শিক্ষাঙ্গনে আতঙ্ক আর অস্থিরতা

- আপডেট সময় : ৮৭ বার পড়া হয়েছে
বাংলাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো দীর্ঘদিন ধরেই নানা সমস্যার সম্মুখীন হলেও সাম্প্রতিক সময়ে ক্যাম্পাসে হামলার ঘটনা এক নতুন মাত্রায় উদ্বেগ তৈরি করেছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘটিত হামলা শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবকসহ পুরো সমাজে আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হলো জ্ঞানচর্চা, মুক্ত চিন্তা ও গবেষণার জায়গা; সেখানে সহিংসতা ও ভয়ের পরিবেশ শিক্ষার স্বাভাবিক ধারা ব্যাহত করছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থানীয়দের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ এবং হামলার ঘটনায় দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে এক ধরনের আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (চবি) গত শনিবার রাত থেকে শুরু হওয়া সংঘর্ষের ঘটনায় দুই শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। আহতদের মধ্যে কারও কারও অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় এখনও হাসপাতালের আইসিইউতে রয়েছে। শনিবারের হামলার পর রোববার দুপুরে ফের হামলা শুরু হয়। দুপুর সাড়ে ৪টায় সংঘর্ষের প্রায় ৬ ঘণ্টা পর ঘটনাস্থলে আসে যৌথবাহিনী। তারা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের সর্বাত্মক চেষ্টা করে। এর আগে, দুপুর ২টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ২ নম্বর গেট এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করেন হাটহাজারি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল মুমিন। যা সোমবার রাত ১২টা পর্যন্ত এ আদেশ কার্যকর থাকবে বলে বলা হয়। ভাড়া বাসার দারোয়ান এক ছাত্রীকে মারধর করেছেনএমন খবরে গত শনিবার রাত সোয়া ১২টার দিকে জোবরা গ্রামবাসীর সঙ্গে শিক্ষার্থীদের এই সংঘর্ষ শুরু হয়।
শিক্ষার্থীরা জানান, হামলাকারীদের কারও মাথায় হেলমেট, কেউ মুখোশ পরা; রামদা হাতে তাঁরা মারধর করছিলেন শিক্ষার্থীদের উপর। কুপিয়ে জখম করার পর শিক্ষার্থীদের লাথিও মারা হয়। দুই দিন পার হলেও মুখোশ পরা ব্যক্তিদের শনাক্ত করতে পারেনি পুলিশ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
কম্বাইন্ড বা সমন্বিত ডিগ্রির দাবিতে উপাচার্যসহ দুই শতাধিক শিক্ষককে অবরুদ্ধ করার পর আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনার জেরে ময়মনসিংহে অবস্থিত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি) অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। পাশাপাশি সোমবার সকাল ৯টার মধ্যে শিক্ষার্থীদের হল ত্যাগের নির্দেশ দেওয়া হয়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, রাতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনা করছিলেন ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসক মুফিদুল আলম এবং অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা) সৈয়দ শাহনেওয়াজ মোর্শেদ অপু। এ সময় শিক্ষার্থীদের ওপর লাঠি হাতে হামলা চালায় একদল ব্যক্তি। শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করে তারা শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন মিলনায়তনের তালা খুলে অবরুদ্ধ শিক্ষকদের বের করে দেয়। হামলাকারীদের পরিচয় তাৎক্ষণিকভাবে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
উদ্ভুত পরিস্থিতিতে গত রোববার রাত ১০টা ১০মিনিট থেকে ২ প্লাটুন মোতায়েন করা হয়। রাত ১১ টা ৫ মিনিটে বিজিবি থেকে পাঠানো বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তা দিতে জেলা প্রশাসকে অনুরোধক্রমে সেনাবাহিনী, পুলিশ ও অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে দায়িত্ব পালনের জন্য ময়মনসিংহ ব্যাটালিয়ন (৩৯ বিজিবি) থেকে দুই প্লাটুন বিজিবি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় মোতায়েন করা হয়েছে। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে সেনাবাহিনী, পুলিশ, র্যাব এবং অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে বিজিবি স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে বলে জানান ৩৯ বিজিবির অধিনায়ক ল্যাফটেনেন্ট কর্নেল মেহেদী হাসান।
এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন ঘিরে শিক্ষার্থীদের মধ্যে দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা থাকলেও হাইকোর্টের রায় স্থগিত হওয়া তার পরে আবার স্থগিত রায়ের উপর স্থগিত তা অনিশ্চয়তায় পড়ে গেছে। কিন্তু নির্বাচনী কার্যক্রম আপাতত বন্ধ না থাকলেও ক্যাম্পাসে অস্থিরতা থেমে নেই। শিক্ষার্থীদের মধ্যে হতাশা, ক্ষোভ এবং অনিশ্চয়তা এক অস্বাভাবিক পরিবেশ তৈরি করেছে।
