প্রকৌশল-ডিপ্লোমা দ্বন্দ্ব এখন চরমে

- আপডেট সময় : ৫০ বার পড়া হয়েছে
বাংলাদেশের প্রকৌশল খাত দীর্ঘদিন ধরেই নানা সমস্যায় জর্জরিত। এর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ও দীর্ঘস্থায়ী একটি ইস্যু হলো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা প্রকৌশলী এবং ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের মধ্যে দ্বন্দ্ব। পদোন্নতি, নিয়োগ, মর্যাদা এবং দায়িত্ব বণ্টন নিয়ে উভয় পক্ষের মধ্যে বিরাজমান টানাপোড়েন এখন তীব্র আকার ধারণ করেছে। শুধু কর্মক্ষেত্র নয়, সংগঠন, আন্দোলন ও নীতি নির্ধারণের জায়গাতেও এ দ্বন্দ্ব স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশে প্রকৌশল শিক্ষা দুই ধাপে পরিচালিত হয়ে আসছে চার বছর মেয়াদি বিশ্ববিদ্যালয় ডিগ্রি (বি.এসসি ইন ইঞ্জিনিয়ারিং) এবং চার বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং। স্বাধীনতার পর থেকেই ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়াররা সরকারি চাকরিতে স্বীকৃতি ও পদোন্নতির জন্য আন্দোলন করে আসছেন। তাদের দাবি, তারা মাঠপর্যায়ে বেশি সময় কাজ করেন এবং প্রকল্প বাস্তবায়নে সরাসরি ভূমিকা রাখেন। অপরদিকে, বিশ্ববিদ্যালয় স্নাতক প্রকৌশলীরা মনে করেন, নেতৃত্ব, নকশা ও গবেষণার দায়িত্ব কেবল তাদের উপর বর্তানো উচিত। এভাবেই প্রায় পাঁচ দশক ধরে দ্বন্দ্ব জিইয়ে আছে।
সম্প্রতি কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের প্রকল্পে পদোন্নতি ও নিয়োগে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়াররা বঞ্চিত হওয়ার অভিযোগ তুলেছেন। বাংলাদেশ ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন (আইডিইবি) বেশ কিছু কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। আইডিইবি সভাপতি মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, আমরা দেশের সেতু, রাস্তা থেকে শুরু করে বিদ্যুৎকেন্দ্র পর্যন্ত প্রত্যেকটি উন্নয়ন কর্মকান্ডে মূল ভূমিকায় কাজ করি। অথচ পদোন্নতি বা প্রশাসনিক দায়িত্বের ক্ষেত্রে আমাদের উপেক্ষা করা হয়। এটি অন্যায় এবং অগ্রহণযোগ্য।
অন্যদিকে, বিশ্ববিদ্যালয় স্নাতক প্রকৌশলীরা বলছেন, কারিগরি সহায়তা ও মাঠপর্যায়ে ডিপ্লোমাদের ভূমিকা অবশ্যই আছে, তবে নেতৃত্বের জায়গায় তাদের থাকা উচিত নয়। ইনস্টিটিউশন অব ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশ (আইইবি)-এর সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী মাহমুদুল হক মন্তব্য করেন, প্রকৌশল পেশার মান ধরে রাখতে হলে কাজের স্তরভেদ বজায় রাখা জরুরি। ডিপ্লোমারা অভিজ্ঞ হলেও তারা প্রশিক্ষণ ও গবেষণামুখী শিক্ষা পাননি। তাই নীতি নির্ধারণ বা প্রকল্প নেতৃত্বে তাদের সমান মর্যাদা দেওয়া সম্ভব নয়।
সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো এখনো সুস্পষ্ট কোনো নীতিমালা দিতে পারেনি। এক উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, উভয় পক্ষের চাপ আমাদের উপর রয়েছে। ডিপ্লোমারা মাঠপর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করলেও নীতিগত কারণে বিশ্ববিদ্যালয় ডিগ্রিধারীদের অগ্রাধিকার দিতে হয়। এ কারণে সিদ্ধান্ত নিতে দেরি হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দ্বন্দ্বের মূল কারণ হলো দায়িত্ব ও