মহাসড়কেও মাদকের হাট

- আপডেট সময় : ২৩০ বার পড়া হয়েছে
দেশের মহাসড়কগুলোর পাশে খাবারের হোটেলগুলোতে দেদারছে বিক্রি হচ্ছে মাদক। দিনের চেয়ে রাতেই সবচে বেশী মাদক বেচা কেনা হচ্ছে। তবে দেশের অন্যান্য সড়কগুলো থেকে বেশী মাদক বেচাবেনা হচ্ছে ঢাকা চট্টগ্রাম কক্সবাজার রুটে। ঢাকা সিলেট ছাতক সুনামগঞ্জ রোডে, ঢাকা রাজশাহী বগুড়া, রংপুর, যশোর, বেনাপোল সাতক্ষীরা। অন্যদিকে ঢাকা খুলনা বরিশাল মহাসড়কে জমজমাট হয়ে উঠেছে মাদক ব্যবসা। তবে এ ব্যবসার কিছু ভাগ পাচ্ছে আন্তজেলা বাস চালক সুপার ভাইজার ও হেলপার। দেশের সীমান্ত এলাকাগুলোতে বেপরোয়া মাদক পাচার হচ্ছে। দিনের চেয়ে রাতের পুলিশসহ আইনশৃংখলা বাহিনীর টহল কম থাকার সুযোগে মাদক ব্যবসায়ীরা চুটিয়ে মাদক বেচাকেনা করছে। শুধু তাই নয়, ওই সকল অভিজাত রেস্তোরা বা খাবার হোটেলগুলোতে ুিনর্ধারিত থাকে, আন্তঃজেলা কোন সার্ভিসের বাসগুলো কোন হোটেলে পার্কি করবে বা যাত্রা বিরতি দিবে। গভীর রাতে ওই হোটেলের লবিতে অথবা আশপাশের পার্কিংয়ে বসে থাকে মাদক ব্যবসায়িরা। তাদের কাছে আইস থেকে শুরু করে ইয়াবা, ফেন্সিডিল, গাঁজাসহ সবই পাওয়া যায়। নাইটে মহাসড়কে চলাচল অভিজাত কোচে চলাচলকারী তরুন যাত্রীরা রাতের খাবারের উছিলায় এ মাদক গ্রহন করে নেশায় বুঁধ হয়ে বাসে ঘুমিয়ে থাকে। সকাল হলে সায়েদাবাদ, কমলাপুর, ফকিরেরপুল অথবা গাবতলী মিরপুর, মহাখালী টঙ্গী ও কলাবাগান সোবাহানবাগে আসলে সুপারভাইজার ও হেলপার তাদেও জেগে নামতে বলেন। তখনো দেখা যায় তাদের ঘুম ও নেশা কাটেনি। এসময় হাইওয়ে পুলশ চেকপোষ্টে এ সকল যাত্রীর পারিপার্শ্বিক অবস্থা দেখে লাগেজ চেক করে মাদক জব্দ করেছে। অবশ্য ব্যবসার খ্যাতিরে সে সময় বাসের সুপারভাইজার ও হেলপার চালক মিলে পুলিশ ম্যানেজ করে মাদক সেবী তরুন যাত্রীদের রেখে দেন। এমন অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে। তবে মাদকের চালান ধরা পড়লে সে ঘটনায় পুলিশ কোনো ছাড় দিচ্ছে না।
অভিযোগে জানা গেছে, মহাসড়কের যাত্রাবিরতি হোটেলগুলোর আড়ালে মাদকের জমজমাট কারবার চলছে। মহাসড়কে যাত্রাবিরতিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা অনেক রেস্টুরেন্টেই খাবার ব্যবসার আড়ালে চলছে রমরমা মাদক কারবার। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লা অংশের সুয়াগাজী, চৌয়াড়া, মিয়াবাজার, বাতিসা, বাবুর্চীবাজারের প্রতিটি ষ্টেশনের বিপরীতে পাশেই রয়েছে সীমান্ত। এ সকল সীমান্তে বিজিবির চেকপোষ্ট বা বিওপি থাকলেও ক্ষানিকটা রাত হলেই এ সকল সীমান্ত দিয়ে মাদক, কাঠ, চিনিসহ সকল ধরনের মসলা আনা হচ্ছে ভারত থেকে। বিচ্ছিন্ন ভাবে বিজিবি দুএকটি চালান ধরলেও অধিকাংশই ফসকে যাচ্ছে রহস্যজনক কারনে। আর এসকল এলাকায় সবচেয়ে বেশী হাইওয়ে হোটেল। সে হোটেলেই বিক্রি