ঢাকা ০৬:০৯ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪

ইলিশ সম্পদ লুটে নেয় কালাপাহাড়া ধলাপাহাড়

প্রতিনিধির নাম
  • আপডেট সময় : ০৬:১৮:৪৪ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৫ অক্টোবর ২০২৪ ৭৮ বার পড়া হয়েছে
দৈনিক গনমুক্তি অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

 

ইলিশ আহরণ করে সরাসরি  প্রায় ৬ লাখ জেলে জীবীকা নির্বাহ করে থাকে

২৫ সেন্টিমিটার পর্যন্ত ইলিশ হচ্ছে জাটকা

মা ইলিশ সংরক্ষণ তথা প্রজননকালীন ২২ দিন ইলিশ শিকার নিষিদ্ধ

ইলিশ জাতীয় পতাকাবাহী মাছ

 

আমিনুল হক ভূইয়া

২০১৭ সালে ভৌগোলিক নির্দেশক বা জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া ইলিশ বাংলাদেশের জাতীয় মাছ। এর ঠিকানা মূলত সাগরে হলেও গর্ভবতী ইলিশ ডিম পাড়ার সময় বাংলাদেশের নদ-নদীতে চলে আসে। ইলিশ বাংলাদেশের জলসীমার বিভিন্ন অঞ্চলে পাওয়া যায়। ইলিশ আহরণ করে প্রায় ৬ লাখ জেলে জীবীকানির্বাহ করে থাকে। ইলিশের প্রজনন নিরাপদ করতে ব্যাপক নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। ডিম ছাড়ার পর বাচ্চা লালন-পালনে পদ্মা-মেঘনার বিশাল এলাকাজুড়ে ইলিশের বিচরণ। ২৫ সেন্টিমিটার পর্যন্ত ইলিশ হচ্ছে জাটকা। যার আহরণ নিষিদ্ধ। ছোট আকারের ইলিশের বাচ্চা মেঘনা ও পদ্মার চরাঞ্চলের ঘিরে বিচরণ করে। এ সময় অবৈধভাবে চরঘেরাও জাল দিয়ে জাটকা ইলিশ শিকার করে মাফিয়া চক্রের লোকজন। কোন রকমের বিনিয়োগ ছাড়াই প্রাকৃতিভাবে প্রাপ্ত ইলিশ সম্পদ রক্ষার পরিবর্তে লুণ্ঠনে আটঘাট বেঁধে মাঠে নামে কালাপাহাড়া ধলাপাহাড়।

ইলিশ তো বটেই মেঘনা-পদ্মা নদীও তাদের কাছে নিরাপদ নয়। তন্ত্র-মন্ত্রের ডুগডুগি বাজিয়ে জনসম্মুখে তাদের বয়ানের সঙ্গে মানুষের পরিচয় থাকলেও কালাপাহাড় ধলাপাহাড়ের নেপথ্যে কুৎসিত চরিত্রের সমালোচনা করা কারো সহাস নেই। ইলিশ ও নদী দখলের এই মাফিয়া গোষ্ঠীর বিনাশ নাই। রাজনৈতিক পরিবর্তনেও তাদের কোন সমস্যা হয় না। কারণ, টাকার গায়ে নির্ধারিত পরিমাণ লেখা থাকে। এটাতে কোন পাহাড়ের চেহারা থাকে না। মানুষ জানে তারা রাজনীতিক-সমাজসেবী। কিন্তু তাদের ছত্রছায়ায় নদী ও মাছ দুটোই লুটে নেয় গোষ্ঠী ভুক্ত লোকজন। অবশ্য এনিয়ে কারো মুখ খোলার সাহস নেই। মা ইলিশ এবং জাটকা সংরক্ষণকালে শরীয়তপুর নড়িয়া অঞ্চলের পদ্মায় মা ইলিশ আহরণ নিষিদ্ধকালীন বিভিন্ন স্থান থেকে লোকজন এসে ইলিশ শিকার করে নিয়ে যায়। একই ভাবে ভোলার মেঘনা-তেতুঁলিয়া নদীতেও ইলিশ শিকার করা হয়। এর পেছনে কালাপাহাড়া ধলাপাহাড় তথা মাফিয়া গোষ্ঠীর হাত রয়েছে।

