সিলেট আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস : পর্ব-১
মার্কার রাজত্ব: টাকাই যেন আসল পাসপোর্ট!
- আপডেট সময় : ১৫ বার পড়া হয়েছে
সিলেট আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসকে ঘিরে বেড়েছে মার্কার রাজত্। যেখানে ২০২৫ সালে এসে প্রতিটি নাগরিক নিজে নিজে পাসপোর্টের আবেদন করছে, সেখানে সেই ফাইল গ্রহণ করছেন না সিলেট আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে কর্মরত কর্মকর্তাগণ। ভূক্তভোগীদের পাসপোর্ট ফাইল সুস্পষ্ট থাকলেও পাসপোর্ট অফিস কর্তৃক কোনো ভুল ছাড়াই ফাইল রিজেক্ট করে দিচ্ছেন তারা।
আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে এখন অনলাইনে (ই-পাসপোর্ট) আবেদন সম্পন্ন করা গেলেও আবেদনকারীরা প্রতিদিনই নানা হয়রানির শিকার হচ্ছেন দালাল ও মার্কার কারণে। কৌশল পাল্টে আরও সুপরিকল্পিতভাবে তারা সাধারণ মানুষের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে অর্থ। সিলেট নগরীর আলমপুরে অবস্থিত আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের ভিতর এখন মার্কা বাণিজ্যে ভরপুর লাভবান! তাদের সাথে রয়েছে পাসপোর্ট অফিস সংলগ্ন ফটোকপির দোকানগুলোর অলিখিত চুক্তি। রিজেক্ট হওয়া ফাইল নিয়ে যখন ভুক্তভোগী ওইসব দোকানে যান, তখন দোকানদাররা চুক্তি করেন দুই থেকে আড়াই হাজার টাকার। যদি চুক্তি কনফার্ম হয়, তাহলে দোকানদার ওই রিজেক্ট হয়ে যাওয়া ফাইলে অফিস থেকে পাওয়া অফিসিয়াল মেইল সহজ ভাষায় যাকে বলা হয় মার্কা সেটি বসিয়ে দেন।
এবার এই মার্কাযুক্ত ফাইল নিয়ে ভুক্তভোগী যখন আবার অফিসে যান, তখন কর্মকর্তা তাকে ফিঙ্গার রুমে পাঠিয়ে দেন। কারণ ভুল ফাইল এখন সঠিক হয়ে গেছে অফিসিয়াল মার্কার কারণে! আর এই মার্কার নেপথ্যে থাকেন পাসপোর্ট অফিসের সহকারী পরিচালক (এডি)। তার পারমিশন নিয়ে অফিসের অন্য কর্মকর্তার নামে মার্কা ব্যবহার হয়।
প্রতিদিন কাজ শেষে এই টাকার ভাগ পান দালাল, ফটোকপির দোকানের মালিক ও পাসপোর্ট অফিসের কর্মচারীরা। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, পাসপোর্ট অফিসের ভেতরে কর্তব্যরত উপ-সহকারী পরিচালক মো: সিরাজুল ইসলাম পাটওয়ারী, সাঁটলিপিকার কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক অগ্নিভ ভুইয়া (ব্যক্তিগত সহকারী), অফিস সহায়ক, আনসার সদস্য, ডাটা এন্ট্রি কন্ট্রোল অপারেটর এদের আলাদা একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট রয়েছে। এদের মধ্যে থেকে বাইরের দালালদের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করে অফিস সহায়ক সিন্ডিকেট।
বিভিন্ন ফরমের যেকোনো ভুল হোক, দোকানদাররা আবেদনকারীর কাছ থেকে হাতিয়ে নেয় দেড় থেকে দুই হাজার টাকা। আবেদনকারীদের অভিযোগ, দালালের সহায়তা ছাড়া পাসপোর্টের আবেদন করলে নানা হয়রানির শিকার হতে হয়। আর দালাল ধরলে আবেদনগুলোতে বিশেষ চিহ্ন দেওয়া থাকে। চিহ্নধারী আবেদনকারী ফিঙ্গারপ্রিন্ট ও ছবি তোলায় অগ্রাধিকার পাওয়াসহ দ্রুত পাসপোর্ট পান। বিড়ম্বনা এড়াতে অনেকেই বাধ্য হয়ে দালালকে ধরে মার্কা কিনেন।
