ঢাকা ০২:০৮ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১২ নভেম্বর ২০২৫
সংবাদ শিরোনাম ::
Logo আজীবন সম্মাননা পেলেন বিশ্বনন্দিত যাদুশিল্পী জুয়েল আইচ এবং কিংবদন্তী অভিনেত্রী আনোয়ারা শ্রেষ্ঠ নায়ক সজল শ্রেষ্ঠ নায়িকা পরীমণি Logo শীর্ষ সন্ত্রাসীদের যুদ্ধক্ষেত্রে রূপ নিচ্ছে ঢাকা! Logo গুজব ও শঙ্কায় সারাদেশ Logo গোলাম মাওলা সেতু দ্রুত নির্মাণের দাবি: জাতীয় প্রেসক্লাবে মানববন্ধন Logo শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জে প্রসাশনের মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত Logo ‘আগামী দশ বছরের মধ্যে দেশের নেতৃত্ব দেবে রাজপথে থাকা তরুণেরা’ Logo ময়মনসিংহে ট্রেনের ইঞ্জিনে আগুন, দুই ঘন্টা চলাচল বন্ধ Logo সুনামগঞ্জ-৪ আসনে ট্রাকের চাবি পেলেন তিমন চৌধুরী Logo ইসলামপুরে জাংক ফুড বিরোধী ক্যাম্পেইন অনুষ্ঠিত Logo গোলাপগঞ্জে অপরাধ দমনে সক্রিয় পুলিশ, এক মাসে ১৫ মামলা নিস্পত্তি

শীর্ষ সন্ত্রাসীদের যুদ্ধক্ষেত্রে রূপ নিচ্ছে ঢাকা!

বিশেষ প্রতিনিধি
  • আপডেট সময় : ৩৩ বার পড়া হয়েছে
দৈনিক গনমুক্তি অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

শীর্ষ সন্ত্রাসিদের কোনো ঘনিষ্টজন নেই। নেই তাদের কোনো পরিবার পরিজন। কেউ কারাগারে বসে, কেউ বিদেশে থেকে, আবার কেউ আত্মগোপনে থেকে রাজধানীসহ সারাদেশের অপরাধজগৎ নিয়ন্ত্রণ করছেন। তারা শীর্ষ পর্যায়ের টেন্ডার থেকে শুরু করে ব্যাপক চাঁদাবাজি, অপহরন এবং ব্যবসায়িদের জিম্মী করে অর্থ আদায়ের মতো অনৈতিক কাজ করছে। ফ্যাসিষ্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর কারাগারে আটক বেশ কিছু শীর্ষ সন্ত্রাসী জামিনে মুক্তি পাওয়ার পর দেশে খুন খারাবি এবং ছিনতাই ডাকাতি বেড়েছে।
সম্প্রতি চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজি নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্যকে ঘিরে তাঁদের সহযোগীরা প্রতিপক্ষের সঙ্গে বিরোধে জড়াচ্ছেন, ঘটাচ্ছেন খুনখারাবিও। সম্প্রতি জামিনে মুক্তি পাওয়া শীর্ষ সন্ত্রাসী তারিক সাঈদ মামুন হত্যার পর ঢাকার অপরাধজগৎ নতুন করে আলোচনায় এসেছে। সম্প্রতি জামিনে মুক্তি পাওয়া আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী সানজিদুল ইসলাম ইমনের সহযোগীরা ওই হামলা চালিয়েছেন বলে তদন্তসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, গত ১৮ সেপ্টেম্বর মামুনের ওপর হামলার এক দিন আগে আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী নাঈম আহমেদ টিটন জামিনে মুক্তি পান। দুই দশক তিনি কারাবন্দী ছিলেন। টিটন শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমনের শ্যালক। টিটনের মুক্তির চার দিন পর ২২ সেপ্টেম্বর জামিনে মুক্তি পান আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী খোরশেদ আলম রাসু। কারাগার থেকে বেরিয়ে আসার পর তাঁরা নতুন করে আরও কোনো সংঘাতে জড়িয়ে পড়েন কি না, তা নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ, জমি-বাড়ি দখল, কেব্ল টিভি ও ঝুট ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ, ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে চাঁদা আদায়কে কেন্দ্র করেই মূলত বিরোধে জড়ান শীর্ষ সন্ত্রাসীরা। তাঁরা কারাগারে বা পালিয়ে এবং বিদেশে অবস্থান করলেও তাঁদের স্থানীয় সহযোগীরা রাজধানীতে এখনো সক্রিয়। ওই সহযোগীদের নির্দেশনা দিয়ে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় অপরাধমূলক কর্মকা- করিয়ে চলেছেন তাঁরা।
