করা হচ্ছে তথ্য অধিকার আইনের অপব্যবহার: অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা আজ সংকটে
- আপডেট সময় : ৭৩ বার পড়া হয়েছে
সাধারণ মানুষের তথ্যপ্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যেই প্রণীত হয়েছিল জাতীয় তথ্য অধিকার আইন–২০০৯। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে সরকারি দপ্তরগুলোতে এই আইনকে তথ্য লুকানোর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার প্রবণতা ভয়াবহভাবে বেড়েছে।
সাংবাদিকরা অভিযোগ করছেন, যে তথ্যগুলো স্বাভাবিকভাবেই প্রকাশযোগ্য, সেগুলোও দপ্তরগুলো এখন আর দিচ্ছে না। বরং আইনকে ভুলভাবে প্রয়োগ করে তথ্যকে আটকে রাখছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেখা যাচ্ছে, এই আইনকেই এখন সরকারি কর্মকর্তারা তথ্য গোপনের সুরক্ষা ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছেন।
এই প্রবণতা শুধু প্রশাসনিক স্বেচ্ছাচারই নয়, বরং দুর্নীতি, অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতি ঢেকে রাখার জন্য সুপরিকল্পিতভাবে তথ্য গোপনের করার প্রচেষ্টা।
নানা দপ্তরে সাম্প্রতিক একাধিক ঘটনার ভিত্তিতে এমন অভিযোগ এখন জোরালো হয়ে উঠেছে।
ঘটনা ১: রাজশাহীর শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের একটি ঠিকাদারি কাজের মৌলিক তথ্য (কাজের মূল্য, কাজের প্রতিষ্ঠান ও মেয়াদ) জানতে চাইলে নির্বাহী প্রকৌশলী সরাসরি তথ্য দিতে অস্বীকৃতি জানান। বরং তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করার পরামর্শ দেন এবং অসহযোগী মনোভাব দেখান। অথচ যেই তথ্য নোটিশ বোর্ডে থাকা বাধ্যতামূলক, সেই তথ্য পেতে এখন আবেদন করতে হচ্ছে।
ঘটনা ২: জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর রাজশাহীর চলমান ১০ গ্রুপের প্রকল্পের ওয়ার্ক অর্ডার কপি চাওয়া হলে সেটিও নাকচ করা হয়।যেখানে থাকে মাত্র তিনটি তথ্য, কাজ কোন প্রতিষ্ঠান পেয়েছে, কত টাকার প্রকল্প এবং কাজের মেয়াদ। এই তথ্যগুলোকেও “সরাসরি দেওয়া যাবে না” বলা হয়েছে। যা অনুসন্ধানী রিপোর্টকে দিন নয়, সপ্তাহের পর সপ্তাহ পিছিয়ে দিচ্ছে।
ঘটনা ৩: বাংলাদেশ রেলওয়ে পশ্চিমে (রাজশাহী রেলওয়ে শ্টেশনের) দোকানঘর বরাদ্দেও অস্বচ্ছতা পরিলক্ষিত হয়েছে। দোকানঘর লিজ কে পেল, কতজন টেন্ডার জমা দিযেছিল এবং সর্বোচ্চ দরদাতা কে ছিল? এসব প্রশ্ন শুনে বাংলাদেশ রেলওয়ে পশ্চিমের চীফ কমার্শিয়াল ম্যানেজার (সিসিএম) এর পক্ষ থেকে বিস্ময়করভাবে জানানো হয়—“আমার জানা নেই, তথ্যের জন্য আবেদন করুন।” তার এমন মনোভাবে টেন্ডার প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতার ওপর গুরুতর প্রশ্ন তোলে।
ঘটনা ৪: রাজশাহী জেলার সম্পূর্ণ সার ডিলার লাইসেন্সের তালিকা জানতে চাইলে বিএডিসির যুগ্ম পরিচালক জুলফিকার আলী তথ্য দিতে অস্বীকৃতি জানান—“উপর থেকে নিষেধ রয়েছে” এই অজুহাতে। পরে অনুসন্ধানে দেখা যায়—একই ব্যক্তি চারটি লাইসেন্সের মালিক হয়ে জালিয়াতি করছেন। অর্থাৎ তথ্য গোপন করা হয়েছিল মূলত অনিয়ম আড়াল করার জন্য।
ঘটনা ৫: রাজশাহী ওয়াসার বৃহৎ প্রকল্পে জমি অধিগ্রহণের তথ্যও গোপন করেছে জেলা প্রশাসন। রাজশাহী ওয়াসার সবচেয়ে বড় পানি সরবরাহ প্রকল্পে পবা ও গোদাগাড়ীতে শত শত একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। সাংবাদিকরা জানতে চেয়েছিলেন, কোন মালিকের কত জমি নেওয়া হয়েছে, কতজন ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন, কত টাকা দেওয়া হয়েছে?
