ঢাকা ০৪:৫৪ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৩ অক্টোবর ২০২৫

গেমসের নেশায় নিঃস্ব জীবন

হালিম মোহাম্মদ
  • আপডেট সময় : ২৪৩ বার পড়া হয়েছে
দৈনিক গনমুক্তি অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

খেলাধুলা বই পড়া আর গল্পের আসর ছিল শিশু-কিশোরদের বিনোদন। ডিজিটালের নামে সে স্থান দখল করেছে মোবাইল ও অনলাইন গেম। এটা ষোল আনাই জুয়া। বিনোদনের আড়ালে এই গেমগুলো শিক্ষার্থীদের আর্থিক ধ্বংসের ফাঁদ। এ সকল আর্থিক এবং মানসিক ক্ষতির উৎস হচ্ছে দ্রুতগতির ইন্টারনেট, সস্তা স্মার্টফোন আর সহজে টাকা লেনদেনের সুযোগ। এর প্রভাবে সারাদেশে মোবাইল ও অনলাইন গেমের নেশা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। এই খেলা বা জুয়া খেলা বারন করতে গিয়ে বাড়ছে পারিবারিক কলহ। খেলা নিষেধ করার বিপরীতে তরুন এবং কিশোর শিক্ষার্থীরা অভিভাবকদের তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করছেন। কিছু ক্ষেত্রে সন্তানদের মানসিক সমস্যায় অভিভাবকরা অপমানিত হচ্ছেন। তারপরও অনলাইন গেম খেলা বন্ধ হচ্ছে না। এক কথায় গেম খেলা বারন করতে গিয়ে মা বাবা সন্তানদের সম্পর্কের দুরত্ব বাড়ছে। পুরো পরিবারে অশান্তির আগুন জ্বলছে। এমন উদাহরন রয়েছে।
জানা গেছে, গেম কোম্পানিগুলো এমনভাবে তাদের অ্যাপ তৈরি করে, যাতে খেলোয়াড় প্রথম দিকে কিছুটা বিনামূল্যে খেলতে পারে, কিন্তু পরে ‘জিততে’ হলে বা ‘নতুন লেভেলে’ যেতে হলে টাকা খরচ করতেই হয়। ‘একটু খরচ করলেই জিতব’ এই লোভেই শুরু হয় টাকা ঢালার প্রবণতা।
ঢাকার নাজিম উদ্দিন রোডের বাসিন্দা শাহিন। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। অবসরে বন্ধুদের সঙ্গে অনলাইন কার্ড ও ক্যাসিনো গেম খেলতেন। শুরুতে সামান্য টাকার বাজি হলেও পরে অ্যাপে ‘ইজি পেমেন্ট’ সুবিধায় হাজার হাজার টাকা খরচ হয়। কয়েক মাসের মধ্যে বেতন তো শেষই, ধার-দেনার বোঝা দাঁড়ায় প্রায় দুই লাখ টাকায়। শেষমেশ চাকরি হারিয়ে এখন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছেন।
মিরপুরের বাসিন্দা নাজমুল আলম। বাংলা কলেজের একাদশের শিক্ষার্থী। ২০২২ সালে তিনি ‘অল-স্টার পোকার’ নামের একটি অনলাইন গেম খেলতে শুরু করেন। শুরুতে বিনামূল্যের কয়েন দিয়ে খেললেও পরে ক্রেডিট কার্ড দিয়ে কয়েন কেনা শুরু করেন। তিনি বলেন, ‘প্রথমে ৫০০ টাকা দিয়ে কিনলাম। তারপর হাজার, তারপর ৫ হাজার এক সময় দেখলাম কার্ডের বিল দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা। এতে করে লেখাপড়া বন্ধ। ভবঘুরের মতো চলছে।
আজিমপুরের কলেজ ছাত্র আনোয়ার হোসেন। তার বন্ধুদের সঙ্গে মিশে অনলাইন গেমে আসক্ত হয়ে পড়েন। তিনি বলেন, প্রতিবার নতুন চরিত্র আনতে টাকা লাগত। বাসা থেকে দেয়া খরচের টাকা থেকে শুরু করে বন্ধুর কাছ থেকেও ধার করেছি। বর্তমানে পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে পারছি না, পরীক্ষার ফলও খারাপ হচ্ছে। রাতভর অনলাইনে গেম খেলেন। আর দিনভর ঘুমান। পরিবারের কারো কথা শুনেন না। তাকে নিয়ে চলছে পরিবারের অশান্তি।