ঢাকার অপরাধজগতের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে শীর্ষ সন্ত্রাসীদের মধ্যে দ্বন্দ্বের বিষয়টি গত শতকের নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে ব্যাপক আলোচনায় এসেছিল। পরে ২০০১-০২ সালে এই সন্ত্রাসীদের আধিপত্য আরও বেড়ে যায়। এ পটভূমিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ২০০১ সালের ২৬ ডিসেম্বর ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর একটি তালিকা তৈরি করে। যাঁরা ঢাকার বিভিন্ন এলাকার অপরাধজগতের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তাঁদের ওই তালিকায় রাখা হয়। এই সন্ত্রাসীদের ধরিয়ে দিতে এক লাখ টাকা করে পুরস্কারও ঘোষণা করা হয়েছিল। আর ২০০২ সালে তাঁদের ধরতে সাঁড়াশি অভিযান চালিয়েছিল সেনাবাহিনী। সে সময় পাঁচ শীর্ষ সন্ত্রাসী ধরা পড়েছিলেন। একজন গণপিটুনিতে মারা যান। আর অন্যরা ভারতে পালিয়ে যান। তাঁদের মধ্যে দুজন সেখানে ধরা পড়েছিলেন।
অনুসন্ধানে আরো জানা গেছে, তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসীদের কে কোথায় অবস্থান করছেন। ২০০১ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের করা শীর্ষ সন্ত্রাসীর তালিকায় যাঁদের নাম ছিল, তাঁরা হলেন কালা জাহাঙ্গীর, মোল্লা মাসুদ, পিচ্চি হান্নান, সুব্রত বাইন, প্রকাশ কুমার বিশ্বাস, আমিনুর রসুল সাগর ওরফে টোকাই সাগর, হারিস আহমেদ, খোরশেদ আলম রাসু, পিচ্চি হেলাল, আলাউদ্দিন, কামাল পাশা, নাঈম আহমেদ টিটন, লিয়াকত, আরমান, জাফর আহমেদ মানিক, খন্দকার তানভীরুল ইসলাম জয়, ইমাম হোসেন ওরফে ফ্রিডম ইমাম, ফ্রিডম সোহেল, মো. আব্বাস আলী ওরফে কিলার আব্বাস, ভিপি হান্নান, শামীম ওরফে আগা শামীম, মশিউর রহমান ও আবদুল জব্বার মুন্না। তাঁদের মধ্যে নাঈম আহমেদ টিটন ও খোরশেদ আলম রাসু গত মাসে জামিনে মুক্ত হন। এরপর তাঁরা কোথায় আছেন, সে তথ্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে নেই। বর্তমানে কারাগারে আছেন পিচ্চি হেলাল, ফ্রিডম সোহেল, আরমান, মশিউর রহমান ও কামাল পাশা। তাঁদের মধ্যে ২০২৪ সালের ৫ আগষ্টের গোলো যোগের সময় মো. আব্বাস আলী ওরফে কিলার আব্বাসসহ বেশকিছু সন্ত্রাসী কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কারাগার থেকে পালিয়ে যায়। সে পলাতক থেকে তার বাহিনীকে দিয়ে মিরপুর ও ভাসানটেক এলাকার অপরাধজগতের আধিপত্য ধরে রেখেছেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্র মতে, বিদেশে পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসীদের মধ্যে জাফর আহমেদ মানিক যুক্তরাষ্ট্র ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে অবস্থান করেন। সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায় তাঁর যাতায়াত আছে। তানভীরুল ইসলাম ওরফে জয় দুবাই আছেন বলে প্রচার আছে। সুব্রত বাইন, আগা শামীম, জব্বার ও ফ্রিডম ইমাম ভারতে আছেন বলে জানা গেছে। প্রকাশ বিশ্বাস ও হারিস আহমেদ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। টোকাই সাগর যুক্তরাষ্ট্রে আছেন। হান্নান ইউরোপের কোনো একটি দেশে আছেন।