হচ্ছে মাদক। বেশিরভাগ রেস্তোরাঁয় এমন মাদক কারবারের প্রমাণ মিলেছে। চালকদের টার্গেট করে গড়ে উঠেছে এই সিন্ডিকেট। অনুসন্ধানে উঠে এসেছে এমন মাদক কারবারের ভয়ংকর চিত্র। জানা গেছে, ঘটনাস্থল কুমিল্লার দাউদকান্দি। সেখানে মধ্যরাতে এক মাদক বিক্রেতার কাছে জানতে চাওয়া হয়, থেমে থাকা ট্রাকচালকের কাছে কি বিক্রি করলেন? এমন প্রশ্ন করতেই দৌঁড়ে পালালেন এই ব্যক্তি। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ট্রাকটিও বেপরোয়া গতিতে জায়গা ছাড়লো।
ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লা অংশের দাউদকান্দি এলাকার চিত্র এটি। চালকের কাছে কি বিক্রি করা হয়েছে তা জানতে দৌড় পালানো লোকটির পিছু নিয়েও তার পাত্তা মিললো না। পরে জানা গেলো তিনি সেখানে একটি রেস্তোরার ম্যানেজার, নাম আক্কাস। মহাসড়কে যাত্রাবিরতির জন্য কুমিল্লার দাউদকান্দি সুন্দরগঞ্জ, গৌরীপুর, ইলিয়টগঞ্জ, এলাকায় চারশ’রও বেশি রেস্তোরাঁ। অর্থাৎ কিলোমিটার প্রতি প্রায় চারটি। তথ্য বলছে, এই রেস্তোরার একটা বড় অংশে খাবারের আড়ালে মূলত চলে মাদক কারবার। যাদের মূল টার্গেট বিভিন্ন পরিবহনের চালকরা। এসকল পাওয়া তথ্য যাচাই করতে ছদ্মবেশে এসব রেস্তোরাঁয় অভিযানে নামে অনুসন্ধান করতে গিয়ে সেখানের কদমতলি পাড় না হতেই রাস্তায় দাঁড়িয়ে কয়েকজন যুবক। দাঁড়াতেই কাছে এগিয়ে আসলো তারা, চাহিবামাত্র মিললো মাদকও। পাশাপাশি এবার সত্যতা যাচাইয়ে একটি রেস্তোরাঁয় প্রবেশ করে প্রমান পাওয়া গেলো। একটি নাইটকোচ থামতেই এগিয়ে আসে ম্যানেজার। পরে রেস্তোরার মধ্যে বসে বিভিন্ন কথাবার্তার ফাঁকে চলতে থাকে মাদক নিয়ে কথা চালাচালি। অল্প সময়ের ব্যবধানে নিজের প্রতিষ্ঠানের সেবার মান বোঝাতে মাদক নিয়ে হাজির ম্যানেজার।
এবার রেস্টুরেন্টেই সেবন করে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলে সঙ্গে সঙ্গে দেখিয়ে দেওয়া হয় পাশের টিনসেড ঘর। ভেতরে ঢুকতেই বোঝা যায় মাদকসেবীদের জন্য আলাদাভাবে নির্মাণ করা হয়েছে এ জায়গা। সরেজমিনে এমন সাঁড়ি সাঁড়ি ঘরের দেখা মেলে ঢাকা-কুমিল্লা হাইওয়ের ধার ঘেষে। সেগুলোর ভেতরে প্রবেশ করতেই বোঝা যায় মাদক সেবনের জন্যই আলাদাভাবে নির্মাণ করা হয়েছে এসব ঘর। এবার কিছুক্ষণ রাস্তায় দাঁড়িয়ে চলমান যানবাহনগুলোর ওপর নজর দিতেই সন্দেহজনক একটি ট্রাককে কিছু একটা নিতে দেখে তার পিছু যেতেই প্রথমে অস্বীকার করলেও হাতেনাতে মাদকসহ ধরা পড়ে যায় হেলপার। চালকদের হাতে এভাবে মাদক তুলে দেয়া সড়ক দুর্ঘটনার যে অন্যতম কারণ তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