নগরীর কুশিঘাট এলাকার বাসিন্দা এক ভুক্তভোগী বলেন, আমি নিজে নিজে অনলাইনে আমার জন্মনিবন্ধন দিয়ে ই-পাসপোর্ট এর আবেদন করি। আবেদন করার পর জন্মনিবন্ধনের মূল কপিসহ অনলাইন ভেরিফাই কপি নিয়ে যাই। কিন্তু উপ-সহকারী পরিচালক মো: সিরাজুল ইসলাম পাটওয়ারী বলেন, আমার ইংরেজি জন্মনিবন্ধনের মূলকপি নেই, তাই হবে না। অথচ অনলাইন ভেরিফাই কপিতে ইংরেজি ছিলো। বর্তমানে আমার এলাকা সিলেট সিটি কর্পোরেশনের আওতাভুক্ত, কিন্তু জন্মনিবন্ধনটি সিটি কর্পোরেশনের আওতাভূক্ত হওয়ার পূর্বে ইউনিয়ন থেকে করা হয়েছিল, যেখানে আমাকে শুধু বাংলা মেইন কপি দেওয়া হয়েছিল ইউনিয়ন থেকে। এটি আমার প্রতি অন্যায়, কারণ সবকিছু সঠিক থাকা সত্ত্বেও আমার ফাইল রিজেক্ট করা হয়। এছাড়াও সিরাজুল ইসলাম পাটওয়ারী আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহারও করেন।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে প্রতিবেদককে সিলেট পাসপোর্ট অফিসের সহকারী পরিচালক (এডি) (তথ্য প্রদানকারী কর্মকর্তা) মোঃ সালাহ উদ্দিন কোনো সুস্পষ্ট উত্তর দিতে পারেননি।
সিলেট বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসে ঢুকলেই বোঝা যায়, এখানে যেন টাকাই আসল পাসপোর্ট! জন্মসনদ ইংরেজী কপি নেই অথবা বাংলা কপি নেই,, জন্মসনদে বয়সের অমিল বা ফরম পূরণে ছোটখাটো ভুল এসব সাধারণ বিষয় এখন হয়ে দাঁড়িয়েছে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগের কারণ। আর সেই সুযোগে ভাগ্য খুলে যায় কিছু অসাধু কর্মকর্তা ও দালালের।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক দালাল বলেন, কেউ যদি রিজেক্ট খেয়ে তার ফাইল নিয়ে আসে, তাহলেই আমাদের খেলা শুরু! অফিসের কর্মকর্তাদের সাথে চুক্তি করা মার্কা আছে আমাদের কাছে। আমরা ফাইলে তাদের মার্কা বসিয়ে আবেদনকারীর কাছ থেকে নিই দুই হাজার টাকা। তারা মার্কা দেখলে ওই ফাইল পাঠিয়ে দেন এডি স্যারের রিভিউতে এডি স্যারও অফিসিয়ার মার্কা দেখে এপ্রুভ করে দেন। সন্ধ্যার পর অফিসের পেমেন্ট দেই দেড় হাজার। আরও চমকপ্রদ তথ্য জানালেন আরেক অভিজ্ঞ দালাল, পরিচালকের নির্দেশেই পাসপোর্ট অফিসে কমপক্ষে ২০ ধরনের মার্কা ব্যবহৃত হয়। কোনটা কর্মকর্তার নামে, কোনটা স্যারের নামে, কোনটা নেতাদের নামে। সূত্রে জানা যায়, সিলেটের স্থানীয় অনলাইন, প্রিন্ট পত্রিকায় কর্মরত সাংবাদিক, জাতীয় ক্যাটাগরির কিছু টেলিভিশনের সিনিয়র সাংবাদিক, সিলেটের স্থানীয় কিছু রাজনৈতিক নেতা-কর্মীসহ বিভিন্ন নেতার নামে প্রতিদিন শতশত ফাইল এপ্রুভ হয়।
একদল দালাল ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, মূল নাটের গুরু ভেতরে বসে! তাদের কিছু হয় না। আমরা শুধু মিডিয়ার শিরোনাম হই। সিলেট পাসপোর্ট অফিস এখন আর শুধু সরকারি দপ্তর নয়; এটি সিন্ডিকেটের দুর্গে পরিণত হয়েছে, যেখানে সাধারণ মানুষের দুর্দশা আর টাকার পাহাড় পাশাপাশি বাস করছে।
ভুক্তভোগীরা বলছেন, প্রশাসন যদি সত্যিই দালাল মুক্ত পাসপোর্ট অফিস চায়, তাহলে বাইরের নয়, ভেতরের কর্মকর্তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। নইলে এই সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম থামবে না কখনোই। গত কয়েকমাস পূর্বে পাসপোর্ট অফিসের পরিচালককে বরখাস্ত করার পর যখন খুব বেশি ডিবির অভিযান চলছিলো তখন নতুন পরিচালক বলেছিলেন যে, পাসপোর্ট অফিসের নিকটবর্তী ২০ গজের মধ্যে কোন দোকানপাট বসতে দেওয়া হবে না কিন্তু সরজমিনে বর্তমানে পাসপোর্ট অফিসের গেইটের সামনেও ফটোকপির দোকান রয়েছে, ক্যাফে রয়েছে আর ক্যাফেগুলো হয়ে উঠেছে অফিস কর্মকর্তাদের আড্ডাখানা।


