এছাড়া মোল্লা মাসুদ ২০১৫ সালে ভারতে ধরা পড়েন বলে দেশটির বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছিল। পরে তিনি জামিনে মুক্ত হন । এরপরই তাকে ভারত থেকে দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে ন্যস্ত করা হয়। তিনি বর্তমানে কারাগাওে আটক আছেন।
অপর শীর্ষ সন্ত্রাসী মগবাজারের লিয়াকত হোসেন ২০০২ সালে সেনাবাহিনীর সাঁড়াশি অভিযান শুরুর পর কলকাতা পালিয়ে যান। পরে সেখানে তিনি গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। মুক্তির পর দেশে ফিরেছিলেন লিয়াকত। ২০০৮ সালে লিয়াকতকে ধানমন্ডিতে তাঁর শ্বশুরের বাসা থেকে সাদা পোশাকের একদল লোক ধরে নিয়ে যায়। এরপর থেকে অদ্যাবধি তাঁর আর কোনো খোঁজ মিলেনি। শীর্ষ সন্ত্রাসীদের তালিকায় থাকা কালা জাহাঙ্গীর ব্যাপক আলোচিত ছিলেন। মহাখালীর সাততলা বস্তিতে ছিল তাঁর আস্তানা। সে সময় তাঁর ‘গডফাদার’ হিসেবে আলোচনায় এসেছিলেন তেজগাঁও অঞ্চলের তৎকালীন বিএনপি নেতা লুৎফর রহমান ওরফে এল রহমান।
তবে কালা জাহাঙ্গীর ও তাঁর সহযোগীরা ‘ভাড়াটে খুনি’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ২০০৩ সালের পর কালা জাহাঙ্গীর হঠাৎ ‘উধাও’ হয়ে যান। ২০০৫ সালে বিভিন্ন মাধ্যম থেকে জানা যায়, গুলিতে কালা জাহাঙ্গীরের মৃত্যু হওয়ার দাবি করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও তাঁর পরিবার। তবে এ মৃত্যু নিয়ে এখনো রহস্য কাটেনি। এমনও দাবি করা হয়েছিল, ২০০৩ সালের ডিসেম্বরে কালা জাহাঙ্গীর নিজেই মাথায় গুলি চালিয়ে আত্মহত্যা করেন।
এদিকে ২০০২ সালে তেজগাঁয়ে ডিউটিরত অবস্থায় সন্ত্রাসিদের হাতে দীনেশ দাস নামে এক পুলিশ অফিসার মারা ঘটনার রামপুরায় গণপিটুনিতে মারা যান শীর্ষ সন্ত্রাসী আলাউদ্দিন। পরে ২০০৪ সালের ২৬ জুন র‌্যাবের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন পিচ্চি হান্নান ও সাহাবুদ্দিন নামে দুজন। পিচ্ছি হান্নান ছিলেন রাজধানীর কারওয়ান বাজার ও আশপাশের এলাকার অপরাধজগতের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রক। পিচ্চি হান্নানের মৃত্যুর চার মাস পর নভেম্বরে ঢাকায় র‌্যাবের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে প্রাণ হারান নারায়ণগঞ্জের সন্ত্রাসী মমিন উল্লাহ ডেভিড। এ ঘটনাও তখন ব্যাপক আলো চনার জন্ম দিয়েছিল।
এদিকে অপরাধীদের বিদেশ থেকে ফিরিয়ে আনা ও ইন্টারপোলের সঙ্গে তথ্য বিনিময় করে বাংলাদেশ পুলিশের ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরো (এনসিবি)। শীর্ষ সন্ত্রাসীদের ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে জানতে চাইলে এনসিবির সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক বলেন, কারাগার ও দেশের বাইরে থেকে যে সন্ত্রাসীরা অপরাধজগৎ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছেন, তাঁদের বিষয়ে নজরদারি করা হয়। কারাগার থেকে নির্দেশ দেওয়ার তথ্য পেলে কারা কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানানো হয়। পাশাপাশি সন্ত্রাসী দলের কোনো সদস্যের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করে আইনের আওতায় আনা হয়। এবিষয়ে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ও সংসদ সদস্য বলেন, আন্ডারওয়ার্ল্ডের (অপরাধজগৎ) প্রভাব যে একেবারেই নেই, তা তো নয়। যাঁরা তাঁদের নিয়ন্ত্রণ করেন, তাঁরা তো রয়েই গেছেন। এ কারণে সেটার প্রভাবও রয়েছে।

নিউজটি শেয়ার করুন

ট্যাগস :

শীর্ষ সন্ত্রাসীদের যুদ্ধক্ষেত্রে রূপ নিচ্ছে ঢাকা!