তারপরও পুলিশ নীরব কেন? সংশ্লিষ্ট হাইওয়ে থানায় যাওয়ার আগে থানা ঘেষা একটি রেস্টুরেন্টের চিত্র দেখতে যায় গনমাধ্যমকর্মীরা। ভেতরে ঢুকেই খাবার অর্ডার করে । খাবার পরিবেশন করতে করতেই কৌশলে আর কি লাগবে সেই প্রস্তাব দিয়ে বসে হোটেল ম্যানেজার। আর কত সময় লাগবে, সেকথা জানতে চাওয়া মাত্রই দোকানের ক্যাশ থেকেই বের করে দেওয়া হয় ইয়াবা। ফেনসিডিল চাইলে ১০ মিনিট সময় চায় ম্যানেজার। পরে সেখানেই মাদক সেবনের আবদার করা হলে সঙ্গে সঙ্গেই নিয়ে যাওয়া হয় কেবিনে। সহযোগী হিসেবে দিয়ে দেয়া সেখানে অপেক্ষারত এক ট্রাক চালককেও। কিছুক্ষণ পরই চলে আসে ফেনসিডিল। অপেক্ষমান সময়ে অনেক গাড়িকেই থামতে দেখা যায় হাইওয়ে থানার ধার ঘেষে গড়ে ওঠা রেস্তোরাঁটিতে। মালিক জানায় কাউকেই তোয়াক্কা করে না তারা।
এবার ছদ্মবেশে ছেড়ে সাংবাদিক হিসেবে রেস্তোরাটিতে যায় গনমাধ্যমকর্মিরা। ভয়ে এলেমেলো কথা শুরু করে দেয় তারা। অকপটে জানিয়ে দেয় মাদক না রাখলে কোনো গাড়িই থামে না রেস্তোরাঁয়। ম্যানেজারকে থানায় যেতে বলা হলে হাতে পায়ে ধরা শুরু করে। কোনো ক্ষতি করবো না এমন শর্তে তাকে থানায় নিতে রাজি করানো হয়। তবে হাইওয়ে থানা পুলিশের বক্তব্য ভড়কে ওঠার মতোই, তারা নাকি এর কিছুই জানে না।
এত গেল ঢাকা চট্টগ্রাম কক্সবাজার মহাসড়কের চিত্র। এরপরে ঢাকা খুলনা মহাসড়কের অবস্থা আরো নাজুক। এ মহাসড়কে গভীররাতে নাইটকোচগুলোতে মাওয়া টোলপ্লাজা থেকে শুরু করে ভাঙ্গার মোড় এরপর নগরকান্দার জয়বাংলার মোড় পর্যন্ত রেস্তোরাগুলোতে সকল প্রকারের মাদক বিক্রি হচ্ছে। অপরদিকে ঢাকা সিলেট রুটের ভৈরব, আশুগঞ্জ, বিশ্বরোড, চান্দুরা, তেলিয়াপাড়া, চুনারুঘাট, মাধবপুর ছেড়ে শায়েস্তাগঞ্জ পর্যন্ত গভীররাতে সকল রেস্তোরায় খাবারের পাশাপাশি পাওয়া যাচ্ছে সকল প্রকারের মাদক।
অপরদিকে ঢাকা সিরাজঘঞ্জ পাবনা বগুড়া রাজশাহী, রংপুর, দিনাজপুর কুষ্টিয়া মহাসড়কের হাল একই অবস্থা। মধ্যরাতে ওই মহ্সাড়কের পাশে রাত্রিকালিন হোটেলগুলোতে দেদারছে মাদক বিক্রি হচ্ছে। এ সকল মাদক ব্যবসায় কোচের চালক হেলপার, সুপারভাইজার, হোটেল ম্যানেজার ও কর্মচারীরা সরাসরি জড়িত রয়েছে। এরা প্রভাবশালী হওয়ার এদের নিয়ে কেউ কোনো অভিযোগ করতে সাহস পায় না।
অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতিদিন যে দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাচ্ছে ১৫ জনের বেশি মানুষ। সে দেশে চালকদের হাতে এভাবে মাদক তুলে দেওয়ায় অভয়ারণ্য কেনো করে রাখা হয়েছে যাত্রাবিরতিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এসব রেস্তোরাঁয় তা নিয়ে পুলিশ মহাপরিদর্শকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি দায় চাপান মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ওপর। পরে সেই দপ্তরের সঙ্গেই কথা বলে জানা গেছে। একে অন্যের ঘাড়ে দায় না চাপিয়ে সড়ক দুর্ঘটনার ভয়াবহতা কমাতে বন্ধ হবে এসব অভয়ারণ্য সে প্রত্যাশাই সবার।