ডেস্ক রিপোর্ট : ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকার আল-শিফা হাসপাতালে গত বুধবার হামলা চালায় দখলদার ইসরায়েলি বাহিনী। গাজার বৃহৎ এ হাসপাতালে হামলা চালানোর আগে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) একটি গ্রাফিকস ভিডিও প্রকাশ করে। সেখানে তারা দেখায়, আল-শিফার নিচে সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের বিস্তৃত সুড়ঙ্গ ও কমান্ড সেন্টার রয়েছে। যেখান থেকে ইসরায়েলের ওপর হামলার পরিকল্পনা করা হয়। যে কমান্ড সেন্টার খুঁজে বের করার অজুহাতে ইসরায়েলি বাহিনী আল-শিফায় হামলা চালিয়েছিল সেটির কোনো শক্তিশালী প্রমাণ তারা এখন পর্যন্ত দেখাতে পারেনি। অপরদিকে অবরুদ্ধ গাজার সবচেয়ে বড় হাসপাতাল আল-শিফার নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের (আইসিইউ) সব রোগীর মৃত্যু হয়েছে।
আইডিএফ হাসপাতাল থেকে (কথিত) উদ্ধার করা কিছু অস্ত্র দেখিয়েছে যেগুলোর বেশিরভাগই হলো অ্যাসাল্ট রাইফেল। এই অস্ত্র উদ্ধারের বিষয়টি হয়ত ইঙ্গিত করছে, সেখানে সশস্ত্র যোদ্ধারা হয়ত ছিলেন। কিন্তু এরমাধ্যমে এটি প্রমাণিত হয়নি, হাসপাতালের নিচে হামাসের বিশাল কমান্ড সেন্টার ছিল। এমনকি অস্ত্র উদ্ধারের যে ভিডিও ইসরায়েল প্রকাশ করেছে সেটি চুলচেরা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে এটি সাজানো নাটক ছিল। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির বিশ্লেষক জানিয়েছেন, আল-শিফা হাসপাতালের এমআরআই মেশিনের পেছন থেকে উদ্ধারকৃত অস্ত্রের যে ব্যাগটি ইসরায়েলি বাহিনী এক সাংবাদিককে দেখিয়েছে, সেই ব্যাগটি সাংবাদিক আসার কয়েক ঘণ্টা আগে স্কচট্যাপ দিয়ে প্যাচানো হয়েছিল।
এরপর পরবর্তী যে ভিডিও ইসরায়েলিরা প্রকাশ করেছে, সেখানে দেখা গেছে ব্যাগে যে পরিমাণ অস্ত্র ছিল তার চেয়ে বেশি অস্ত্র সাজিয়ে রাখা হয়েছে। এছাড়া ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী দাবি করেছে, আল-শিফার ভেতর থেকে তারা যে ভিডিও প্রকাশ করেছে সেটি এডিট করা হয়নি। এটি একবারে ধারণ করা হয়েছে। তবে বিবিসির বিশ্লেষণে ওঠে এসেছে, ভিডিওটি এডিট করা হয়েছে। অপর ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান জানিয়েছে, হামলার আগে ইসরায়েল যে গ্রাফিকস ভিডিওটি প্রকাশ করেছিল, সেটিতে দেখানো হয়েছিল হাসপাতালের অনেক নিচে হামাসের কমান্ড সেন্টার অবস্থিত। হয়ত তারা সেখানে এখনো পৌঁছাতে পারেনি। তবে এখন পর্যন্ত ইসরায়েল যেসব প্রমাণ দেখানোর চো করেছে— পরবর্তীতে তারা যেসব প্রমাণই দেখাক না কেন সেগুলো নিয়ে মানুষের মধ্যে তীব্র সন্দেহ থাকবে। হাসপাতালে হামলা এবং একটি ভেতর হামাসের সামরিক অবকাঠামো না পাওয়ার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ যদি ইসরায়েলিরা কোনো কিছু না পায় তাহলে তারা জেনেভা কনভেনশনের চুক্তি ভঙ্গ করেছে। জেনেভে কনভেনশন চুক্তিতে স্পভাবে উল্লেখ আছে, হাসপাতাল যদি বড় কোনো সামরিক হুমকি না হয় তাহলে এটিতে হামলা চালানো যাবে না। উল্টো হাসপাতাল রক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকতে হবে।
হাসপাতালে হামলার কারণে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে এখন আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত করার তদন্ত হবে। যদিও এসব তদন্ত এবং এটির রায় প্রকাশের বিষয়টি অনেক সময়সাপেক্ষ। কিন্তু ইসরায়েল এতে ফেঁসে যাবে। আল-শিফা হাসপাতালের ভেতর রোগী থাকা সত্ত্বেও সেটির ভেতর হামলা চালিয়েছে দখলদার ইসরায়েলি সেনারা।
