×
  • প্রকাশিত : ২০২২-০৪-১৩
  • ১০৯০ বার পঠিত
মহিউদ্দিন তুষার: প্রকাশ্যে ৩ ফসলি জমি প্রায় ২ বছর ধরে মাটি কাটার কর্মযজ্ঞ চালাচ্ছে একটি প্রভাবশালী মহল। যার ফলে কৃষি জমি পরিনত হচ্ছে পুকুর-ডোবায়। এতে প্রতিবছরই বাড়ছে নদী ভাঙ্গার ঝুঁকিসহ দিন দিন ফসলের উৎপাদন কমছে। বেকার হচ্ছে কৃষক, পরিবেশ হচ্ছে দূষিত। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এবং প্রশাসনকে মেনেজ করে এ কর্মকাণ্ড চলছে শরীয়তপুর জেলার ভেদরগঞ্জ উপজেলার কাঁচিকাটা ইউনিয়নে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। এ বিষয়ে ভুক্তভোগীরা স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এবং প্রশাসনকে একাধিকবার মাটি কাটা বন্ধের জন্য অভিযোগ করে কোন ফলাফল পায়নি। 

সরেজমিনে দেখা যায়, ইউনিয়নের মান্দার তলি মৌজা ও কাঁচিকাটা মৌজায় ৮ থেকে ১০টি ভেকু মেশিন দিয়ে দেদারছে মাটি কাটা হচ্ছে। ১৫-২০টি মাহিন্দ্রা ট্রাক্টরের মাধ্যমে অন্যান্য ফসলী জমি নষ্ট করে নদীর পারে মাটি আনা হয়। পরবর্তীতে শিপের মাধ্যমে ফতুল্লা বড় বাজার ও বরিশালের বিভিন্ন ইট ভাটায় এই মাটি বিক্রি করছে তারা। জানা যায়, কৃষক ও সিন্ডিকেট থেকে ৬০ পয়সা ফুটে ক্রয় করে ইট ভাটায় বিক্রি করছে ২০-২২ টাকা ফুট। 

কাঁচিকাটা ইউনিয়ন ভেদরগঞ্জ উপজেলার নদীবেষ্টিত একটি ইউনিয়ন। এই ইউনিয়নটি প্রায় ৪০ বছর  আগে চর জাগে। সেই সময় থেকে মানুষ বসবাস করতে শুরু করে। বর্তমানে এখানে স্থানীয়ভাবে বসবাস করছে প্রায় ২-৩ হাজার পরিবার। ৪০ বছরের পুরোনো এই চরে তৈরি হয়েছে স্কুল-কলেজ এবং মাদ্রসা। এমনকি সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে সংযোগ দেয়া হয়েছে বিদ্যুৎ। ইউনিয়নের চার পাশে ঘিরে রয়েছে নদী। জেলার মূল ভ’খন্ড থেকে বিস্তীর্ণ এই এলাকা প্রকৃতিকভাবে প্রতিবছরই নদীভাঙ্গনের শিকার হয়। ভাঙ্গনের ফলে ফসলি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়, ঘরবাড়ি, ফসলের জমি হারিয়ে নিঃস্ব অসংখ্য মানুষ। নদীর পাড় থেকে ফসলী জমি কাটার ফলে বর্ষার সময় নদী ভাঙ্গা বেড়ে যায় আগের তুলনায় কয়েকগুণ।
  
