগসাজশের কারণে দুষ্কৃতকারী কর্তৃক সাদাপাথর লুটপাট করা সম্ভব হয়েছে।
প্রতিবেদনে দুদক বলেছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষার পাশাপাশি সরকারি সম্পদ অবৈধ দখল ও লুটপাট রোধের দায়িত্ব থানা পুলিশ তথা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) ওপর বর্তায়। ওই সময়ে কোম্পানিগঞ্জ থানায় ওসি উজায়ের আল মাহমুদ আদনানসহ সংশ্লিষ্ট থানার পুলিশ সদস্যরা অবৈধ পাথর ব্যবসায়ীদের নিকট থেকে বিভিন্ন অঙ্কের কমিশন নিতেন। যে কারণে সাদাপাথর লুটপাটে সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা করেছেন মর্মে অভিযানকালে জানতে পারে দুদক।
দুদকের প্রতিবেদন অনুসারে, অবৈধভাবে উত্তোলিত পাথর প্রতি ট্রাকে প্রায় ৫শ’ ঘনফুট করে লোড করা হতো। পরিবহন ভাড়া ব্যতীত প্রতি ট্রাকের পাথরের দাম ধরা হতো ৫০০-১৮২- ৯১ হাজার টাকা। এর মধ্যে প্রতি ট্রাক হতে ১০ হাজার টাকা পুলিশ ও প্রশাসনের জন্য আলাদা করা হতো। বাকি ৮১ হাজার টাকা অবৈধভাবে পাথর উত্তোলনকারীরা নিজেদের মাঝে বণ্টন করে নিতেন। প্রতি ট্রাক হতে ১০ হাজার টাকার মধ্যে পুলিশের (ওসি, সার্কেল এএসপি, এসপি ও অন্যান্য) জন্য ৫ হাজার টাকা এবং প্রশাসনের (তহশিলদার, এসি-ল্যান্ড, উপজেলা নির্বাহী অফিসার, জেলা প্রশাসক ও অন্যান্য) জন্য ৫ হাজার টাকা নেওয়া হতো। এছাড়া অবৈধভাবে পাথর উত্তোলনকাজে ব্যবহৃত প্রতিটি বারকি নৌকা হতে ১ হাজার টাকা উত্তোলন করা হতো। এর মধ্যে পুলিশ বিভাগ পেত ৫০০ টাকা এবং প্রশাসন (ডিসি ও ইউএনও) পেত ৫০০ টাকা। পুলিশ নির্দিষ্ট সোর্সের মাধ্যমে প্রত্যেক ট্রাক ও নৌকা হতে এসব চাঁদা/অবৈধ অর্থ সংগ্রহ করতো।
দুদকের প্রতিবেদনে পাথর লুটকাণ্ডে ৫০ জন প্রভাবশালী এবং দুটি প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। তালিকায় উঠে আসা রাজনীতিক (ব্যবসায়ী) ৪২ জনের মধ্যে বিএনপির ২০, আওয়ামী লীগের ৭ এবং জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপির দুজন করে নেতার নাম রয়েছে। এতে বলা হয়েছে, তারা রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে স্থানীয় প্রশাসনের যোগসাজশে কয়েক হাজার শ্রমিক দ্বারা অবৈধভাবে রাষ্ট্রীয় সম্পদ সাদাপাথর লুটপাট করে আর্থিকভাবে লাভবান হয়েছেন।