মা ইলিশ সংরক্ষণ ঘিরে জনসচেতনতা সভায় বক্তব্য রাখেন ইলিষম্পদ উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের পরিচালক মোল্লা এমদাদুল্যাহ

সম্প্রতি ভোলার মেহেন্দিগঞ্জ, হিজলা ও ভোলা সদর, শরীয়তপুরের বিভিন্ন উপজেলা এবং চাঁদপুরে সরেজমিন মাছ ব্যবসায়ী, আড়তদার, জেলে এবং জেলে সম্প্রদায়ের নেতাদের সঙ্গে আলাপকালে এমন ভয়ঙ্কর চিত্র ওঠে আসে। তবে অনেকেই মাফিয়া গোষ্ঠীর কারো নাম না বললেও কেউ কেউ বলেন, আগে আওয়ামী লীগের বিশিষ্ট নেতার ছত্রছায়ায় হলেও ৫ আগস্টের পর তার পরিবর্তন ঘটে। এখন বিএনপির বিশিষ্ট নেতার ছত্রছায়ায় হচ্ছে। আগে পরে প্রশাসনের তরফে অবৈধ জালসহ নৌকা আটক করা হলে নেতাদের কল আসতো।

প্রজনন মৌসুমে মা ইলিশ সংরক্ষণ নিশ্চিত করতে ভোলার ইলিশা মাছ ঘাট মৎস্য ব্যবসায়ী সমিতির নেতা-কর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময়ে আসেন ইলিশ সম্পদ উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের পরিচালক মোল্লা এমদাদুল্যাহ। তাকে ঘিরে আছেন বেশ কিছু ব্যবসায়ী। ভোলা এলাকায় তিনি হুজুর স্যার হিসাবে খ্যাত। তিনি যেখানেই গিয়েছেন, মৎস্যজীবীরা তাকে ঘিরে ধরেছে। দূরে থাকলে জেলে দৌড়ে কাছে এসে সালাম দিয়ে হাসিমুখে জানতে চেয়েছেন, স্যার কেমন আছেন। সন্ধ্যায় মাছ বাজারে গিয়েও একই চিত্র দেখা যায়। হ্যামিলনের বাশিওয়ালার মতো কাল্পনিক নয়, জীবন্ত গল্প।

প্রজনন মৌসুমে ১৩ অক্টোবর থেকে ৩ নভেম্বর ইলিশ শিকার বন্ধ থাকবে। এ বিষয়ে জনসচেতনতার অংশ হিসাবে দক্ষিণাঞ্চলের ভোলায় আসেন মোল্লা এমদাদুল্যাহ। ভোলায় হুজুর স্যার আসছেন শুনে বেশ কিছু জেলে ও মাছ ব্যবসায়ী ইলিশা ঘাটে উপস্থিতি হন। পরে ইলিশাঘাট মৎস্য ব্যবসায়ী সমিতিতে মতবিনিময় করেন। এসময় সভাপতি আবু তাহের অভিযোগ তোলেন, শরীয়তপুর, চাঁদপুর ও মল্লিকপুর এলাকায় বহু সংখ্যক জেলে নিষিদ্ধকালীন সময়ে মাছ শিকার করে থাকে। মাছ ব্যবসায়ী সাইদুল বলেন, দৌলত খা থেকে ভাটির দিকে কালীগঞ্জ, মেহেন্দীগঞ্জ, পাতারহাট এলাকায়ও মাছ ধরা হয়। তবে তারা বাইরে থেকে এসে মাছ ধরে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ করেন।

মোল্লা এমদাদুল্যাহ ব্যবসায়ীদের আসস্থ করে বলেন, মা ইলিশ সংরক্ষণ তথা প্রজননকালীন ২২ দিন ইলিশ শিকার নিষিদ্ধ। এ সময় হিজলা, মেহেন্দীগঞ্জ ও হাইমচর এলাকায় ১৪টি স্পিড বোট  রাত দিন টহলে থাকবে। মাওয়া থেকে শরীয়তপুর ও চাঁদপুর, ভোলা পর্যন্ত প্রতিটি অভয়াশ্রম ঘিরে মৎস্য অধিদপ্তর ছাড়াও নৌ-পুলিশ, কোস্ট গার্ড দায়িত্ব পালন করবে। ইলিশের প্রজনন মৌসুম ঘিরে অক্টোবরের শুরুতেই জনসচেতনতামূলক প্রচার শুরু করে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মৎস্য অধিদপ্তরের ইলিশ সম্পদ উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা প্রকল্প।