আপডেট সময় :

শীর্ষ সন্ত্রাসিদের কোনো ঘনিষ্টজন নেই। নেই তাদের কোনো পরিবার পরিজন। কেউ কারাগারে বসে, কেউ বিদেশে থেকে, আবার কেউ আত্মগোপনে থেকে রাজধানীসহ সারাদেশের অপরাধজগৎ নিয়ন্ত্রণ করছেন। তারা শীর্ষ পর্যায়ের টেন্ডার থেকে শুরু করে ব্যাপক চাঁদাবাজি, অপহরন এবং ব্যবসায়িদের জিম্মী করে অর্থ আদায়ের মতো অনৈতিক কাজ করছে। ফ্যাসিষ্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর কারাগারে আটক বেশ কিছু শীর্ষ সন্ত্রাসী জামিনে মুক্তি পাওয়ার পর দেশে খুন খারাবি এবং ছিনতাই ডাকাতি বেড়েছে।
সম্প্রতি চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজি নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্যকে ঘিরে তাঁদের সহযোগীরা প্রতিপক্ষের সঙ্গে বিরোধে জড়াচ্ছেন, ঘটাচ্ছেন খুনখারাবিও। সম্প্রতি জামিনে মুক্তি পাওয়া শীর্ষ সন্ত্রাসী তারিক সাঈদ মামুন হত্যার পর ঢাকার অপরাধজগৎ নতুন করে আলোচনায় এসেছে। সম্প্রতি জামিনে মুক্তি পাওয়া আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী সানজিদুল ইসলাম ইমনের সহযোগীরা ওই হামলা চালিয়েছেন বলে তদন্তসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, গত ১৮ সেপ্টেম্বর মামুনের ওপর হামলার এক দিন আগে আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী নাঈম আহমেদ টিটন জামিনে মুক্তি পান। দুই দশক তিনি কারাবন্দী ছিলেন। টিটন শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমনের শ্যালক। টিটনের মুক্তির চার দিন পর ২২ সেপ্টেম্বর জামিনে মুক্তি পান আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী খোরশেদ আলম রাসু। কারাগার থেকে বেরিয়ে আসার পর তাঁরা নতুন করে আরও কোনো সংঘাতে জড়িয়ে পড়েন কি না, তা নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ, জমি-বাড়ি দখল, কেব্ল টিভি ও ঝুট ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ, ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে চাঁদা আদায়কে কেন্দ্র করেই মূলত বিরোধে জড়ান শীর্ষ সন্ত্রাসীরা। তাঁরা কারাগারে বা পালিয়ে এবং বিদেশে অবস্থান করলেও তাঁদের স্থানীয় সহযোগীরা রাজধানীতে এখনো সক্রিয়। ওই সহযোগীদের নির্দেশনা দিয়ে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় অপরাধমূলক কর্মকা- করিয়ে চলেছেন তাঁরা।
ঢাকার অপরাধজগতের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে শীর্ষ সন্ত্রাসীদের মধ্যে দ্বন্দ্বের বিষয়টি গত শতকের নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে ব্যাপক আলোচনায় এসেছিল। পরে ২০০১-০২ সালে এই সন্ত্রাসীদের আধিপত্য আরও বেড়ে যায়। এ পটভূমিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ২০০১ সালের ২৬ ডিসেম্বর ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর একটি তালিকা তৈরি করে। যাঁরা ঢাকার বিভিন্ন এলাকার অপরাধজগতের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তাঁদের ওই তালিকায় রাখা হয়। এই সন্ত্রাসীদের ধরিয়ে দিতে এক লাখ টাকা করে পুরস্কারও ঘোষণা করা হয়েছিল। আর ২০০২ সালে তাঁদের ধরতে সাঁড়াশি অভিযান চালিয়েছিল সেনাবাহিনী। সে সময় পাঁচ শীর্ষ সন্ত্রাসী ধরা পড়েছিলেন। একজন গণপিটুনিতে মারা যান। আর অন্যরা ভারতে পালিয়ে যান। তাঁদের মধ্যে দুজন সেখানে ধরা পড়েছিলেন।
অনুসন্ধানে আরো জানা গেছে, তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসীদের কে কোথায় অবস্থান করছেন। ২০০১ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের করা শীর্ষ সন্ত্রাসীর তালিকায় যাঁদের নাম ছিল, তাঁরা হলেন কালা জাহাঙ্গীর, মোল্লা মাসুদ, পিচ্চি হান্নান, সুব্রত বাইন, প্রকাশ কুমার বিশ্বাস, আমিনুর রসুল সাগর ওরফে টোকাই সাগর, হারিস আহমেদ, খোরশেদ আলম রাসু, পিচ্চি হেলাল, আলাউদ্দিন, কামাল পাশা, নাঈম আহমেদ টিটন, লিয়াকত, আরমান, জাফর আহমেদ মানিক, খন্দকার তানভীরুল ইসলাম জয়, ইমাম হোসেন ওরফে ফ্রিডম ইমাম, ফ্রিডম সোহেল, মো. আব্বাস আলী ওরফে কিলার আব্বাস, ভিপি হান্নান, শামীম ওরফে আগা শামীম, মশিউর রহমান ও আবদুল জব্বার মুন্না। তাঁদের মধ্যে নাঈম আহমেদ টিটন ও খোরশেদ আলম রাসু গত মাসে জামিনে মুক্ত হন। এরপর তাঁরা কোথায় আছেন, সে তথ্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে নেই। বর্তমানে কারাগারে আছেন পিচ্চি হেলাল, ফ্রিডম সোহেল, আরমান, মশিউর রহমান ও কামাল পাশা। তাঁদের মধ্যে ২০২৪ সালের ৫ আগষ্টের গোলো যোগের সময় মো. আব্বাস আলী ওরফে কিলার আব্বাসসহ বেশকিছু সন্ত্রাসী কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কারাগার থেকে পালিয়ে যায়। সে পলাতক থেকে তার বাহিনীকে দিয়ে মিরপুর ও ভাসানটেক এলাকার অপরাধজগতের আধিপত্য ধরে রেখেছেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্র মতে, বিদেশে পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসীদের মধ্যে জাফর আহমেদ মানিক যুক্তরাষ্ট্র ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে অবস্থান করেন। সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায় তাঁর যাতায়াত আছে। তানভীরুল ইসলাম ওরফে জয় দুবাই আছেন বলে প্রচার আছে। সুব্রত বাইন, আগা শামীম, জব্বার ও ফ্রিডম ইমাম ভারতে আছেন বলে জানা গেছে। প্রকাশ বিশ্বাস ও হারিস আহমেদ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। টোকাই সাগর যুক্তরাষ্ট্রে আছেন। হান্নান ইউরোপের কোনো একটি দেশে আছেন।
এছাড়া মোল্লা মাসুদ ২০১৫ সালে ভারতে ধরা পড়েন বলে দেশটির বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছিল। পরে তিনি জামিনে মুক্ত হন । এরপরই তাকে ভারত থেকে দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে ন্যস্ত করা হয়। তিনি বর্তমানে কারাগাওে আটক আছেন।