রাজধানীর জুরাইন ট্রাকস্ট্যান্ডে কয়েকজন তরুণ শ্রমিকের সঙ্গে কথা হলে তারা বলেন, প্রথমে সময় কাটানোর জন্য কাজের ফাঁকে ফাঁকে গেম খেলতাম। এক সময় দেখি একটা অফার আসলো যে টাকা ইনভেস্ট করলেই লাভ পাওয়া যাবে। পরে ৫০০ টাকা দিয়ে শুরু করলেও এখন আমাদের প্রতিমাসে প্রায় ৭০ থেকে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত লেনদেন হয় অনলাইন গেমের মাধ্যমে। এতে করে আমাদের কেউ কেউ টাকা পেয়েছে তবে বেশিরভাগেই টাকা পায় না। বুঝতে পারলাম, এই খেলা ষোল আনাই জুয়া।
এবিষয়ে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মুনতাসীর মারুফ বলেন, এই গেমগুলো এমনভাবে ডিজাইন করা হয় যাতে খেলোয়াড় আসক্ত হয়ে পড়ে। প্রতিবার ছোট পুরস্কার দিয়ে বড় পুরস্কারের লোভ দেখানো হয়, যা ‘জুয়া মনস্তত্ত্ব’ তৈরি করে। দীর্ঘ সময় ধরে এটি মানসিক স্বাস্থ্য ও আর্থিক নিরাপত্তা দুটোই নষ্ট করে।
তিনি বলেন, অনলাইন জুয়ার বিরুদ্ধে সদ্য জারি হওয়া সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ অনুযায়ী কঠোর ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছে সরকার। ইতোমধ্যে জুয়ার সঙ্গে জড়িত ১ হাজার ১০০ এর বেশি মোবাইল ব্যাংকিং (এমএফএস) এজেন্ট শনাক্ত করে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
এবিষয়ে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, অনলাইনে জুয়া খেলা, জুয়ার অ্যাপ বা পোর্টাল তৈরি ও প্রচারণা- সবই অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। এ ধরনের অপরাধে দুই বছরের কারাদ- বা ১ কোটি টাকা জরিমানা কিংবা উভয় দ-ের বিধান রয়েছে। এছাড়া জুয়া খেলার আর্থিক লেনদেন, প্রতারণা জালিয়াতিও নিষিদ্ধ।
বিটিআরসি জানিয়েছে, জুয়া নিয়ে উৎসাহ প্রদান বা বিজ্ঞাপনেও অংশ নেয়া অপরাধ। কোনো তারকা বা নাগরিকের ছবি অনুমতি ছাড়া জুয়ার প্রচারণায় ব্যবহৃত হলে আইনি ব্যবস্থা নেয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। একই সঙ্গে আইন প্রণয়নের আগে যারা জুয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তাদের দ্রুত এ কার্যক্রম থেকে সরে আসতে বলা হয়েছে। আইনের ৩০ ধারায় ভুক্তভোগীদের ক্ষতিপূরণের সুযোগও রাখা হয়েছে। সরকার জানিয়েছে, অনলাইন জুয়ার বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত থাকবে এবং জড়িত ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, বিজ্ঞাপনদাতা ও মিডিয়ার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হবে।
মানসিক চিকিৎসক ফিরোজ হোসেন বলেন, এ ধরনের প্ল্যাটফর্মে টাকা খরচ মানে দেশের অর্থ বিদেশে চলে যাওয়া। আর ব্যক্তিগত পর্যায়ে এটি অনেক পরিবারের আর্থিক নিরাপত্তা নষ্ট করছে।
কুমিল্লা সরকারি ভিক্টোরিয়া কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ড. আবুল কাশেম বলেন, গেম আসক্তি এক সময় মাদকাসক্তির মতোই সামাজিক সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে। স্কুল-কলেজ পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের সময় ব্যবস্থাপনা ও অনলাইন ব্যবহারের ওপর প্রশিক্ষণ দেয়া জরুরি। কুমিল্লার একটি সরকারি স্কুলের শিক্ষক আবু তালেব বলেন, ‘আমার ক্লাসের কয়েকজন ছাত্র মোবাইল গেমের কারণে পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়েছে। অভিভাবকেরাও বিষয়টি বুঝতে পারেন না, কারণ তারা মনে করেন গেম খেলা শুধু বিনোদন।