এলাকাবাসি জানান, আমরা ভাঙ্গন কবলীত এলাকার মানুষ। প্রতিবছরই এখানে কমবেশি নদী ভাঙ্গে। মাটি কাটার কারনে এই ভাঙ্গন অনেক বেড়ে গেছে। দুই বছর  আগেও কাঁচিকাটা বাজার থেকে নদীর দূরত্ব ছিলো ৩ থেকে ৪ কিলোমিটার যা বর্তমানে মাত্র ১ থেকে ২ কিলোমিটার দূরে রয়েছে। নাম না প্রকাশ করার শর্তে কয়েকজন এলাকাবাসি জানান, এলাকার অধিকাংশ জমির মাটি কেটে নিচ্ছেন কিবরিয়া মিজি, খবির দেওয়ান, বাদশা সরদার ও মজিবুর মোল্লাসহ আরও কয়েকজন। তারা জানান, আগে রাতের আঁধারে মাটি কাটা হলেও এখন দিনে দুপুরেই কাটছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, প্রশাসন, নামধারী সাংবাদিকদের মাসিক চাঁদা দিয়ে মাটি কাটা হচ্ছে। আমরা এখন চাইলেও চাষাবাদ করতে পারি না। কেউ মাটি বিক্রি করতে না চাইলে জোর করে তাদের জমির মাটি কেটে নেওয়া হয়। ভেকু সেন্ডিকেট প্রভাবশালী হওয়ায় ভয়ে এলাকার কেউ প্রতিবাদ করতে সাহস পায় না।  স্থানীয় এক বাসিন্দা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ভেকুর অধিকাংশ মালিক ক্ষমতাবান-জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক ব্যক্তি হওয়ায় এসব নিয়ন্ত্রণে প্রশাসনও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয় না।  আবার যারা বন্ধ করবে তারাই এখানে জড়িত। যারা লিখবে তারাও এখান থেকে মাসিক চাঁদা পায়। 

এলাকাবাসী আরও জানান, মান্দান তলি মৌজা ও কাঁচিকাটা মৌজার ফসলী জমি বিক্রি করেছে শরীফ সরদার, হামিদ সরদার, লিটন সরদার, মানিক মুন্সি, শফি মুন্সি, মনোয়ার হোসেন বাবু বকাউল, আনোয়ার মোল্লাসহ আরও কয়েকজন। যাদের জমি বেশি তাদের মধ্যে কেউ কেউ চক্রের সাথে মিলে জমি বিক্রি করছে। যাদের কম জমি এক্ষেত্রে তাদের কিছুই বলার থাকে না। বলতে পারেন আমরা এক প্রকার অসহায়ত্ব বরণ করে আছি। গত বছর কাঁচিকাটা ইউনিয়নে চরজিংখিং রোস্তম আলী সরকারের গ্রামে মাটি কাটাকালীন সময় মাহিন্দ্রা ট্রাক্টরের নিচে পড়ে প্রাণ যায় এক কৃষকের। সখিপুর থানা থেকে পুলিশ আসলেও ঐ সময় টাকা দিয়ে ম্যানেজ করে নেয় কিবরিয়া মিজি। 

নিজেদের ক্ষতি করে কেন মাটি বিক্রি করছেন জানতে চাইলে শফি মুন্সী মাটি বিক্রি করেননি অস্বীকার করে তিনি বলেন, আমরা মাটি বিক্রির বিপক্ষে। মাটি কাটলে নদী ভাঙ্গার সম্ভবনা বেড়ে যায়।  আপনারা ঘটনাস্থলে আসুন, এসে নিউজ করুন। এ ব্যাপারে কাঁচিকাটা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান হামিদ সরদার থেকে জানতে চাইলে তিনি মাটি বিক্রি করেননি বলে জানান। জানা যায় হামিদ সরদার নিজে এসে বিক্রি না করলেও তার আপন বড় ভাই হাতেম আলী সরদার মাটি বিক্রির টাকা গ্রহণ করেন। মনোয়ার হোসেন বাবু বকাউলের মাটি বিক্রির  টাকা গ্রহণ করেন হাসান বকাউল। 

ভেকু মালিক কিবরিয়া মিজি এ প্রতিবেদকে বলেন, আপনি কোথায় আছেন বলেন সামনা সামনি দেখা করে কথা বলি। নিউজ করার দরকার নেই! আপনার হাদিয়া পেয়ে যাবেন। আমি সবাইকে দিয়েই কাজ করছি। 
ভেকুর আরেক মালিক মজিবুর মোল্লা বলেন, আমরা কারও জমি জোড় করে কাটি না। জমির মালিক মাটি বিক্রি করে বিধায় কাটতে পারি।    