অপর শীর্ষ সন্ত্রাসী মগবাজারের লিয়াকত হোসেন ২০০২ সালে সেনাবাহিনীর সাঁড়াশি অভিযান শুরুর পর কলকাতা পালিয়ে যান। পরে সেখানে তিনি গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। মুক্তির পর দেশে ফিরেছিলেন লিয়াকত। ২০০৮ সালে লিয়াকতকে ধানমন্ডিতে তাঁর শ্বশুরের বাসা থেকে সাদা পোশাকের একদল লোক ধরে নিয়ে যায়। এরপর থেকে অদ্যাবধি তাঁর আর কোনো খোঁজ মিলেনি। শীর্ষ সন্ত্রাসীদের তালিকায় থাকা কালা জাহাঙ্গীর ব্যাপক আলোচিত ছিলেন। মহাখালীর সাততলা বস্তিতে ছিল তাঁর আস্তানা। সে সময় তাঁর ‘গডফাদার’ হিসেবে আলোচনায় এসেছিলেন তেজগাঁও অঞ্চলের তৎকালীন বিএনপি নেতা লুৎফর রহমান ওরফে এল রহমান।
তবে কালা জাহাঙ্গীর ও তাঁর সহযোগীরা ‘ভাড়াটে খুনি’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ২০০৩ সালের পর কালা জাহাঙ্গীর হঠাৎ ‘উধাও’ হয়ে যান। ২০০৫ সালে বিভিন্ন মাধ্যম থেকে জানা যায়, গুলিতে কালা জাহাঙ্গীরের মৃত্যু হওয়ার দাবি করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও তাঁর পরিবার। তবে এ মৃত্যু নিয়ে এখনো রহস্য কাটেনি। এমনও দাবি করা হয়েছিল, ২০০৩ সালের ডিসেম্বরে কালা জাহাঙ্গীর নিজেই মাথায় গুলি চালিয়ে আত্মহত্যা করেন।
এদিকে ২০০২ সালে তেজগাঁয়ে ডিউটিরত অবস্থায় সন্ত্রাসিদের হাতে দীনেশ দাস নামে এক পুলিশ অফিসার মারা ঘটনার রামপুরায় গণপিটুনিতে মারা যান শীর্ষ সন্ত্রাসী আলাউদ্দিন। পরে ২০০৪ সালের ২৬ জুন র‌্যাবের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন পিচ্চি হান্নান ও সাহাবুদ্দিন নামে দুজন। পিচ্ছি হান্নান ছিলেন রাজধানীর কারওয়ান বাজার ও আশপাশের এলাকার অপরাধজগতের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রক। পিচ্চি হান্নানের মৃত্যুর চার মাস পর নভেম্বরে ঢাকায় র‌্যাবের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে প্রাণ হারান নারায়ণগঞ্জের সন্ত্রাসী মমিন উল্লাহ ডেভিড। এ ঘটনাও তখন ব্যাপক আলো চনার জন্ম দিয়েছিল।
এদিকে অপরাধীদের বিদেশ থেকে ফিরিয়ে আনা ও ইন্টারপোলের সঙ্গে তথ্য বিনিময় করে বাংলাদেশ পুলিশের ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরো (এনসিবি)। শীর্ষ সন্ত্রাসীদের ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে জানতে চাইলে এনসিবির সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক বলেন, কারাগার ও দেশের বাইরে থেকে যে সন্ত্রাসীরা অপরাধজগৎ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছেন, তাঁদের বিষয়ে নজরদারি করা হয়। কারাগার থেকে নির্দেশ দেওয়ার তথ্য পেলে কারা কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানানো হয়। পাশাপাশি সন্ত্রাসী দলের কোনো সদস্যের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করে আইনের আওতায় আনা হয়। এবিষয়ে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ও সংসদ সদস্য বলেন, আন্ডারওয়ার্ল্ডের (অপরাধজগৎ) প্রভাব যে একেবারেই নেই, তা তো নয়। যাঁরা তাঁদের নিয়ন্ত্রণ করেন, তাঁরা তো রয়েই গেছেন। এ কারণে সেটার প্রভাবও রয়েছে।