মোল্লা এমদাদুল্যাহ বলেন, জাটকার দৈর্ঘ্য ১৩ সে.মি থেকে ২৫ সে.মি পুনঃনির্ধারণ করা হয়। জাটকা সংরক্ষণে প্রচলিত আইন সংশোধন করে প্রতি বছর ১ নভেম্বর থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত ৮ মাস জাটকা ধরা, পরিবহন, সংরক্ষণ, ক্রয়-বিক্রয় নিষিদ্ধ এবং আইনত দন্ডনীয় অপরাধ।  জাটকা সংরক্ষণের ফলে প্রতিবছর বাংলাদেশের ইলিশের সংখ্যা বাড়ছে।

ইদিশ উৎপাদনে বাংলাদেশ রোল মডেল। ইলিশ একটি নবায়নযোগ্য প্রাকৃতিক সম্পদ এবং ভৌগলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে বিশ্ব বাজারে সমাদৃত। বিশ্বের মোট উৎপাদিত ইলিশের প্রায় ৮০ শতাংশের বেশি বাংলাদেশে উৎপাদন হয়ে থাকে। ইলিশ আহরণকারী ১৫ টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্তান শীর্ষে। জিডিপিতে ইলিশের অবদান ১% এর বেশি। একক প্রজাতি হিসেবে মোট মৎস্য উৎপাদান ১২.২৪ শতাংশ। দেশের প্রায় ৬ লাখ জেলে ইলিশ ধরে থাকে এবং ২০-২৫ লক্ষ লোক পরোক্ষভাবে ইলিশ সম্পদের সাথে জড়িত। সরকারের বিভিন্ন ইলিশ বান্ধব কার্যক্রম বাস্তবায়নের ফলে বিগত ১২ বছরে ইলিশের উৎপাদন প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ইলিশের উৎপাদন ৫.৭১ লক্ষ মেট্রিক টন এবং উৎপাদন বৃদ্ধির হার ৩.৩১। ইলিশ সম্পদ উন্নয় ও বাস্তয়ন প্রকল্পের কর্মকান্ডের পর ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে ১৬ শতাংশ।

ভোলায় সচেতনতা সভা

মোল্লা এমদাদুল্যাহ বলেন, আশির দশকের পূর্বে ইলিশের অবদান ছিলো  মোট মৎস্য উৎপাদনের ২০০% । ২০০১-২০০৩ সালে ইলিশের অবদান দাঁড়ায় জাতীয় উৎপাদনের মাত্র ৮৯ (১.৯৯ লক্ষ মে. টন)। বিগত ১০০০-১০০১ সালে ইলিশের উৎপাদন ২.২৯ লক্ষ মে. টন থাকলেও ২০০১-০২ ও ২০০২-০৩ সালে তা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেয়ে যথাক্রমে ২.২০ লক্ষ মে.টন এবং ১.৯৯ লক্ষ মে.টনে পৌঁছে। ইলিশ সম্পদ হ্রাসের কারণে জেলেদের এক বিরাট অংশ বেকার হয়ে জীবন ধারণ কঠিন হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে মৎস্য অধিদপ্তর প্রথম হিলশা ফিশারীজ ম্যানেজমেন্ট একশন প্লান প্রণয়ন করে। কর্ম-পরিকল্পনায় ইলিশ সম্পদ সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনায় ইলিশের জীবন আচরণ ও বিস্তৃতির এলাকা নির্ধারণ, প্রজনন মৌসুম ও ক্ষেত্র নির্ধারণ, অভয়াশ্রম এলাকা ঘোষণা, যা ইলিশ ও জাটকা সংরক্ষণ, ইলিশ ও জাটকা আহরণকারী জেলেদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পুনর্বাসনে বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টি, মৎস্য সুরক্ষা ও সংরক্ষণ আইন ১৯৫০ সংশোধন করা হয়।

