আন্তর্জাতিক মঞ্চেও ফ্যাসিস্টরা

- আপডেট সময় : ১৪৯ বার পড়া হয়েছে
যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরের জন এফ কেনেডি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) নেতাদের ওপর পলাতক আওয়ামীলীগ ফ্যাসিস্টদের হামলা এবং বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে অপমানের ঘটনা বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য গভীরভাবে উদ্বেগজনক প্রতিফলন হয়ে দেখা দিয়েছে। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের হাতে ঘটে যাওয়া এই ন্যাক্কারজনক হামলার ঘটনাটি প্রবাসে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও রাজনৈতিক সহনশীলতার ওপর বড় ধরনের আঘাত বলে মনে করছেন বিরোধী দলীয় নেতারা এবং প্রবাসী পর্যবেক্ষকরা।
গত ২২ সেপ্টেম্বর নিউ ইয়র্কের জেএফকে বিমানবন্দরে বিএনপি ও এনসিপির নেতারা যুক্তরাষ্ট্রে অবতরণের সময় আওয়ামী লীগের কিছু নেতাকর্মী তাদের লক্ষ্য করে অবমাননাকর শব্দ ব্যবহার, ডিম নিক্ষেপ এবং গালিগালাজসহ শারীরিক ও মানসিক হয়রানির ঘটনাটি ঘটায়। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুলকে কটূক্তি করা হয়, যা রাজনৈতিক ইতিহাসে বিরল ও নিন্দনীয় ঘটনা।
আওয়ামীলীগ দীর্ঘদিন ধরে এককভাবে ক্ষমতা ধরে রাখার প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছে। এর অংশ হিসেবে বিরোধী দলের মতামত ও কার্যক্রমকে দমন করা তাদের অন্যতম কৌশল। নিউ ইয়র্কের ঘটনার মতো হামলা এ মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ। তাদের দৃষ্টিতে বিরোধীরা ‘শত্রু’ এবং তাদের বিরুদ্ধে যেকোনো কড়া পদক্ষেপ গ্রহণ সাধু কাজ হিসেবে বিবেচিত হয়। প্রবাসে নিজেদের রাজনৈতিক আধিপত্য নিশ্চিত করতে আওয়ামী লীগ কিছু সময়ে প্রয়োগ করে জোরশক্তি প্রদর্শন। তারা প্রবাসে বিরোধীদের গলা চাপা দিয়ে নিজের অবস্থান শক্ত করার চেষ্টা করে। কনস্যুলেটসহ সরকারি সংস্থাগুলোয় নিজেদের লোক বসিয়ে বিরোধীদের ওপর নজরদারি ও চাপ বৃদ্ধি করে আওয়ামী লীগ তাদের রাজনৈতিক প্রভাব বৃদ্ধি করতে চায়।
আওয়ামী লীগের শাসনামলে দেশের সম্পদ দুর্নীতি করে পলাতক হয়ে বিদেশে গিয়ে আয়েশী জীবনযাপন করছে ফ্যাসিস্টদের একটি অংশ। বিশেষ করে এরাই বিরোধী দলের কিংবা ভিন্ন মতের ব্যক্তিদের উপর হামলা করছে। এই তান্ডব শুধু দেশের অর্থনৈতিক ক্ষতির কারণ নয়, দেশের মানুষের আস্থাকে নষ্ট করছে এবং আন্তর্জাতিকভাবে দেশের ভাবমূর্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
রাজনীতিবিদরা মনে করছেন, নিউইয়র্কে এনসিপি নেতাদের ওপর হামলা কেবল এক দলের বিরুদ্ধে সহিংসতার ঘটনা নয়, এটি বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিদ্যমান ফ্যাসিবাদী মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ। যেখানে ভিন্নমত দমনের জন্য সহিংসতা ব্যবহৃত হয় এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ভয় দেখিয়ে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হারিয়ে ফেলা হয়। এ ধরনের ঘটনা দেশের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তির জন্য বড় ধাক্কা। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে দৃঢ় প্রতিবাদ এবং সহনশীল, সংলাপমুখী রাজনীতির বিকাশই দেশের উত্তরণ পথ।
দেশের বাইরের এমন নৃশংস রাজনীতি ভয়াবহ সংকেত মনে করছেন বিশিষ্টজনরা। তারা বলছেন, রাজনৈতিক বিরোধিতাকে সহ্য না করা, মতপ্রকাশ দমন করা একদমই গণতন্ত্রের পরিপন্থী। এটি শুধু বিএনপি বা এনসিপির নয়, পুরো দেশের জন্য ভাবনার বিষয়। প্রবাসে এমন ঘটনাগুলো বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিরই কালো ছবি তুলে ধরে। এখানে যে রাজনৈতিক সহিংশতা ও স্বৈরাচারিতা আন্তর্জাতিক মঞ্চেও ধরা পড়ছে, তা দেশের ভাবমূর্তির জন্য বড় ধরনের ধাক্কা। মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হল গণতন্ত্রের প্রাণ। নিউ ইয়র্কের এই হামলা শুধু রাজনৈতিক নেতাদের নয়, প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক অধিকারের অবমূল্যায়ন। আমরা প্রত্যাশা করি, সরকার ও কূটনৈতিক মহল দ্রুত পদক্ষেপ নেবে।
