জীবন্ত হচ্ছে ভোটের মাঠ
- আপডেট সময় : ৪৫ বার পড়া হয়েছে
দীর্ঘদিনের একতরফা নির্বাচন, ভোটাধিকার হরন, পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে না পারা, মৃত ব্যক্তির নামেও ভোট দেয়ার অভিযোগ, এমন সব নানা তিক্ত অভিজ্ঞতায় ক্ষতবিক্ষত দেশের ভোটাররা। অবশেষে ভোটারা ফিরে পাচ্ছে সেই চিরচেনা ভোটের পরিবেশ। ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর উদ্ভূত নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতায় ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে আবারও জীবন্ত হয়ে উঠেছে ভোটের মাঠ। বহু বছর পর প্রথমবারের মতো বহুদলীয় প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচনের প্রস্তুতি চলছে, যেখানে আওয়ামী লীগ অংশ নিতে পারছে না। বিএনপি, জামায়াত, নতুন দল এনসিপি ও নিবন্ধিত সব রাজনৈতিক দলই নির্বাচনমুখী, নেমে পড়েছে প্রচারণায়।
রাজধানী থেকে গ্রাম, সবখানেই প্রার্থীদের দরজায় দরজায় গিয়ে ভোট চাওয়ার দৃশ্য, পথসভা, উঠান বৈঠক আর কর্মী–সমর্থকদের ব্যস্ততা ফিরিয়ে এনেছে পুরোনো দিনের রাজনৈতিক আমেজ। ভোটারদের মধ্যেও দেখা যাচ্ছে স্বস্তি ও প্রত্যাশা। অনেকেই বলছেন, কত বছর ভোট দিইনি এবার অন্তত ভোট দিতে পারব। এদিকে কেন্দ্রীয় পর্যায়ের দলীয় নেতারাও সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছেন। বিএনপি বলছে, বাংলাদেশ আবার ভোটের দেশে ফিরছে। জামায়াত ও এনসিপি জানাচ্ছে তারা শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে প্রস্তুত এবং জনগণের রায়েই নেতৃত্ব নির্ধারণ হবে।
ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে বহুদলীয় অংশগ্রহণে। আওয়ামী লীগ এবার নির্বাচনে অংশ নিতে পারছে না। দলটি না থাকলেও বিএনপি, জামায়াত, এনসিপি ও নিবন্ধিত সব রাজনৈতিক দলই প্রার্থী ঘোষণা করেছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এর ফলে বহু বছর পর একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ, বহুমাত্রিক এবং ভোটকেন্দ্রিক রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে।
ভোটারদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত এক দশকেরও বেশি সময় তারা ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেননি বলে অভিযোগ করেন। তাদের দাবি, বিগত আওয়ামী লীগ আমলে অনুষ্ঠিত বেশ কয়েকটি জাতীয় নির্বাচন ছিল নিয়ন্ত্রিত, একতরফা, ডামি নির্বাচন এবং জনগণের ভোট ছাড়া সরকার গঠনের নমুনা।
রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর বাসিন্দা মো: মানিক মিয়া বলেন, আমরা নিজেরা ভোট দিতে পারিনি। অনেক কেন্দ্রে ভোটার ছাড়া ব্যালট ভরে গেছে, এমন কথা শুধু শুনেনি নিজ চোখে দেখেছি। আঙুলে দাগ না নিয়েই ভোট হয়ে গেছে এমন অভিযোগও দেখেছি। একই এলাকার রিকশাচালক মাহাবাত হোসেন জানান, একজনের ভোট আরেকজন দিছে, মৃত মানুষের ভোট পর্যন্ত হয়ে গেছে এমন ঘটনা মিডিয়াতেও দেখেছি। ভোটার হিসেবে অপমান বোধ করতাম। আশা করি এবছর আমরা ভোটারটা ভোট দিতে পারবো।
ভোট দিতে না পারার বঞ্চনা, পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার সুযোগ না পাওয়া এবং ভোটারদের গুরুত্বহীন করে তোলার ক্ষোভ দীর্ঘদিন ধরে জমছিল জনমনে। বিশেষ করে তারা অভিযোগ করেন, তখনকার নির্বাচনব্যবস্থা এমন ছিল, যেখানে ভোটারদের অংশগ্রহণ ছিল কাগজে-কলমে, বাস্তবে নয়। তবে ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে বড় ধরনের পরিবর্তন আসে। ক্ষমতার কেন্দ্রে পরিবর্তন, রাজনৈতিক কাঠামোর সংস্কার এবং নির্বাচনী ব্যবস্থার পুনর্গঠনের পর এবার ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নতুন রাজনৈতিক সমীকরণ তৈরি হয়েছে।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, আওয়ামী লীগ ছাড়া নির্বাচন হওয়ায় ভোটের মাঠে প্রভাব বিস্তারের লড়াই এখন মূলত তিন শক্তির মধ্যে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি। বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, বিএনপির সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠতে পারে জামায়াত ও এনসিপি। অনেক আসনে ত্রিমুখী লড়াই দেখা যেতে পারে বলেও জানিয়েছেন তারা।