মোল্লা এমদাদুল্যাহ বলেন, ইলিশ জাতীয় পতাকাবাহী মাছের পাশাপাশি বাংলাদেশের একটি ভৌগলিক নির্দেশক পণ্য। এই সম্পদ সংরক্ষণের জন্য বাংলাদেশ সরকার বিধি ও আইন প্রণয়ন ও সংশোধনের পাশাপাশি বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এরমধ্যে, ভর প্রজনন মৌসুমে ইলিশের নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ নিশ্চিত করা, নভেম্বর থেকে জুন মাসে জাটকা সংরক্ষণ কর্মসূচি বাস্তবায়ন এবং ইলিশ মাছের অভয়ারণ্যে মার্চ থেকে এপ্রিল পর্যন্ত সব ধরনের মাছ ধরা নিষিদ্ধ করা টেকসই প্রবৃদ্ধির জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

ইলিশ মাছের প্রকল্প নির্দিষ্ট সময়ে জাটকা ও মা ইলিশ রক্ষায় সর্বাত্মক সহায়তা প্রদান করে। অবৈধ মাছ ধরা বন্ধে নিষিদ্ধ সময়ে ইলিশ মাছের অভয়ারণ্য ব্যবস্থাপনায় কার্যক্রম সমন্বয় করতে প্রকল্পটি অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। পাশাপাশি নির্বাচিত জেলেদের জীবনযাত্রার মান উন্নীতকরণ, দক্ষ প্রশিক্ষণসহ বিকল্প আয় সৃষ্টিকারী কার্যক্রমের জন্য একটি বকনা বাছুর প্রদান করে আসছে।

অবৈধ মাছ ধরা অপসারণের জন্য নির্বাচিত গ্রামের জেলেদের ইলিশ মাছ ধরার জাল বিতরণ করা হয়েছে। এতে জেলেদের সুবিধাভোগীরা নিষিদ্ধ সময়ে ইলিশ মাছ ধরা থেকে দূরে রাখে। ইলিশ সংরক্ষণে স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানোর লক্ষ্যে প্রকল্পটি গণসচেতনতামূলক কর্মসূচী বাস্তবায়নের পাশাপাশি সমাজ সচেতনতায় নানা রকমের সামাজিক কর্প্রকান্ড ও প্রচারণা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে।

 

নিউজটি শেয়ার করুন

ট্যাগস :

ইলিশ সম্পদ লুটে নেয় কালাপাহাড়া ধলাপাহাড়

আপডেট সময় : ০৬:১৮:৪৪ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৫ অক্টোবর ২০২৪

 

ইলিশ আহরণ করে সরাসরি  প্রায় ৬ লাখ জেলে জীবীকা নির্বাহ করে থাকে

২৫ সেন্টিমিটার পর্যন্ত ইলিশ হচ্ছে জাটকা

মা ইলিশ সংরক্ষণ তথা প্রজননকালীন ২২ দিন ইলিশ শিকার নিষিদ্ধ

ইলিশ জাতীয় পতাকাবাহী মাছ

 

আমিনুল হক ভূইয়া

২০১৭ সালে ভৌগোলিক নির্দেশক বা জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া ইলিশ বাংলাদেশের জাতীয় মাছ। এর ঠিকানা মূলত সাগরে হলেও গর্ভবতী ইলিশ ডিম পাড়ার সময় বাংলাদেশের নদ-নদীতে চলে আসে। ইলিশ বাংলাদেশের জলসীমার বিভিন্ন অঞ্চলে পাওয়া যায়। ইলিশ আহরণ করে প্রায় ৬ লাখ জেলে জীবীকানির্বাহ করে থাকে। ইলিশের প্রজনন নিরাপদ করতে ব্যাপক নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। ডিম ছাড়ার পর বাচ্চা লালন-পালনে পদ্মা-মেঘনার বিশাল এলাকাজুড়ে ইলিশের বিচরণ। ২৫ সেন্টিমিটার পর্যন্ত ইলিশ হচ্ছে জাটকা। যার আহরণ নিষিদ্ধ। ছোট আকারের ইলিশের বাচ্চা মেঘনা ও পদ্মার চরাঞ্চলের ঘিরে বিচরণ করে। এ সময় অবৈধভাবে চরঘেরাও জাল দিয়ে জাটকা ইলিশ শিকার করে মাফিয়া চক্রের লোকজন। কোন রকমের বিনিয়োগ ছাড়াই প্রাকৃতিভাবে প্রাপ্ত ইলিশ সম্পদ রক্ষার পরিবর্তে লুণ্ঠনে আটঘাট বেঁধে মাঠে নামে কালাপাহাড়া ধলাপাহাড়।

