শান্তির খোঁজে বিশ্বনেতারা

- আপডেট সময় : ১৫৮ বার পড়া হয়েছে
জাতিসংঘের ৮০তম সাধারণ অধিবেশনে বিশ্বের শীর্ষ নেতারা এক মঞ্চে সমবেত হয়ে শান্তি, নিরাপত্তা, মানবাধিকার, জলবায়ু পরিবর্তন ও টেকসই ইন্নয়নের মতো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহবান জানিয়েছেন। বহুমাত্রিক বৈশ্বিক সংকট, বিশেষ করে ইউক্রেন যুদ্ধ, ফিলিস্তিনের যুদ্ধ পরিস্থিতি ও মধ্যপ্রাচ্যের অস্থিরতা, জলবায়ু বিপর্যয় এবং বৈষম্যের চ্যালেঞ্জ আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এসেছে।
২২ সেপ্টেম্বর শুরু হওয়া অধিবেশনের উদ্ধোধনী বক্তব্যে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেন, ৮০ বছর আগে জাতিসংঘ সঠিক হয়েছিল বিশ্বকে ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ থেকে রক্ষা করতে। আজও আমাদের দায়িত্ব অপরিবর্তিত, বরং আরও বেড়েছে। শান্তি, নিরাপত্তা ও টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে। তিনি সতর্ক করেন, যুদ্ধ, জলবায়ু সংকট ও বৈষম্য মানবজাতির অস্থিত্বকে হুমকির মুখে ফেলেছে।
এবারের অধিবেশনে সবচেয়ে আলোচিত ছিল চলমান বৈশ্বিক সংঘাত। ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব নিয়ে পশ্চিমা ও রুশ প্রতিনিধিদের মধ্যে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য হয়। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলো রাশিয়ার আগ্রাসন বন্ধের দাবি জানায়। অন্যদিকে রাশিয়া পশ্চিমা বিশ্বের দ্বিচারিতা ও নিষেধাজ্ঞা নীতিকে দায়ী করছে। ফিলিস্তিনের যুদ্ধ পরিস্থিতি ও মধ্যপ্রাচ্যের অস্থিরতা নিয়েও উত্তেজনাপূর্ণ আলোচনা হয়। আরব দেশগুলোর প্রতিনিধিরা গাজায় অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি ও মানবিক সহায়তা নিশ্চিত করার আহবান জানান। একইসঙ্গে ইসরায়েলের অব্যাহত আগ্রাসন বন্ধে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃঢ় ভূমিকা রাখার দাবি ওঠে। এদিকে সিরিয়া, ইয়েমেন ও লিবিয়ার অস্থিরতাও আলোচনায় স্থান পায়। বিশ্বনেতারা স্বীকার করেন, এসব সংঘাত কেবল প্রাণহানি ঘটাচ্ছে না, বরং বৈশ্বিক খাদ্য ও জ¦ালানি নিরাপত্তাকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহতা এবারও আলোচনায় প্রাধান্য পায়। ইউরোপের রেকর্ড তাপপ্রবাহ, আফ্রিকার খরা, এশিয়ার বন্যা এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্র ও উপকূলীয় দেশগুলো টিকে থাকা হুমকির মুখে পড়েছে। বাংলাদেশ, মালদ্বীপ ও ভানুয়াতুর মতো ঝুকিপূর্ণ রাষ্ট্রগুলো উন্নত দেশগুলোর কাছে প্রতিশ্রুতি জলবায়ু তহবিল দ্রুত বাস্তবায়নের জোর দাবি জানায়। বাংলাদেশের প্রতিনিধি বলেছেন, আমরা জলবায়ুর শিকার, দায়ী নই। তাই উন্নত রাষ্ট্রগুলোকে ন্যায্য দায়িত্ব নিতে হবে। জলবায়ু অভিযোজন, ক্ষয়ক্ষতি তহবিল এবং প্রযুক্তিগত সহায়তার বিষয়েও গভীর আলোচনা হয়।
এবারের অধিবেশনে মানবাধিকার প্রশ্নও গুরুত্ব পায়। মহাসচিব গুতেরেসসহ অনেক রাষ্ট্রপ্রধান বৈশ্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। দমন-পীড়ন, শরণার্থী সংকট এবং যুদ্ধাপরাধের বিষয়ে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বাড়ানোর ওপর জোর দেওয়া হয়। আফগানিস্তানে নারীর অধিকার লঙ্ঘন, মিয়ানমারে গণতন্ত্রকামীদের দমন এবং শরণার্থীদের দুর্দশা আলোচনায় উঠে আসে।
