#আ.লীগের নেতাকর্মীদের হাতে ৬ হাজার ২০৪টি অবৈধ অস্ত্র #বিভিন্ন থানা ও ফাঁড়ি থেকে লুট হওয়া ১ হাজার ৩৭৫টি আগ্নেয়াস্ত্র এখনও হয়নি উদ্ধার #আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের হাতে থাকা অস্ত্রগুলো এখন হুমকি হিসেবে দেখছেন গোয়েন্দারা #অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে গোয়েন্দা ও থানাসহ পুলিশের সব ইউনিট কাজ করছে
অস্থিরতার শঙ্কা অবৈধ অস্ত্রেই

- আপডেট সময় : ০৭:২০:৪৫ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২০ মে ২০২৫ ২৬ বার পড়া হয়েছে
আওয়ামী লীগ সরকারের গত ১৫ বছরের শাসনামলে ১৯ হাজার ৫৯৪টি অস্ত্রের লাইসেন্স দিয়েছিল। এরমধ্যে ১০ হাজারের মতো অস্ত্রের লাইসেন্স দেয়া হয়েছিল রাজনৈতিক বিবেচনায়। হাসিনা সরকারের গেল ১৫ বছরে বিভিন্ন সময়েই বৈধ অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহার দেখা গেছে। বিরোধীপক্ষকে শায়েস্তা করতে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের অস্ত্রের প্রদর্শন করতেও দেখা গেছে। এসব ক্ষেত্রে অবৈধ অস্ত্রের পাশাপাশি বৈধ অস্ত্র ব্যবহারের অভিযোগও রয়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা অস্ত্র নিয়ে আন্দোলনকারীদের উপর চড়াও হয়। এ সংক্রান্ত বিভিন্ন ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সে সময় ছড়িয়ে পড়ে। এসব ভিডিওতে তাদেরকে কখনো পুলিশের সামনে আবার কখনো নিজেরা সংঘবদ্ধ হয়ে আন্দোলনকারীদের দমাতে অস্ত্র হাতে দেখা গিয়েছে।
দেশে বৈধ অস্ত্রের সংখ্যা ছিল ৫০ হাজার ৩১০টি। এর মধ্যে ৪৫ হাজার ২২৬টি অস্ত্র ব্যক্তির হাতে ও ৫ হাজার ৮৪টি প্রতিষ্ঠানের কাছে। ব্যক্তির কাছে থাকা অস্ত্রের মধ্যে রাজনীতিবিদদের হাতে ছিলো ১০ হাজার ২১৫টি আগ্নেয়াস্ত্র। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের হাতে ৭ হাজার ৫৪৯টি, বিএনপির নেতাকর্মীদের হাতে ২ হাজার ৫৮৭টি এবং জাতীয় পার্টিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতাদের কাছে ছিলে ৭৯টি আগ্নেয়াস্ত্র।
সূত্র বলছে, ঘোষণা দেওয়ার পরেও জমা না পড়া অস্ত্রগুলো এখন অবৈধ হয়ে গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, এসব অস্ত্র সরকারবিরোধী কর্মকাণ্ডে ব্যবহার হতে পারে। সম্প্রতি একটি গোয়েন্দা সংস্থা এ বিষয়ে সরকারকে আগাম তথ্য দেওয়ায় নড়েচড়ে বসেছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। একই সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ বিভিন্ন সংস্থার লুট হওয়া অস্ত্র সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে ব্যবহার হচ্ছে এবং তা উদ্ধারে অভিযান জোরদার করারও পরামর্শ দেওয়া হয়েছে ওই গোয়েন্দা প্রতিবেদনে। প্রতিবেদনটি আমলে নিয়ে এরই মধ্যে অভিযান আরও জোরদারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে।
সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, অস্ত্র যতটা প্রত্যাশা করেছিলাম, ততটা উদ্ধার হয়নি। তবে চেষ্টা চলছে। বাইরে অস্ত্র থাকলে কিছুটা হুমকি থেকেই যায়। একই সঙ্গে আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় এখন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অনেক ভালো বলেও জানান তিনি।
অবৈধ অস্ত্র প্রসঙ্গে ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারের ডিসি মুহাম্মদ তালেবুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, গত বছরের ২৫ আগস্ট ২০০৯ সালের পর থেকে পাওয়া লাইসেন্সধারী সব অস্ত্রের লাইসেন্স স্থগিত করে ৩ সেপ্টেম্বরের মধ্যে জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। ওই সময়ে জমা না পড়া অস্ত্রগুলো এখন অবৈধ হয়ে গেছে। এ ধরনের অস্ত্রের সংখ্যা কয়েক হাজার হবে। ওই অস্ত্রগুলো উদ্ধারে গোয়েন্দা ও থানাসহ পুলিশের সব ইউনিট কাজ করছে।