ইলিশ তো বটেই মেঘনা-পদ্মা নদীও তাদের কাছে নিরাপদ নয়। তন্ত্র-মন্ত্রের ডুগডুগি বাজিয়ে জনসম্মুখে তাদের বয়ানের সঙ্গে মানুষের পরিচয় থাকলেও কালাপাহাড় ধলাপাহাড়ের নেপথ্যে কুৎসিত চরিত্রের সমালোচনা করা কারো সহাস নেই। ইলিশ ও নদী দখলের এই মাফিয়া গোষ্ঠীর বিনাশ নাই। রাজনৈতিক পরিবর্তনেও তাদের কোন সমস্যা হয় না। কারণ, টাকার গায়ে নির্ধারিত পরিমাণ লেখা থাকে। এটাতে কোন পাহাড়ের চেহারা থাকে না। মানুষ জানে তারা রাজনীতিক-সমাজসেবী। কিন্তু তাদের ছত্রছায়ায় নদী ও মাছ দুটোই লুটে নেয় গোষ্ঠী ভুক্ত লোকজন। অবশ্য এনিয়ে কারো মুখ খোলার সাহস নেই। মা ইলিশ এবং জাটকা সংরক্ষণকালে শরীয়তপুর নড়িয়া অঞ্চলের পদ্মায় মা ইলিশ আহরণ নিষিদ্ধকালীন বিভিন্ন স্থান থেকে লোকজন এসে ইলিশ শিকার করে নিয়ে যায়। একই ভাবে ভোলার মেঘনা-তেতুঁলিয়া নদীতেও ইলিশ শিকার করা হয়। এর পেছনে কালাপাহাড়া ধলাপাহাড় তথা মাফিয়া গোষ্ঠীর হাত রয়েছে।

মা ইলিশ সংরক্ষণ ঘিরে জনসচেতনতা সভায় বক্তব্য রাখেন ইলিষম্পদ উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের পরিচালক মোল্লা এমদাদুল্যাহ

সম্প্রতি ভোলার মেহেন্দিগঞ্জ, হিজলা ও ভোলা সদর, শরীয়তপুরের বিভিন্ন উপজেলা এবং চাঁদপুরে সরেজমিন মাছ ব্যবসায়ী, আড়তদার, জেলে এবং জেলে সম্প্রদায়ের নেতাদের সঙ্গে আলাপকালে এমন ভয়ঙ্কর চিত্র ওঠে আসে। তবে অনেকেই মাফিয়া গোষ্ঠীর কারো নাম না বললেও কেউ কেউ বলেন, আগে আওয়ামী লীগের বিশিষ্ট নেতার ছত্রছায়ায় হলেও ৫ আগস্টের পর তার পরিবর্তন ঘটে। এখন বিএনপির বিশিষ্ট নেতার ছত্রছায়ায় হচ্ছে। আগে পরে প্রশাসনের তরফে অবৈধ জালসহ নৌকা আটক করা হলে নেতাদের কল আসতো।

প্রজনন মৌসুমে মা ইলিশ সংরক্ষণ নিশ্চিত করতে ভোলার ইলিশা মাছ ঘাট মৎস্য ব্যবসায়ী সমিতির নেতা-কর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময়ে আসেন ইলিশ সম্পদ উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের পরিচালক মোল্লা এমদাদুল্যাহ। তাকে ঘিরে আছেন বেশ কিছু ব্যবসায়ী। ভোলা এলাকায় তিনি হুজুর স্যার হিসাবে খ্যাত। তিনি যেখানেই গিয়েছেন, মৎস্যজীবীরা তাকে ঘিরে ধরেছে। দূরে থাকলে জেলে দৌড়ে কাছে এসে সালাম দিয়ে হাসিমুখে জানতে চেয়েছেন, স্যার কেমন আছেন। সন্ধ্যায় মাছ বাজারে গিয়েও একই চিত্র দেখা যায়। হ্যামিলনের বাশিওয়ালার মতো কাল্পনিক নয়, জীবন্ত গল্প।