এসব নথি সাধারণত প্রকাশযোগ্য। কিন্তু জেলা প্রশাসক তা দিতে অস্বীকৃতি জানান।
পরে তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করলেও জ, ঝ, ঞ ধারার অপব্যাখ্যা দেখিয়ে আবেদনটি বাতিল করা হয়েছে। যেখানে জমি অধিগ্রহণের অর্থ জনগণের টাকা, সেই তথ্য জনগণই জানতে পারছেন না।
জাতীয় তথ্য অধিকার আইন ২০০৯ এর জ, ঝ, ঞ—ধারা এখন দুর্নীতিবাজদের নিরাপদ ছাতা? কারন এই ধারায় বলা হয়েছে, রাষ্ট্রের ক্ষতি হয় এমন তথ্য, কারো সামাজিক ক্ষতি হয় এমন তথ্য, ব্যক্তিগত স্বার্থে চাওয়া তথ্য হলে সেই তথ্য দেওয়া যাবে না। যা বর্তমানে কর্মকর্তারা এই ধারা এমনভাবে ব্যবহার করছেন, যেন প্রতিটি তথ্যই মারাত্মক গোপনীয়। ফলে সাধারণ টেন্ডার, প্রকল্প, বাজেট, বরাদ্দ, ওয়ার্ক অর্ডার—সবকিছুই ঢেকে ফেলা হচ্ছে।
একে করে সাংবাদিকদের তথ্যপ্রাপ্তি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। স্বচ্ছতা ও গণতন্ত্র দুই-ই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে।
কর্মকর্তাদের তথ্য অসহযোগিতার কারনে অনেক রিপোর্ট ১৫ দিন নয়, মাসের মাস পিছিয়ে যাচ্ছে। এমনকি তথ্য প্রাপ্তির কারনে কোন রিপোর্ট সাংবাদিকদের আড়ালে চলে যায়। আবার তথ্য আবেদনের কারনে দুর্নীতিবাজরা সময় পেয়ে যাচ্ছে। এতে দলিলপত্র পরিবর্তন, প্রভাব খাটানো বা বিভিন্ন মাধ্যম দিয়ে সাংবাদিকদের উপর চাপ প্রয়োগ করার সুযোগ পাই।
সরকার ও সংস্কার কমিশনের প্রতি দাবি, ১) তথ্যপ্রাপ্তির আইনি বাধা দূর করা। প্রকাশযোগ্য তথ্যগুলো তথ্য অধিকার আইনে আবেদন ছাড়া দিতে বাধ্যতামূলক করতে হবে।
২) জ, ঝ, ঞ ধারার ব্যাখ্যা স্পষ্ট করতে হবে।যাতে কর্মকর্তা অপব্যবহার করতে না পারেন।
৩) তথ্য দিতে অস্বীকৃতি জানালে শাস্তির বিধান কঠোর করতে হবে।
৪) সব প্রকল্প, ওয়ার্ক অর্ডার, টেন্ডার, ডিলার তালিকা ওয়েবসাইটে আপলোড বাধ্যতামূলক করতে হবে এবং ওপেন রাখতে হবে।
৫) সাংবাদিকদের তথ্য চাওয়ার কারণে হয়রানি করলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।
স্বচ্ছতা ছাড়া উন্নয়ন টেকসই হয় না। আর সাংবাদিকদের তথ্যপ্রাপ্তি ছাড়া স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা অসম্ভব। দুর্নীতি কমাতে হলে সাংবাদিকদের রাস্তাটি আগে পরিষ্কার করতে হবে। অন্যথায় পুরো প্রশাসন অন্ধকারেই রয়ে যাবে।