প্রকাশ্যে মাটি কাটছে এ বিষয় জানতে চাইলে কাঁচিকাটা ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান নুরুল আমীন দেওয়ান বলেন, আমার ইউনিয়নে ভেকু দিয়ে মাটি কাটার বিষয়টি আমি অবগত নয়। উক্ত বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে দেখতে হবে। এ ব্যাপারে পরে কথা বলবো।  

ভেদরগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ফাতেমা ইসলাম জানান, বিশেষ প্রয়োজনে কেউ যদি ভেকু দিয়ে মাটি কাটতে চায় তবে অবশ্যই তাকে প্রশাসন থেকে অনুমতি নিবে হবে। তারা আমাদের থেকে কোন অনুমতি নেয়নি। ভেকু দিয়ে ফসলী জমি কাটা দণ্ডনীয় অপরাদ।  

সখিপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান হাওলাদার বলেন, ঘটনাস্থলে আমরা একাধিকবার নৌ-পুলিশ পাঠিয়েছিলাম। ওখানে যাদের জমি তারা বিক্রি করছে এখানে আমাদের কিছু করার নেই।  
ভেদরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার তানভীন আল নাসীফ বলেন, এ বিষয়ে আমি অবগত নয়। পূর্বে এ সংক্রান্ত একটি তথ্য শোনার পর স্থানীয় জনপ্রতিনিধিকে তদন্তে পাঠাই এবং তিনি ওই স্থানে ভেকু দিয়ে মাটি কাটার কোনো প্রমাণ পাননি। তবে কাঁচিকাটা ইউনিয়নের নিকটবর্তী চাদপুর জেলার অধিনস্ত কিছু জায়গা কাঁচিকাটা নামে পরিচিত হওয়ায় এ খবরটির বিভ্রাট ছড়াতে পারে। 

২০১৩ সালের ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইনে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি ইট প্রস্তুত করার উদ্দেশ্যে কৃষি জমি, বা পাহাড় বা টিলা হতে মাটি কেটে বা সংগ্রহ করে ইটের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে না। যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি ব্যতীত কোনো ব্যক্তি ইট প্রস্তুত করার উদ্দেশ্যে মৌজা পুকুর বা বিল বা খাঁড়ি বা দিঘি বা নদ-নদী বা হাওর-বাঁওড় বা চরাঞ্চল বা পতিত জায়গা হতে মাটি কাটতে পারবে না। যদি কোন ব্যক্তি আইনের এই ধারা লঙ্ঘন করেন তা হলে তিনি অনধিক ২ (দুই) বৎসরের কারাদণ্ড বা ২ (দুই) লক্ষ টাকা অর্থদন্ড অথবা উভয় দণ্ডেদন্ডিত হইবেন। অন্যদিকে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর কর্তৃক নির্মিত বা ইউনিয়ন বা গ্রামীন সড়ক ব্যবহার করিয়া কোন ব্যক্তি ভারি যানবাহন দ্বারা ইট বা ইটের কাচাঁমাল পরিবহন করিতে পারিবেন না। যদি কোন ব্যক্তি আইনের এই ধারা লঙ্ঘন করেন তা হইলে তিনি ১ (এক) লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হইবেন। এসব আইন থাকার পরও ভূমিদস্যুরা আইনের তোয়াক্কা না করে স্থানীয় প্রশাসনের চোখের সামনে এসব কর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। বিষয়টি স্থানীয় উপজেলা প্রশাসনকে অবহিত করার পরও প্রশাসনের এই নিরব ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ করেছে এলাকাবাসীর মনে।

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর..
ফেসবুকে আমরা...
ক্যালেন্ডার...

Sun
Mon
Tue
Wed
Thu
Fri
Sat