প্রজনন মৌসুমে ১৩ অক্টোবর থেকে ৩ নভেম্বর ইলিশ শিকার বন্ধ থাকবে। এ বিষয়ে জনসচেতনতার অংশ হিসাবে দক্ষিণাঞ্চলের ভোলায় আসেন মোল্লা এমদাদুল্যাহ। ভোলায় হুজুর স্যার আসছেন শুনে বেশ কিছু জেলে ও মাছ ব্যবসায়ী ইলিশা ঘাটে উপস্থিতি হন। পরে ইলিশাঘাট মৎস্য ব্যবসায়ী সমিতিতে মতবিনিময় করেন। এসময় সভাপতি আবু তাহের অভিযোগ তোলেন, শরীয়তপুর, চাঁদপুর ও মল্লিকপুর এলাকায় বহু সংখ্যক জেলে নিষিদ্ধকালীন সময়ে মাছ শিকার করে থাকে। মাছ ব্যবসায়ী সাইদুল বলেন, দৌলত খা থেকে ভাটির দিকে কালীগঞ্জ, মেহেন্দীগঞ্জ, পাতারহাট এলাকায়ও মাছ ধরা হয়। তবে তারা বাইরে থেকে এসে মাছ ধরে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ করেন।

মোল্লা এমদাদুল্যাহ ব্যবসায়ীদের আসস্থ করে বলেন, মা ইলিশ সংরক্ষণ তথা প্রজননকালীন ২২ দিন ইলিশ শিকার নিষিদ্ধ। এ সময় হিজলা, মেহেন্দীগঞ্জ ও হাইমচর এলাকায় ১৪টি স্পিড বোট  রাত দিন টহলে থাকবে। মাওয়া থেকে শরীয়তপুর ও চাঁদপুর, ভোলা পর্যন্ত প্রতিটি অভয়াশ্রম ঘিরে মৎস্য অধিদপ্তর ছাড়াও নৌ-পুলিশ, কোস্ট গার্ড দায়িত্ব পালন করবে। ইলিশের প্রজনন মৌসুম ঘিরে অক্টোবরের শুরুতেই জনসচেতনতামূলক প্রচার শুরু করে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মৎস্য অধিদপ্তরের ইলিশ সম্পদ উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা প্রকল্প।

মোল্লা এমদাদুল্যাহ বলেন, জাটকার দৈর্ঘ্য ১৩ সে.মি থেকে ২৫ সে.মি পুনঃনির্ধারণ করা হয়। জাটকা সংরক্ষণে প্রচলিত আইন সংশোধন করে প্রতি বছর ১ নভেম্বর থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত ৮ মাস জাটকা ধরা, পরিবহন, সংরক্ষণ, ক্রয়-বিক্রয় নিষিদ্ধ এবং আইনত দন্ডনীয় অপরাধ।  জাটকা সংরক্ষণের ফলে প্রতিবছর বাংলাদেশের ইলিশের সংখ্যা বাড়ছে।

ইদিশ উৎপাদনে বাংলাদেশ রোল মডেল। ইলিশ একটি নবায়নযোগ্য প্রাকৃতিক সম্পদ এবং ভৌগলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে বিশ্ব বাজারে সমাদৃত। বিশ্বের মোট উৎপাদিত ইলিশের প্রায় ৮০ শতাংশের বেশি বাংলাদেশে উৎপাদন হয়ে থাকে। ইলিশ আহরণকারী ১৫ টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্তান শীর্ষে। জিডিপিতে ইলিশের অবদান ১% এর বেশি। একক প্রজাতি হিসেবে মোট মৎস্য উৎপাদান ১২.২৪ শতাংশ। দেশের প্রায় ৬ লাখ জেলে ইলিশ ধরে থাকে এবং ২০-২৫ লক্ষ লোক পরোক্ষভাবে ইলিশ সম্পদের সাথে জড়িত। সরকারের বিভিন্ন ইলিশ বান্ধব কার্যক্রম বাস্তবায়নের ফলে বিগত ১২ বছরে ইলিশের উৎপাদন প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ইলিশের উৎপাদন ৫.৭১ লক্ষ মেট্রিক টন এবং উৎপাদন বৃদ্ধির হার ৩.৩১। ইলিশ সম্পদ উন্নয় ও বাস্তয়ন প্রকল্পের কর্মকান্ডের পর ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে ১৬ শতাংশ।