অন্যদিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, কিছু গেম আসলে অনলাইন জুয়ার আড়াল’। এ ধরনের প্ল্যাটফর্মে টাকা ঢুকিয়ে খেলোয়াড়েরা কৃত্রিমভাবে জেতানো-হারানোর চক্রে আটকে পড়েন। বর্তমান সময়ে ইন্টারনেট সারা বিশ্বের মানুষের জন্য বড় এক সুবিধা হলেও, এর অপব্যবহার বিশেষ করে যুব সমাজের মধ্যে উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে। তরুণ প্রজন্মের অনেকেই ইন্টারনেটকে ইতিবাচক শিক্ষার বদলে গেমিং, অনলাইন জুয়া ও অনৈতিক কাজে বেশি ব্যবহার করছে। যার কারণ অভিভাবক, শিক্ষক ও চিন্তাশীল মানুষদের মাঝে ব্যাপক উদ্বেগ ও হতাশা বাড়ছে।
তিনি বলেন, বর্তমানে দেশে শহর থেকে গ্রাম সাব জায়গায় অনলাইন গেমিংয়ে তরুণদের আসক্তি বেড়েছে। টাকা খরচ করে বিভিন্ন গেম খেলছে তারা। এসব গেমের কারণে অনেকেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে, পড়াশোনায় মনোযোগ হারাচ্ছে। বাবা-মায়ের উদ্বেগও বাড়ছে। পাশাপাশি, কিছু গেম আসলে জুয়ার মতোই, যা তরুণদের অপরাধ ও অনৈতিক কর্মকা-ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, বিভিন্ন অনলাইন গেম ও বেটিং সাইটের মাধ্যমে তরুণরা টাকা খরচ করছে, অবাধ্য আচরণ করছে এবং জুয়ার নেশায় জড়িয়ে পড়ছে। ইসলাম ধর্মে যেমন বাস্তব জীবনে জুয়া, প্রতারণা, মিথ্যা কথা বলা বা অশ্লীলতা হারাম, তেমনি অনলাইনেও এসব কাজ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এমনকি এসবের মাধ্যমে উপার্জিত আয়ও হারাম।
এ ব্যাপারে মুফতি আলী হাসান তৈয়ব বলেন, ইন্টারনেটকে আল্লাহর এক বড় নিয়ামত। আউটসোর্সিং, অনলাইন শিক্ষালাভ, কুরআন-হাদিস অধ্যয়ন, আন্তর্জাতিক জ্ঞান অর্জন ইত্যাদি কাজে তরুণদের মনোযোগী হতে হবে। পরিবার ও সমাজকে সজাগ থেকে সন্তানদের এ ধরনের ফেতনা থেকে রক্ষা করতে হবে।

নিউজটি শেয়ার করুন

ট্যাগস :

গেমসের নেশায় নিঃস্ব জীবন

আপডেট সময় :

খেলাধুলা বই পড়া আর গল্পের আসর ছিল শিশু-কিশোরদের বিনোদন। ডিজিটালের নামে সে স্থান দখল করেছে মোবাইল ও অনলাইন গেম। এটা ষোল আনাই জুয়া। বিনোদনের আড়ালে এই গেমগুলো শিক্ষার্থীদের আর্থিক ধ্বংসের ফাঁদ। এ সকল আর্থিক এবং মানসিক ক্ষতির উৎস হচ্ছে দ্রুতগতির ইন্টারনেট, সস্তা স্মার্টফোন আর সহজে টাকা লেনদেনের সুযোগ। এর প্রভাবে সারাদেশে মোবাইল ও অনলাইন গেমের নেশা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। এই খেলা বা জুয়া খেলা বারন করতে গিয়ে বাড়ছে পারিবারিক কলহ। খেলা নিষেধ করার বিপরীতে তরুন এবং কিশোর শিক্ষার্থীরা অভিভাবকদের তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করছেন। কিছু ক্ষেত্রে সন্তানদের মানসিক সমস্যায় অভিভাবকরা অপমানিত হচ্ছেন। তারপরও অনলাইন গেম খেলা বন্ধ হচ্ছে না। এক কথায় গেম খেলা বারন করতে গিয়ে মা বাবা সন্তানদের সম্পর্কের দুরত্ব বাড়ছে। পুরো পরিবারে অশান্তির আগুন জ্বলছে। এমন উদাহরন রয়েছে।
জানা গেছে, গেম কোম্পানিগুলো এমনভাবে তাদের অ্যাপ তৈরি করে, যাতে খেলোয়াড় প্রথম দিকে কিছুটা বিনামূল্যে খেলতে পারে, কিন্তু পরে ‘জিততে’ হলে বা ‘নতুন লেভেলে’ যেতে হলে টাকা খরচ করতেই হয়। ‘একটু খরচ করলেই জিতব’ এই লোভেই শুরু হয় টাকা ঢালার প্রবণতা।