এছাড়া জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন্ন ছাত্র সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা চরমে পৌঁছেছে। একাধিক ছাত্র সংগঠনের মধ্যে আধিপত্য বিস্তার ও প্রভাব প্রতিষ্ঠার প্রতিযোগিতা সংঘর্ষে রূপ নিয়েছে। এতে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে, স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে অস্থিরতা দিন দিন বাড়ছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে আধিপত্য বিস্তার ও সংঘর্ষের কারণে শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের পরিবেশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা নির্বাচন চাইলেও প্রশাসন নিরাপত্তার অজুহাতে সিদ্ধান্তহীনতায় রয়েছে।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের দ্বন্দ্ব এবং বহিরাগতদের হস্তক্ষেপে নির্বাচন নিয়ে আতঙ্ক বিরাজ করছে।
শিক্ষাবিদরা মনে করছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থানীয়দের অনধিকার প্রবেশ এবং হামলার ঘটনা দেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার জন্য বড় হুমকি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হলো শিক্ষার্থীদের চিন্তাচর্চা ও গবেষণার জায়গা। সেখানে যদি বাইরের লোক এসে হামলা চালাতে পারে, তাহলে শিক্ষার্থীরা নিশ্চিন্তে পড়াশোনা করবে কীভাবে? তাদের মতে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। ক্যাম্পাসে প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ, সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন, পর্যাপ্ত নিরাপত্তা কর্মী নিয়োগ এবং স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় বাড়ানো ছাড়া বিকল্প নেই।
চট্টগ্রাম ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনায় অভিভাবকদের মধ্যে চরম আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। অনেকে সন্তানদের পড়াশোনার মানসিক অবস্থা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। অভিভাবকরা বলছেন, সন্তানরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়ে যদি প্রতিনিয়ত নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে, তাহলে তা পড়াশোনা ও ভবিষ্যৎ ক্যারিয়ারের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হবে।
অন্যদিকে দেশের অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। তারা বলছেন, যদি চট্টগ্রাম ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বড় প্রতিষ্ঠানে এভাবে স্থানীয়দের হামলা হয়, তাহলে অন্য বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে পারে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থানীয়দের হামলার ঘটনায় আবারও স্পষ্ট হলো, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা কতটা দুর্বল। শিক্ষার্থীদের নিরাপদ পরিবেশে পড়াশোনা করার অধিকার নিশ্চিত করতে হলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে যৌথভাবে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। অন্যথায় শিক্ষাঙ্গনে যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে, তা দেশের উচ্চশিক্ষা ও আগামী প্রজন্মের জন্য ভয়াবহ সংকট ডেকে আনতে পারে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে সাম্প্রতিক হামলার ঘটনাকে কেন্দ্র করে শিক্ষাঙ্গনে ব্যাপক অস্থিরতা ও আতঙ্ক বিরাজ করছে। এই হামলার ঘটনাগুলো নিয়ে বিশিষ্ট ব্যক্তিরা নানা মতামত প্রকাশ করেছেন।
শিক্ষাবিদরা মনে করেন, বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে মুক্তচিন্তা, গবেষণা ও শিক্ষার জায়গা। কিন্তু সেখানে যদি সন্ত্রাস, সহিংসতা বা বহিরাগতদের প্রভাব প্রবেশ করে, তবে তা শুধু শিক্ষার পরিবেশকেই নয়, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মানসিক বিকাশকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে। তাঁরা বলেন, এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে প্রশাসনকে কঠোর হতে হবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এ ধরনের হামলার পেছনে প্রভাবশালী গোষ্ঠীর হাত থাকতে পারে। শিক্ষাঙ্গনকে রাজনৈতিক শক্তি প্রদর্শনের ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করা একটি পুরোনো প্রবণতা। এ থেকে মুক্তি পেতে হলে রাজনৈতিক দলগুলোকেই দায়িত্বশীল ভূমিকা নিতে হবে।
এমটি/ এএটি