জানা গেছে, আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের হাতে থাকা অস্ত্রগুলো এখন হুমকি হিসেবে দেখছেন গোয়েন্দারা। ধারণা করা হচ্ছে, এসব অস্ত্রের ব্যবহার হতে পারে। এ কারণে এসব অস্ত্র উদ্ধার অভিযান জোরদার করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত কোর কমিটির বৈঠকেও অস্ত্র উদ্ধার করতে না পারার বিষয়ে আলোচনা হয়। সেখানে থানাভিত্তিক অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের তালিকা তৈরি করে বিভিন্ন বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করে অস্ত্র উদ্ধার করার নির্দেশনা দেওয়া হয়।
সূত্রমতে, লাইসেন্সধারী অস্ত্রের অধিকাংশের মালিক আওয়ামী লীগ সরকারের সংসদ সদস্য, ব্যবসায়ী ও প্রভাবশালী ব্যক্তি। লাইসেন্সধারী ব্যক্তিরা বেশিরভাগ দেশে-বিদেশে আত্মগোপন করেছেন। আবার লাইসেন্সধারীদের কেউ কেউ বলেছেন, তাদের অস্ত্র লুট হয়ে গেছে। তবে সেই অভিযোগে থানায় কোনো মামলা বা জিডি করা হয়নি। এমনকি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছেও এর পরিসংখ্যান নেই। যার কারণে তাদের অভিযোগ আমলে নিচ্ছে না পুলিশ।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বিগত সরকারের সময় যারা অস্ত্রের লাইসেন্স পেয়েছেন তাদের অনেকেরই টিআইএন নেই। অথচ আগ্নেয়াস্ত্র কেনার ক্ষেত্রে শুধু টিআইএন নয়, দুই লাখ টাকার বেশি রিটার্ন জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক ছিল। দুই লাখ টাকা রিটার্ন দিতে হলে সেই স্বাভাবিক ব্যক্তি করদাতাকে কমপক্ষে ১৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা বৈধভাবে আয় করতে হবে। অথচ রাজনৈতিক তদবিরে ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের নামেও অস্ত্রের লাইসেন্স ইস্যু করা হয়েছিল। তারা এখন ওইসব অস্ত্র জমা না দিয়ে আত্মগোপন করেছেন। মাঝেমধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হাজির হয়ে হুমকি-ধমকিও দিয়ে যাচ্ছেন। বিষয়টি আমলে নিয়ে তদন্ত করছেন পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিটের সদস্যরা।
এদিকে ২০ এপ্রিল পর্যন্ত পুলিশের বিভিন্ন থানা ও ফাঁড়ি থেকে লুট হওয়া ৫ হাজার ৭৫৩টি অস্ত্রের মধ্যে ৪ হাজার ৩৭৮টি অস্ত্র উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। এখনও উদ্ধার হয়নি ১ হাজার ৩৭৫টি আগ্নেয়াস্ত্র। একইভাবে ৬ লাখ ৫১ হাজার ৮২০টি বিভিন্ন ধরনের গোলাবারুদের মধ্যে ৩ লাখ ৯৩ হাজার ৯৭১টি গোলাবারুদ উদ্ধার হয়েছে। এখনও ২ লাখ ৫৭ হাজার ৮৪৯টি বিভিন্ন ধরনের গোলাবারুদ থেকে গেছে অস্ত্রধারীদের হাতে। উদ্ধার না হওয়া আগ্নেয়াস্ত্রের মধ্যে রয়েছে- বিভিন্ন ধরনের রাইফেল, এসএমজি (স্মল মেশিনগান), এলএমজি (লাইট মেশিনগান), বিদেশি পিস্তল, শটগান, চায়নিজ রাইফেল (সিআর) ইত্যাদি। আর গোলাবারুদের মধ্যে রয়েছে- কাঁদানে গ্যাস লঞ্চার, গ্যাসগান, কাঁদানে গ্যাসের শেল, কাঁদানে গ্যাসের স্প্রে, সাউন্ড গ্রেনেড ও বিভিন্ন বোরের গুলি, কালার স্মোক গ্রেনেড, সেভেন মাল্টিপল ব্যাং স্টান গ্রেনেড, ফ্ল্যাশ ব্যাংক গ্রেনেড ও হ্যান্ডহেল্ড টিয়ার গ্যাস স্প্রে ইত্যাদি। ধারণা করা হচ্ছে, এসব অস্ত্র আন্ডারওয়ার্ল্ডের শীর্ষ সন্ত্রাসী, স্থানীয় সন্ত্রাসী, জেল পলাতক আসামি, পেশাদার অপরাধী, এমনকি রাজনৈতিক দলের ক্যাডারদের হাতে চলে গেছে। এসব অস্ত্র ব্যবহার করে যেকোনো সময় ডাকাতি, ছিনতাইসহ বড় ধরনের অপরাধ সংঘটনের আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ কারণে ওইসব অস্ত্র-গোলাবারুদ উদ্ধারেও বিশেষ অভিযান অব্যাহত রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে গোয়েন্দাদের পক্ষ থেকে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, গণভবন ও সংসদ ভবন থেকে যেসব অস্ত্র-গুলি লুট হয়েছে, সেসবের বেশিরভাগই জেনেভা ক্যাম্প ও আশপাশ এলাকার কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের কাছে থাকার আশঙ্কা রয়েছে। লুট করা অস্ত্র তারা ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডের কয়েকটি সন্ত্রাসী গ্রুপের কাছে বিক্রি করে দেওয়ার গোয়েন্দা তথ্যও পুলিশের কাছে রয়েছে। এ কারণে যেকোনো অভিযান চালানোর ক্ষেত্রে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করা হচ্ছে।