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের অগ্রগতি নিয়েও বিস্তর আলোচনা হয়। জাতিসংঘের সর্বশেষ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, লক্ষ্য পূরণের পথে বৈশ্বিক অগ্রগতি আশানুরূপ নয়। করোনোত্তর অর্থনৈতিক মন্দা, ঋণ সংকট, জলবায়ু বিপর্যয় ও যুদ্ধ পরিস্থিতি উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করছে। আফ্রিকা ও দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশ দারিদ্র্য ও বৈষম্য হ্রাসে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করতে পারেনি। উন্নত রাষ্ট্রগুলো আর্থিক সহায়তা বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিলেও তা কতটা বাস্তবায়িত হবে তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই গেছে।
প্রযুক্তিগত বৈষম্যও এবারের আলোচনায় গুরুত্ব পায়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, সাইবার নিরাপত্তা ও ডিজিটাল বৈষম্য ভবিষ্যতের নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে চিহ্নিত হয়। অনেক দেশের আশঙ্কা, প্রযুক্তিগত সুবিধা যদি কেবল উন্নত দেশগুলোর হাতেই সীমিত থাকে, তবে বৈষম্য আরও তীব্র হবে এবং উন্নয়নশীল দেশগুলো পিছিয়ে পড়বে।
বাংলাদেশ এবারের অধিবেশনে শান্তি, উন্নয়ন ও জলবায়ু ইস্যুতে দৃঢ় অবস্থান তুলে ধরে। প্রতিনিধি দল জানায়, বাংলাদেশ সবসময় শান্তির পক্ষে, সংলাপ ও সহযোগিতার পক্ষে। জলবায়ু পরিবর্তনে ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কার্যকর ভূমিকার দাবি জানায়। পাশাপাশি জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের অবদানের কথাও তুলে ধরা হয়। বাংলাদেশের বক্তব্যে দারিদ্র্য হ্রাস, বৈষম্য কমানো এবং এসডিজি অর্জনে উন্নত দেশগুলোর সহযোগিতা অপরিহার্য বলে উল্লেখ করা হয়।
অধিবেশনে সমগ্র আলোচনার মধ্য দিয়ে পরিষ্কার হয় যে, আজকের বিশ্ব এক গভীর সংকটকাল অতিক্রম করছে। যুদ্ধ, জলবায়ু পরিবর্তন, বৈষম্য ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো বহুমুখী সমস্যার সমাধান এককভাবে কোনো রাষ্ট্রের পক্ষে সম্ভব নয়। এজন্য দরকার বৈশ্বিক ঐক্য, আস্থা ও সহযোগিতার ভিত্তিতে কার্যকর উদ্যোগ। মহাসচিব গুতেরেস বলেন, “শান্তি ও উন্নয়ন ছাড়া নিরাপত্তা সম্ভব নয়, আর নিরাপত্তা ছাড়া মানবাধিকার রক্ষা করা যায় না। পৃথিবীকে রক্ষার জন্য এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে।”
জাতিসংঘের ৮০তম সাধারণ অধিবেশন তাই শুধু আনুষ্ঠানিক সমাবেশ নয়, বরং মানবজাতির সামনে নতুন করে অঙ্গীকার করার এক মঞ্চ। এখান থেকে যে বার্তা উঠে এসেছে তা হলো—বিশ্বনেতাদের রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও সম্মিলিত উদ্যোগ ছাড়া শান্তি, নিরাপত্তা, উন্নয়ন ও মানবাধিকার নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। জলবায়ু সংকট মোকাবিলা, সংঘাত নিরসন, বৈষম্য হ্রাস এবং এসডিজি অর্জনের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি টেকসই ও শান্তিপূর্ণ পৃথিবী গড়ে তোলাই এখন সবচেয়ে বড় দায়িত্ব।