মাঠ পর্যায়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিএনপি, জামায়াত, এনসিপি ও অন্যান্য দলের প্রার্থীরা ইতোমধ্যে ভোটারদের ধারে ধারে গিয়ে ভোট চাইছেন। কেউ করছেন উঠান বৈঠক, কেউ করছেন পথসভা, আবার কেউ প্রকাশ্যে কিংবা ব্যক্তিগতভাবে ভোটারদের সঙ্গে আলোচনা করছেন। ঢাকার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, নির্বাচনী প্রচারণায় ব্যস্ত বিএনপি প্রার্থী সমর্থকদের নিয়ে এলাকায় মিছিল করছেন। অন্যদিকে একই ওয়ার্ডে জামায়াত ও এনসিপির প্রচার টিমও আলাদা আলাদাভাবে ভোট চাইছে।
শরীয়তপুর জেলায় তিনটি আসন। দেখা যায় এই তিন আসনে বিএনপি ও জামায়াতের কর্মী-সমর্থকরা ভোটারদের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে পরিচিতি সভা করছেন। এক ভোটার হাসিমুখে বললেন, এতো বছর পরে এতগুলো দল আবার ভোট চাইতে আসছে, ভোটার হিসেবে এটা সত্যিই আনন্দের।
দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে পাওয়া তথ্যে উঠে আসে একই চিত্র। বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিসহ নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলো ভোটের মাঠে বেশ সক্রিয়। সবাই যে যার মত করে প্রতিশ্রুতি দিয়ে যাচ্ছেন। ভোটাররা ও তাদের চাহিদার কথা বলছেন। সব মিলে দীর্ঘদিন পর ভোটার ও প্রার্থীদের মাঝে এক প্রকাশ আনন্দ বিরাজ করছে।
বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা বলছেন, বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে ভোটাধিকারহীন ছিল। জনগণের ভোটেই রাষ্ট্র পরিচালিত হওয়া উচিত। এবার আমরা মনে করছি, একটি প্রকৃত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তারা কলেন, ক্ষমতার উৎস হতে হবে জনগণ এই বিশ্বাসে আমরা মাঠে নেমেছি। আমরা ক্ষমতায় গেলে নিজেদের জন্য জনগণের জন্য কাজ করবো।
জামায়াতের এক কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, আমরা সবসময় শান্তি ও গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। যে পরিবেশ তৈরি হয়েছে, তাতে জনগণ এবার মুক্তভাবে ভোট দেওয়ার সুযোগ পাবে। এই নির্বাচনে আমরা শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা করব।
এনসিপির নেতারা বলছেন, তরুণদের বড় অংশ এবার ভোটের মাঠে সক্রিয়। আমরা বিশ্বাস করি একটি নতুন রাজনীতি, একটি নতুন নেতৃত্বের ধারণা জনগণের সামনে তুলে ধরতে পারব। মাঠে আমরা দ্রুত জনপ্রিয়তা অর্জন করছি। ভোটারদের কাছে পুনরুদ্ধার হওয়া গণতন্ত্রের অনুভূতি ভোটারদের মধ্যে এবার ভিন্ন রকম উচ্ছ্বাস লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
বরিশালের সালমা বেগম বলেন, অনেক বছর ভোটকেন্দ্রে যাওয়ারই সুযোগ পাইনি। এবার যখন সবাই ভোট দিতে পারব বলছে মনটা ভালো হয়ে গেছে। কুমিল্লার কলেজছাত্রী নুসরাত বলেন, আমার জীবনের প্রথম ভোট। আগের পরিবেশ দেখে মনে হতো হয়তো ভোট দেওয়ার সুযোগ মিলবে না। এবার আশাবাদী। রাজশাহীর কৃষক আব্দুল জলিল বলেন, নির্বাচনের কথা শুনলেই আগে রাগ উঠত। এখন দেখছি আবার দলগুলো ভোট চাইতে আসছে, জনসভা করছে। মনে হচ্ছে আবার মানুষ বিচার করে ভোট দেবে।
রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, আগের তুলনায় এবার নির্বাচনী প্রচারণায় তিনটি বৈশিষ্ট্য সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ছে, সব দলের কর্মীরা সমানভাবে মাঠে সক্রিয়, ভোটারদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ বাড়ছে, তরুণ ভোটারদের অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য। প্রায় প্রতিটি জেলাতেই দেখা যাচ্ছে প্রার্থীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও প্রচারণা চালাচ্ছেন। কেউ লাইভে কথা বলছেন, কেউ ভিডিও বার্তা দিচ্ছেন। আবার অনেক প্রার্থী পুরনো রাজনৈতিক রীতিতে উঠান বৈঠক, এলাকার সমস্যার সমাধানের প্রতিশ্রুতি, ভোটারদের ব্যক্তিগত খোঁজ নেওয়ার মতো কার্যক্রম বাড়িয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই নির্বাচনের সফলতা নির্ভর করবে তিনটি বিষয়ের ওপর। নির্বাচনী মাঠের শান্ত-শৃঙ্খলা, প্রশাসনের নিরপেক্ষ ভূমিকা, ভোটারদের নিরাপত্তা নিশ্চয়তা। তাদের মতে, যদি এসব বজায় থাকে তবে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি বড় পরিবর্তনের সূচনা হতে পারে।
