কর্তৃত্বের অস্পষ্টতা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আনিসুর রহমান বলেন, ডিপ্লোমা ও স্নাতক প্রকৌশলীদের মধ্যে কাঠামোগত সীমারেখা স্পষ্ট না হওয়ায় এ সমস্যা বারবার দেখা দিচ্ছে। একদিকে উচ্চশিক্ষা অর্জনকারীদের মর্যাদা নিশ্চিত করতে হবে, অন্যদিকে মাঠপর্যায়ের কারিগরি বিশেষজ্ঞদের অভিজ্ঞতাও সমানভাবে মূল্যায়ন করা জরুরি। তিনি আরও বলেন, দুই শ্রেণির মধ্যে প্রতিযোগিতা চলতে থাকলে উন্নয়ন কার্যক্রম ব্যাহত হবে। তাই সরকারের এখনই সুনির্দিষ্ট নীতিমালা তৈরি করা উচিত।
এই দ্বন্দ্ব শুধু পেশাজীবীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, বরং জাতীয় উন্নয়ন কর্মকান্ডে এর প্রভাব পড়ছে। সড়ক-মহাসড়ক, বিদ্যুৎ, আবাসনসহ বিভিন্ন প্রকল্পে কাজের সমন্বয়হীনতা দেখা দিচ্ছে। ডিপ্লোমারা মনে করেন তারা বঞ্চিত, আর প্রকৌশলীরা মনে করেন তারা অবমূল্যায়িত হচ্ছে। এর ফলে যৌথভাবে কাজের পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
বিশ্লেষকদের মতে, দ্বন্দ্ব নিরসনে সরকারের তিনটি পদক্ষেপ জরুরি: সুস্পষ্ট দায়িত্ব বণ্টন: কোন কাজে স্নাতক প্রকৌশলীরা নেতৃত্ব দেবেন এবং কোন কাজে ডিপ্লোমারা সহায়ক ভূমিকা পালন করবেন তা নীতিগতভাবে নির্ধারণ করতে হবে। পদোন্নতির ন্যায্য কাঠামো: মাঠপর্যায়ে অভিজ্ঞ ডিপ্লোমাদের জন্য পদোন্নতির সুযোগ তৈরি করতে হবে, যাতে তাদের কাজের স্বীকৃতি থাকে। যৌথ প্ল্যাটফর্ম: প্রকৌশলী ও ডিপ্লোমাদের মধ্যে সমন্বয়ের জন্য যৌথ কমিটি বা প্ল্যাটফর্ম গঠন করা যেতে পারে, যা পারস্পরিক আস্থা বাড়াবে।
তারা মনে করেন, এই দ্বন্দ্ব দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত কাঠামোগত সমস্যার ফল। একদিকে প্রকৌশল শিক্ষার মানোন্নয়ন জরুরি, অন্যদিকে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের শ্রম ও অভিজ্ঞতাকে অবমূল্যায়ন করাও ঠিক নয়। উভয় পক্ষের জন্য সুস্পষ্ট দায়িত্ব নির্ধারণ করা গেলে দ্বন্দ্ব প্রশমিত হতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, উভয় পক্ষকে আলোচনার টেবিলে এনে একটি দীর্ঘমেয়াদি কাঠামো তৈরি করতে হবে। যেখানে স্পষ্টভাবে নির্ধারণ করা থাকবে কোন দায়িত্বে বিশ্ববিদ্যালয় স্নাতক প্রকৌশলীরা থাকবেন এবং কোন দায়িত্বে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়াররা কাজ করবেন। এতে দ্বন্দ্ব কমবে এবং উন্নয়ন কর্মকাণ্ড গতি পাবে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়েছে, বিষয়টি পর্যালোচনা করা হচ্ছে। তবে বাস্তবে এখনো কোনো স্থায়ী সমাধান পাওয়া যায়নি। ডিপ্লোমা ও প্রকৌশলী সংগঠনগুলোর চাপ এবং আন্দোলনের কারণে সরকারকেও জটিল পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে। বাংলাদেশ এখন অবকাঠামো ও শিল্পখাতে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। এই অগ্রযাত্রায় প্রকৌশলী ও ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার উভয়ের অবদান অপরিসীম। কিন্তু পারস্পরিক দ্বন্দ্ব যদি বাড়তেই থাকে, তবে উন্নয়ন কার্যক্রম ব্যাহত হবে এবং পেশার মানও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই এখনই সরকারের কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি, যাতে প্রকৌশল ও ডিপ্লোমা উভয় শ্রেণির পেশাজীবীরা একসঙ্গে দেশের উন্নয়নে কাজ করতে পারেন।