ভোলায় সচেতনতা সভা

মোল্লা এমদাদুল্যাহ বলেন, আশির দশকের পূর্বে ইলিশের অবদান ছিলো  মোট মৎস্য উৎপাদনের ২০০% । ২০০১-২০০৩ সালে ইলিশের অবদান দাঁড়ায় জাতীয় উৎপাদনের মাত্র ৮৯ (১.৯৯ লক্ষ মে. টন)। বিগত ১০০০-১০০১ সালে ইলিশের উৎপাদন ২.২৯ লক্ষ মে. টন থাকলেও ২০০১-০২ ও ২০০২-০৩ সালে তা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেয়ে যথাক্রমে ২.২০ লক্ষ মে.টন এবং ১.৯৯ লক্ষ মে.টনে পৌঁছে। ইলিশ সম্পদ হ্রাসের কারণে জেলেদের এক বিরাট অংশ বেকার হয়ে জীবন ধারণ কঠিন হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে মৎস্য অধিদপ্তর প্রথম হিলশা ফিশারীজ ম্যানেজমেন্ট একশন প্লান প্রণয়ন করে। কর্ম-পরিকল্পনায় ইলিশ সম্পদ সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনায় ইলিশের জীবন আচরণ ও বিস্তৃতির এলাকা নির্ধারণ, প্রজনন মৌসুম ও ক্ষেত্র নির্ধারণ, অভয়াশ্রম এলাকা ঘোষণা, যা ইলিশ ও জাটকা সংরক্ষণ, ইলিশ ও জাটকা আহরণকারী জেলেদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পুনর্বাসনে বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টি, মৎস্য সুরক্ষা ও সংরক্ষণ আইন ১৯৫০ সংশোধন করা হয়।

মোল্লা এমদাদুল্যাহ বলেন, ইলিশ জাতীয় পতাকাবাহী মাছের পাশাপাশি বাংলাদেশের একটি ভৌগলিক নির্দেশক পণ্য। এই সম্পদ সংরক্ষণের জন্য বাংলাদেশ সরকার বিধি ও আইন প্রণয়ন ও সংশোধনের পাশাপাশি বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এরমধ্যে, ভর প্রজনন মৌসুমে ইলিশের নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ নিশ্চিত করা, নভেম্বর থেকে জুন মাসে জাটকা সংরক্ষণ কর্মসূচি বাস্তবায়ন এবং ইলিশ মাছের অভয়ারণ্যে মার্চ থেকে এপ্রিল পর্যন্ত সব ধরনের মাছ ধরা নিষিদ্ধ করা টেকসই প্রবৃদ্ধির জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

ইলিশ মাছের প্রকল্প নির্দিষ্ট সময়ে জাটকা ও মা ইলিশ রক্ষায় সর্বাত্মক সহায়তা প্রদান করে। অবৈধ মাছ ধরা বন্ধে নিষিদ্ধ সময়ে ইলিশ মাছের অভয়ারণ্য ব্যবস্থাপনায় কার্যক্রম সমন্বয় করতে প্রকল্পটি অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। পাশাপাশি নির্বাচিত জেলেদের জীবনযাত্রার মান উন্নীতকরণ, দক্ষ প্রশিক্ষণসহ বিকল্প আয় সৃষ্টিকারী কার্যক্রমের জন্য একটি বকনা বাছুর প্রদান করে আসছে।

অবৈধ মাছ ধরা অপসারণের জন্য নির্বাচিত গ্রামের জেলেদের ইলিশ মাছ ধরার জাল বিতরণ করা হয়েছে। এতে জেলেদের সুবিধাভোগীরা নিষিদ্ধ সময়ে ইলিশ মাছ ধরা থেকে দূরে রাখে। ইলিশ সংরক্ষণে স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানোর লক্ষ্যে প্রকল্পটি গণসচেতনতামূলক কর্মসূচী বাস্তবায়নের পাশাপাশি সমাজ সচেতনতায় নানা রকমের সামাজিক কর্প্রকান্ড ও প্রচারণা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে।