ছাত্র নেতৃত্বে বিভক্ত হয়ে পড়ছে চার বলয়ে

- আপডেট সময় : ০৮:১৮:১৩ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৯ ফেব্রুয়ারী ২০২৫ ২৬৩ বার পড়া হয়েছে
চলতি মাসের শেষের দিকে একটি রাজনৈতিক দল গঠন ও পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পরিকল্পনা করছে জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রনেতারা। শিক্ষার্থীদের নতুন রাজনৈতিক দলের আহ্বায়ক হিসেবে নাহিদ ইসলামের নাম প্রায় নিশ্চিত তবে দলের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পদ সদস্যসচিব হিসেবে কে আসছেন এনিয়ে নেতাদের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দিয়েছে। দলের শীর্ষ পদ নিয়ে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন তরুণ ও শিক্ষার্থীরা। গুঞ্জন উঠেছে জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্যসচিব ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সাবেক সমাজসেবা সম্পাদক আখতার হোসেন বাদ পড়ছেন। জানা গেছে, আখতারকে চাচ্ছেন একটি অংশ। তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আখতারের দীর্ঘ রাজনৈতিক ইতিহাস, রাজপথে লড়াই-সংগ্রাম, আন্দোলনে গ্রেফতার ও ভূমিকা নিয়ে প্রশংসা করছেন।
ছাত্র নেতৃত্বের দুই সংগঠন জাতীয় নাগরিক কমিটি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সূত্র বলছে, কমিটি কেন্দ্র করে ছাত্র নেতৃত্ব চারটি বলয়ে বিভক্ত। একটি বলয়ে রয়েছেন গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তি থেকে আসা নেতারা। আরেকটিতে রয়েছেন ইসলামী ছাত্রশিবির ও বিভিন্ন ইসলামী দলের ছাত্র সংগঠনের সাবেক নেতারা। বাম ছাত্র সংগঠনগুলো থেকে আসা নেতা এবং গণঅধিকার পরিষদ ও এবি পার্টি থেকে আসা নেতাকর্মীরা অপর দুই বলয়ে। এক বলয়ের সঙ্গে নানা ইস্যুতে আরেক বলয়ের দূরত্ব তৈরি হয়েছে। রাজনৈতিক দলে চার বলয়ের নেতারাই শীর্ষ নেতৃত্বে থাকতে চান। শিবির-সংশ্লিষ্টতার কারণে সংগঠনটির সাবেক নেতাদের নেতৃত্ব থেকে বাদ দেওয়া হচ্ছে-এ অভিযোগে বিরোধও তৈরি হয়েছে।
যদিও বিবদমান সব পক্ষের ভাষ্য, আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের সুযোগ রয়েছে। দল গঠনের আগেই ভাঙন বা একাধিক দল গঠনের যে আশঙ্কা ছিল নিজেদের মধ্যে আলোচনায় অনেকটাই কেটেছে। নেতৃত্বে কারা আসছেন তা ঠিক করতে না পারলে ২৪ ফেব্রুয়ারি নতুন দলের ঘোষণা নাও আসতে পারে। সে ক্ষেত্রে পেছাতে পারে দলের আত্মপ্রকাশ।
নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক মুহাম্মদ নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী গণমাধ্যমকে বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেক বক্তব্য আসছে, এগুলো চূড়ান্ত নয়। একেকজন একেকজনের পক্ষে প্রচার চালাচ্ছেন, তা চালাতে পারেন। একেকজন একেকজনকে চাচ্ছে। এটা তো ভালো। আমরা সবার সঙ্গে কথা বলছি। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে যিনি দায়িত্ব নিতে পারেন, এমন কাউকে খুঁজছি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সাবেক সমাজকল্যাণ সম্পাদক আখতার হোসেনের নেতৃত্বে ২০২৩ সালের অক্টোবরে গঠিত হয়েছিল ছাত্রশক্তি। এ সংগঠনের নেতারা হাসিনার পতন ঘটানো বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মূল নেতৃত্বে ছিলেন। উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম ছিলেন ছাত্রশক্তির সদস্য সচিব। আরেক উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার আহ্বায়ক।
আখতার বর্তমানে নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব। নাগরিক কমিটি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অনেক নেতা সামাজিক মাধ্যমে লেখেন, তারা আখতারের অনুসারী। তাঁর হাত ধরে রাজনীতিতে এসেছেন। আখতারকে নতুন দল থেকে বাদ দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে বলে অভিযোগ তাদের। আখতারকে সদস্য সচিব করার দাবি জানান তাঁর অনুসারীরা। যদিও এ বিষয়ে নীরব রয়েছেন আখতার। কেউ কেউ অভিযোগ করেন, উপদেষ্টা মাহফুজ আলম কোণঠাসা করছেন আখতারকে। তবে নাগরিক কমিটির একজন সদস্য বলেছেন, শিবিরের সাবেক নেতারা যুগ্ম আহ্বায়ক আলী আহসান জুনায়েদকে নতুন দলের সদস্য সচিব হিসেবে চাইছেন। এ চাপের পাল্টা কৌশল হিসেবে সদস্য সচিব হিসেবে আখতারের নাম সামনে আনা হয়েছে। সদস্য সচিব হিসেবে নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক মুহাম্মদ নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী, মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহর নাম আলোচনায় রয়েছে।
আওয়ামী লীগের কর্তৃত্ববাদী শাসন উৎখাতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্ল্যাটফর্মে গত জুলাইয়ে বিভিন্ন দল ও সংগঠনের নেতারা এক হয়েছিলেন। অভ্যুত্থানে সামনে এবং পর্দার আড়ালে থাকা তরুণ ছাত্রনেতাদের নিয়ে দল গঠনে সেপ্টেম্বরে গঠিত হয় নাগরিক কমিটি নামের প্ল্যাটফর্ম। সম্প্রতি জাতীয় নাগরিক কমিটির কার্যালয়ে সংগঠনটির কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সভায় ১৮৮ সদস্যের ১১৫ জন যোগ দেন। সভায় সিদ্ধান্ত হয়, দল গঠনের ৭৫ সদস্যের ‘প্রিপারেটরি কমিটি’ গঠন করা হবে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন অনুরূপ কমিটি করবে। দুই কমিটি সমন্বয় করে দলের কাঠামো, পদসংখ্যা নির্ধারণ করবে। অধিক সংখ্যক নেতাকে জায়গা করে দিতে মুখপাত্র, মুখ্য সংগঠকের পদ বৃদ্ধির বিষয়েও আলোচনা হয়। সভায় ছিলেন না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি আলী আহসান জুনায়েদ। তিনি নাগরিক কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক। ছিলেন না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিবিরের আরেক সাবেক সভাপতি রাফে সালমান রিফাত। তিনি নাগরিক কমিটির যুগ্ম সদস্য সচিব।
অসুস্থতার কারণে জুনায়েদ সভায় উপস্থিত হতে পারেননি বলে জানানো হয়। শিবির বলয়ের নেতারা তাঁকে নতুন সদস্য সচিব হিসেবে চাইছেন বলে জানা গেলেও এ বিষয়ে তাঁর বক্তব্য জানতে পারেনি। আখতারকে বাদ দেওয়ার চেষ্টা চলছে অনুসারীদের এ প্রচারের জবাবে ফেসবুকে রাফে সালমান লিখেন, ‘আখতারকে মাইনাস করছে কে নাহিদ, নাকি মাহফুজ? কোথা থেকে মাইনাস করছে? দলে নেবে না? সহমুখপাত্র মুহাম্মদ হিযবুল্লাহও ছিলেন না সেই সাধারণ সভায়। তিনিও শিবিরের সাবেক নেতা। যিনি কয়েক দিন ধরেই সামাজিক মাধ্যমে অভিযোগ করছেন, শিবিরের সাবেক নেতাদের কোণঠাসা করা হচ্ছে। তাঁর ভাষ্য, আওয়ামী লীগ আমলে যেভাবে শিবির ‘ট্যাগ’ দিয়ে নিপীড়নকে বৈধতা দেওয়া হতো, তা এখনও অব্যাহত রয়েছে। যা চলতে দেওয়া হবে না।
ইসলামী ঐক্যজোট থেকে অভ্যুত্থানে আসা আশরাফ মাহাদি নাগরিক কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক। তিনিও সভায় ছিলেন না। ঢাকার বাইরে থাকায় সভায় যেতে পারেননি জানিয়ে আশরাফ মাহাদি বলেছেন, অভ্যুত্থানে সব পক্ষের এবং মতের মানুষ অংশ নিয়েছিলেন। কে সাবেক শিবির, কে সাবেক ছাত্রশক্তি, কে সাবেক বাম এই ট্যাগ দেওয়া অন্যায্য। এর বিরুদ্ধেই তো অভ্যুত্থান হয়েছে। চাইলে জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্য সচিব পদে রেখে অভ্যুত্থানে যারা ছিলেন, তাদের ভূমিকাকে মূল্যায়ন করা যায়। প্রিপারেটরি কমিটিতে এ প্রস্তাব থাকবে।
শীর্ষ পদ নিয়ে বিরোধ নেই বলে দাবি করলেও আশরাফ মাহাদি বলেছেন, কিছু সিদ্ধান্ত সঠিকভাবে গ্রহণ করা হচ্ছে না। সব অংশীজনকে নিয়েই সিদ্ধান্ত গ্রহণের কথা ছিল। তা হচ্ছে কিনা, এ নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হচ্ছে। সিদ্ধান্ত গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় হচ্ছে কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হচ্ছে। নাহিদ ইসলাম আহ্বায়ক হবেন এতে কেউ আপত্তি করেননি। আখতার হোসেনকে সদস্য সচিব করা হলেও আপত্তি থাকবে না। কিন্তু প্রক্রিয়া গণতান্ত্রিক হতে হবে। অতীতে কে কোথায় ছিলেন, এ পরিচয় এনে কাউকে অযোগ্য করা যাবে না।
নেতৃত্বে কারা আসছেন এবং নেতৃত্ব নিয়ে বিরোধ প্রসঙ্গে এক প্রশ্নে নাগরিক কমিটির মুখপাত্র সামান্তা শারমিন গণমাধ্যমকে বলেন, অভ্যন্তরীণ বিরোধ নেই। সবাই যার মতামত দিচ্ছেন। দলের নাম, আদর্শ, গঠনতন্ত্র কী হবে তাও এখন ঠিক হয়নি। সারাদেশ থেকে জনমত জরিপে দুই লাখের বেশি মানুষের কাছ থেকে এসব বিষয়ে মতামত নেওয়া হচ্ছে। এ প্রক্রিয়ায় নেতৃত্ব ঠিক হবে। মানুষ খুব আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছে। ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহের মধ্যে দলের ঘোষণা দিতে জনগণের মতামত নিয়ে খুব দ্রুত কাজ করা হচ্ছে।
নাহিদ ইসলাম উপদেষ্টা পদ ছেড়ে নতুন দলে নেতৃত্ব দেবেন এমনটা শোনা গেলেও তা এখনও নিশ্চিত নয় বলে জানিয়েছে নাগরিক কমিটির সূত্র। একাধিক নেতা বলেছেন, সরকারে থাকার সুবাদে নাহিদ ইতোমধ্যে পরিচিত মুখ হয়ে উঠেছেন। যোগ না দিলেও তিনি দলের সম্পদই থাকবেন। দল গঠনের আগের দিন পদত্যাগ করে এসে নেতৃত্ব গ্রহণও নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য হবে না। তাহলে দলকে কিংস পার্টির তকমা নিতে হবে। ঐ সভায় নাহিদ ইসলামের স্ত্রী ফাতেমা তুজ জোহরা ছিলেন। তিনি নাগরিক কমিটির সদস্য।
এমটি/ এএটি