গাজায় বিশ্বের অনেক দেশ যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানাচ্ছে। কিন্তু যুক্তরাজ্য, জার্মানি, যুক্তর্রা সরাসরি যুদ্ধবিরতির বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। তারা মূলত ইসরায়েলের কথিত আত্মরক্ষার অজুহাতে এখন যুদ্ধবিরতিতে রাজি হচ্ছে না। কিন্তু সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে এ অবস্থান পরিবর্তন করতে বাধ্য হবে তারা।
হাসপাতালে কমান্ড সেন্টার থাকার যে দাবি ইসরায়েল করেছে— সেটিতে যুক্তর্রা শুধু সমর্থনই দেয়নি। তারা তাদের নিজস্ব গোয়েন্দা তথ্যের বরাতেও দাবি করেছে, আল-শিফার নিচে হামাসের সামরিক অবকাঠামো আছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত শক্তিশালী প্রমাণ না পাওয়ার বিষয়টি— যুক্তরা্েরর অতীত গোয়েন্দা ব্যর্থতার বিষয়টিই আবারও সামনে এনেছে। ইরাকে হামলা চালানোর আগে মার্কিন গোয়েন্দারা বলেছিলেন, দেশটিতে গণবিধ্বংসী অস্ত্র আছে। কিন্তু পরবর্তীতে এর কিছুই পাওয়া যায়নি। আর এই ভুয়া গোয়েন্দা তথ্যের বিষয়টি যুক্তর্রাকে বিশ্ব থেকে আরও আলাদা করে দেবে। এছাড়া দেশটির প্রশাসনের ভেতর যে অন্তদ্বন্দ্ব আছে সেটিও বৃদ্ধি করবে এটি।
আইসিইউতে থাকা সব রোগী মারা গেছে : ইসরায়েলি বাহিনী পুরোপুরি অবরুদ্ধ করার পর গাজার সবচেয়ে বড় হাসপাতাল আল-শিফার নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের (আইসিইউ) সব রোগীর মৃত্যু হয়েছে। শুক্রবার (১৭ নভেম্বর) হাসপাতালটির পরিচালক মুহাম্মদ আবু সালমিয়া কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরাকে এ তথ্য জানিয়েছেন। এর আগে বুধবার যুক্তরা্েরর এবিসি নিউজ জানিয়েছিল, হাসপাতালটির আইসিইউতে থাকা ৬৩ রোগীর ৪৩ জনেরই মৃত্যু হয়েছে।
আবু সালমিয়া বলেন, রোগী, চিকিৎসাকর্মী এবং আশ্রয় নেওয়া মিলিয়ে ৭ হাজার লোক হাসপাতালে আটকা পড়েছে। চিকিৎসকরা এখনো রোগীর সেবায় সর্বোচ্চ চেস্টা করে যাচ্ছেন। ইসরায়েলি বাহিনী কাউকে ঢুকতে বা বের হতে না দেওয়ায় হাসপাতালটি বড় কারাগার ও গণকবর হয়ে উঠেছে। তিনি আরও বলেন, তিনদিন ধরে হাসপাতালটি অবরোধে রাখা হয়েছে। এখন আমাদের কাছে কিছুই নেই। জ্বালানি, বিদ্যুৎ, খাবার, পানি কিছুই নেই। প্রতি মুহূর্তে মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। পরিস্থিতি খুবই বেদনাদায়ক উল্লেখ করে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, আল-শিফা হাসপাতালকে ইসরায়েলি বাহিনী তাদের ঘাঁটি বানিয়েছে। হাসপাতালের প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের প্রধান ডা. আহমেদ মোখল্লালতি জানান, বাধ্য হয়ে তারা হাসপাতাল চত্বরেই মরদেহ দাফন করছেন। এদিকে গাজার দক্ষিণেও হামলা চালানোর ইঙ্গিত দিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী। শুক্রবার ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) মুখপাত্র ড্যানিয়েল হ্যাগারি এ বিষয়ে কথা বলেছেন। তিনি বলেন, আমরা আমাদের অভিযান সম্পসারণে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। হামাস যেখানে আছে সেখানেই আমাদের অভিযান চলবে। এমনকি, গাজার দক্ষিণেও যাবো আমরা।
এ জাতীয় আরো খবর..