ঢাকার নাজিম উদ্দিন রোডের বাসিন্দা শাহিন। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। অবসরে বন্ধুদের সঙ্গে অনলাইন কার্ড ও ক্যাসিনো গেম খেলতেন। শুরুতে সামান্য টাকার বাজি হলেও পরে অ্যাপে ‘ইজি পেমেন্ট’ সুবিধায় হাজার হাজার টাকা খরচ হয়। কয়েক মাসের মধ্যে বেতন তো শেষই, ধার-দেনার বোঝা দাঁড়ায় প্রায় দুই লাখ টাকায়। শেষমেশ চাকরি হারিয়ে এখন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছেন।
মিরপুরের বাসিন্দা নাজমুল আলম। বাংলা কলেজের একাদশের শিক্ষার্থী। ২০২২ সালে তিনি ‘অল-স্টার পোকার’ নামের একটি অনলাইন গেম খেলতে শুরু করেন। শুরুতে বিনামূল্যের কয়েন দিয়ে খেললেও পরে ক্রেডিট কার্ড দিয়ে কয়েন কেনা শুরু করেন। তিনি বলেন, ‘প্রথমে ৫০০ টাকা দিয়ে কিনলাম। তারপর হাজার, তারপর ৫ হাজার এক সময় দেখলাম কার্ডের বিল দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা। এতে করে লেখাপড়া বন্ধ। ভবঘুরের মতো চলছে।
আজিমপুরের কলেজ ছাত্র আনোয়ার হোসেন। তার বন্ধুদের সঙ্গে মিশে অনলাইন গেমে আসক্ত হয়ে পড়েন। তিনি বলেন, প্রতিবার নতুন চরিত্র আনতে টাকা লাগত। বাসা থেকে দেয়া খরচের টাকা থেকে শুরু করে বন্ধুর কাছ থেকেও ধার করেছি। বর্তমানে পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে পারছি না, পরীক্ষার ফলও খারাপ হচ্ছে। রাতভর অনলাইনে গেম খেলেন। আর দিনভর ঘুমান। পরিবারের কারো কথা শুনেন না। তাকে নিয়ে চলছে পরিবারের অশান্তি।
রাজধানীর জুরাইন ট্রাকস্ট্যান্ডে কয়েকজন তরুণ শ্রমিকের সঙ্গে কথা হলে তারা বলেন, প্রথমে সময় কাটানোর জন্য কাজের ফাঁকে ফাঁকে গেম খেলতাম। এক সময় দেখি একটা অফার আসলো যে টাকা ইনভেস্ট করলেই লাভ পাওয়া যাবে। পরে ৫০০ টাকা দিয়ে শুরু করলেও এখন আমাদের প্রতিমাসে প্রায় ৭০ থেকে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত লেনদেন হয় অনলাইন গেমের মাধ্যমে। এতে করে আমাদের কেউ কেউ টাকা পেয়েছে তবে বেশিরভাগেই টাকা পায় না। বুঝতে পারলাম, এই খেলা ষোল আনাই জুয়া।
এবিষয়ে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মুনতাসীর মারুফ বলেন, এই গেমগুলো এমনভাবে ডিজাইন করা হয় যাতে খেলোয়াড় আসক্ত হয়ে পড়ে। প্রতিবার ছোট পুরস্কার দিয়ে বড় পুরস্কারের লোভ দেখানো হয়, যা ‘জুয়া মনস্তত্ত্ব’ তৈরি করে। দীর্ঘ সময় ধরে এটি মানসিক স্বাস্থ্য ও আর্থিক নিরাপত্তা দুটোই নষ্ট করে।
তিনি বলেন, অনলাইন জুয়ার বিরুদ্ধে সদ্য জারি হওয়া সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ অনুযায়ী কঠোর ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছে সরকার। ইতোমধ্যে জুয়ার সঙ্গে জড়িত ১ হাজার ১০০ এর বেশি মোবাইল ব্যাংকিং (এমএফএস) এজেন্ট শনাক্ত করে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
এবিষয়ে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, অনলাইনে জুয়া খেলা, জুয়ার অ্যাপ বা পোর্টাল তৈরি ও প্রচারণা- সবই অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। এ ধরনের অপরাধে দুই বছরের কারাদ- বা ১ কোটি টাকা জরিমানা কিংবা উভয় দ-ের বিধান রয়েছে। এছাড়া জুয়া খেলার আর্থিক লেনদেন, প্রতারণা জালিয়াতিও নিষিদ্ধ।