ঘটনার পর এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, এটি কেবল একটি হামলা নয়, বরং আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদী রাজনীতির আন্তর্জাতিক রপ্তানি। জেএফকের মতো একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে রাজনৈতিক নেতাদের ওপর হামলা শুধু দুঃখজনক নয়, এটি গণতন্ত্রের প্রতি চরম অবমাননা। নারী নেত্রী ডা. তাসনিম তারা বলেন, নারী নেতৃত্বকে অপমান ও ভীত করার জন্য যে ভাষা ও আচরণ ব্যবহার করা হয়েছে, তা অত্যন্ত লজ্জাজনক। আওয়ামী লীগ ভিন্নমতকে দমন করতে প্রবাসেও ফ্যাসিবাদী কৌশল গ্রহণ করেছে। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, বাংলাদেশ কনসুলেট ঘটনাটি জানার পরও কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। তারা নিরাপত্তা চেয়ে আগেই জানালেও কনসুলেট নির্বিকার ছিল। এনসিপি দাবি করেছে, রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধিত্বকারী সংস্থা হয়েও কনসুলেট এ ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনার সময় দায়িত্বহীন ভূমিকা পালন করেছে, যা প্রকারান্তরে হামলাকারীদের উৎসাহিত করেছে।
নিউ ইয়র্ক, নিউ জার্সি ও অন্যান্য প্রদেশের প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে এ ঘটনায় তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকেই একে ‘গণতন্ত্রের প্রতি চরম অসম্মান’ বলে অভিহিত করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী বিশ্লেষক সামিউল হাসান বলেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সহিংসতা এখন বিশ্বমঞ্চেও প্রকাশ পাচ্ছে। জেএফকের মতো জায়গায় বিরোধী নেতাদের ওপর হামলা শুধু রাজনৈতিক অস্থিরতাই নয়, দেশের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তিরও ক্ষতি করছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. ফরহাদ হোসেন বলেন, রাজনৈতিক মতের পার্থক্যকে সহ্য না করতে পারা, এবং প্রবাসে গিয়ে এমন আক্রমণ চালানো—এটি ফ্যাসিবাদের একটি ক্লাসিক চিত্র। এ থেকে স্পষ্ট, ভিন্নমতের প্রতি কোনো সহনশীলতা নেই। ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ায় যুক্তরাষ্ট্রের কিছু মানবাধিকার সংস্থা বিষয়টি পর্যবেক্ষণে রেখেছে। জেএফকে নিরাপত্তা বাহিনীর পক্ষ থেকেও ঘটনার বিষয়ে তথ্য নেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে দলের সদস্য সচিব আখতার হোসেনের উপর হামলার প্রতিবাদে গতকাল মঙ্গলবার জরুরি এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি)। সংবাদ সম্মেলনে এনসিপি আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, এর আগে গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতাদের উপর হত্যার নীলনকশা নিয়ে যে আক্রমণ, সে আক্রমণ আমরা দেখেছি। উপদেষ্টা ও গণঅভ্যুত্থানের নেতা মাহফুজ আলম এর আগে যখন লন্ডন-আমেরিকায় গিয়েছেন তখন তার উপর হামলা করার চেষ্টা করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক শহরের জন এফ কেনেডি এয়ারপোর্ট থেকে বের হওয়ার সময় জাতীয় নাগরিক পার্টির সংগ্রামী সদস্য সচিব আখতারে হোসেন এবং এনসিপির নেত্রী ড. তাসনিম জারাকে লক্ষ্য করে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ হামলা করে। সরকার এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে নিরাপত্তা দেওয়ার যে ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল, সেই ব্যবস্থাগুলো যথাযথ ছিল না বলেই গতকালের ঘটনা ঘটে। আমরা এর নিন্দা এবং প্রতিবাদ জানাচ্ছি।