বিটিআরসি জানিয়েছে, জুয়া নিয়ে উৎসাহ প্রদান বা বিজ্ঞাপনেও অংশ নেয়া অপরাধ। কোনো তারকা বা নাগরিকের ছবি অনুমতি ছাড়া জুয়ার প্রচারণায় ব্যবহৃত হলে আইনি ব্যবস্থা নেয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। একই সঙ্গে আইন প্রণয়নের আগে যারা জুয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তাদের দ্রুত এ কার্যক্রম থেকে সরে আসতে বলা হয়েছে। আইনের ৩০ ধারায় ভুক্তভোগীদের ক্ষতিপূরণের সুযোগও রাখা হয়েছে। সরকার জানিয়েছে, অনলাইন জুয়ার বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত থাকবে এবং জড়িত ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, বিজ্ঞাপনদাতা ও মিডিয়ার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হবে।
মানসিক চিকিৎসক ফিরোজ হোসেন বলেন, এ ধরনের প্ল্যাটফর্মে টাকা খরচ মানে দেশের অর্থ বিদেশে চলে যাওয়া। আর ব্যক্তিগত পর্যায়ে এটি অনেক পরিবারের আর্থিক নিরাপত্তা নষ্ট করছে।
কুমিল্লা সরকারি ভিক্টোরিয়া কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ড. আবুল কাশেম বলেন, গেম আসক্তি এক সময় মাদকাসক্তির মতোই সামাজিক সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে। স্কুল-কলেজ পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের সময় ব্যবস্থাপনা ও অনলাইন ব্যবহারের ওপর প্রশিক্ষণ দেয়া জরুরি। কুমিল্লার একটি সরকারি স্কুলের শিক্ষক আবু তালেব বলেন, ‘আমার ক্লাসের কয়েকজন ছাত্র মোবাইল গেমের কারণে পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়েছে। অভিভাবকেরাও বিষয়টি বুঝতে পারেন না, কারণ তারা মনে করেন গেম খেলা শুধু বিনোদন।
অন্যদিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, কিছু গেম আসলে অনলাইন জুয়ার আড়াল’। এ ধরনের প্ল্যাটফর্মে টাকা ঢুকিয়ে খেলোয়াড়েরা কৃত্রিমভাবে জেতানো-হারানোর চক্রে আটকে পড়েন। বর্তমান সময়ে ইন্টারনেট সারা বিশ্বের মানুষের জন্য বড় এক সুবিধা হলেও, এর অপব্যবহার বিশেষ করে যুব সমাজের মধ্যে উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে। তরুণ প্রজন্মের অনেকেই ইন্টারনেটকে ইতিবাচক শিক্ষার বদলে গেমিং, অনলাইন জুয়া ও অনৈতিক কাজে বেশি ব্যবহার করছে। যার কারণ অভিভাবক, শিক্ষক ও চিন্তাশীল মানুষদের মাঝে ব্যাপক উদ্বেগ ও হতাশা বাড়ছে।
তিনি বলেন, বর্তমানে দেশে শহর থেকে গ্রাম সাব জায়গায় অনলাইন গেমিংয়ে তরুণদের আসক্তি বেড়েছে। টাকা খরচ করে বিভিন্ন গেম খেলছে তারা। এসব গেমের কারণে অনেকেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে, পড়াশোনায় মনোযোগ হারাচ্ছে। বাবা-মায়ের উদ্বেগও বাড়ছে। পাশাপাশি, কিছু গেম আসলে জুয়ার মতোই, যা তরুণদের অপরাধ ও অনৈতিক কর্মকা-ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, বিভিন্ন অনলাইন গেম ও বেটিং সাইটের মাধ্যমে তরুণরা টাকা খরচ করছে, অবাধ্য আচরণ করছে এবং জুয়ার নেশায় জড়িয়ে পড়ছে। ইসলাম ধর্মে যেমন বাস্তব জীবনে জুয়া, প্রতারণা, মিথ্যা কথা বলা বা অশ্লীলতা হারাম, তেমনি অনলাইনেও এসব কাজ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এমনকি এসবের মাধ্যমে উপার্জিত আয়ও হারাম।
এ ব্যাপারে মুফতি আলী হাসান তৈয়ব বলেন, ইন্টারনেটকে আল্লাহর এক বড় নিয়ামত। আউটসোর্সিং, অনলাইন শিক্ষালাভ, কুরআন-হাদিস অধ্যয়ন, আন্তর্জাতিক জ্ঞান অর্জন ইত্যাদি কাজে তরুণদের মনোযোগী হতে হবে। পরিবার ও সমাজকে সজাগ থেকে সন্তানদের এ ধরনের ফেতনা থেকে রক্ষা করতে হবে।