ঢাকা ১০:৫০ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ০৪ নভেম্বর ২০২৫

জাতীয় নির্বাচন নিয়ে বাড়ছে শঙ্কা

হালিম মোহাম্মদ
  • আপডেট সময় : ৮৫ বার পড়া হয়েছে
দৈনিক গনমুক্তি অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর দেশে পরিবর্তনের যে হাওয়া বইছিল, সম্প্রতি জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের চূড়ান্ত হওয়া জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে তৈরি হওয়া মতবিরোধ সেই পরিবেশকে নতুন করে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে।
বিএনপি বলছে, জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের আদেশ জারির এখতিয়ার সংবিধান অনুযায়ী অন্তর্বর্তী সরকারের নেই। একইসঙ্গে জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোটকে অযৌক্তিক বলছে দলটি। তাই জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট কোনোভাবেই মেনে নেবে না তারা। অন্যদিকে জামায়াত বলছে, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ জারির পর জাতীয় নির্বাচনের আগেই গণভোট আয়োজন করতে হবে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে এনসিপির আইনি ভিত্তি’ নিশ্চিত করার কঠোর অবস্থান। আর সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, গণভোট কবে হবে সে বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা অল্প সময়ের মধ্যে সিদ্ধান্ত জানাবেন। এবিষয়ে কোনো ক্রমেই সমঝোতার পথের সুমতি দেখা যাচ্ছে না।
এদিকে জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া ও গণভোটের সময়সূচি নিয়ে প্রধান দুটি দল বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী বিপরীত মেরুতে অবস্থান নেয়ার ফলে আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে শঙ্কা। ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশ এবং দলগুলোর বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়া দেশের রাজনৈতিক গতিপথকে অনিশ্চিতের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এতে জাতির জন্য সুফল বয়ে আনবে না।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গত ২৮ অক্টোবর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫’-এর খসড়ার চূড়ান্ত সুপারিশমালা জমা দিয়েছে। এই সনদে মৌলিকভাবে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর সংস্কার, ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা এবং জনগণের মৌলিক অধিকার সুরক্ষার জন্য বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে সনদ বাস্তবায়নে জনগণের সরাসরি সম্মতি নিতে একটি সাংবিধানিক গণভোটের আয়োজনের কথা বলা হয়েছে। শুধু তাই নয়, কমিশন তাদের সুপারিশে আরও বলেছে, ‘ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ একইসঙ্গে সংবিধান সংস্কার পরিষদ ও জাতীয় সংসদ হিসেবে কার্যকর থাকবে। তবে সংবিধান সংস্কার পরিষদ কার্যকর থাকবে ২৭০ দিন।
এ বিষয়ে বিকল্প প্রস্তাবে কমিশন বলেছে, যদি সংবিধান সংস্কার পরিষদ ২৭০ দিনের মধ্যে তাদের দায়িত্ব সম্পাদন করতে না পারে, তাহলে গণভোটে পাস হওয়া বিল স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে প্রতিস্থাপিত হবে। ঐকমত্য কমিশন ২০২৬ সালের জাতীয় নির্বাচনের দিন বা এর আগের যে কোনো দিন গণভোট আয়োজনের জন্য সুপারিশ করেছে।
কমিশনের সুপারিশমালা প্রকাশের পর প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বিএনপি বলছে, জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে ঐকমত্য কমিশনের দেয়া সুপারিশে জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) চাওয়া প্রতিফলিত হয়েছে। দলটির অভিমত, বিএনপি সবচেয়ে বড় স্টেকহোল্ডার (অংশীজন) হওয়া সত্ত্বেও কমিশনের সুপারিশে তাদের মতামত উপেক্ষা করা হয়েছে। বিশেষ করে বিএনপির নোট অব ডিসেন্ট (ভিন্নমত)’ সনদে লিপিবদ্ধ করার প্রতিশ্রুতি দেয়া হলেও তা রাখা হয়নি। এতে বিএনপি বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ।
এবিষয়ে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এক সংবাদ সম্মেলনে কমিশনের সুপারিশমালাকে একপেশে’ এবং জাতির ওপর চাপিয়ে দেয়া’ বলে মন্তব্য করেছেন। সনদ প্রণয়নের সময় যে বিষয়গুলোতে বিএনপির নোট অব ডিসেন্ট’ (ভিন্নমত) ছিল, সেই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো কমিশনের চূড়ান্ত সুপারিশে পুরোপুরি উপেক্ষা করাকে তিনি সুক্ষ্ম প্রতারণা বলেও উল্লেখ করেন।
মির্জা ফখরুল বলেন, জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোটের আয়োজন করা অযৌক্তিক ও অবিবেচনাপ্রসূত’। বিএনপি মনে করে, সময়, অর্থ ও প্রশাসনিক ব্যয় কমাতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনই জুলাই সনদ বাস্তবায়নে গণভোট আয়োজন করা সবচেয়ে যৌক্তিক। তিনি আরও জানান, জুলাই সনদ বাস্তবায়নে প্রয়োজনে বিএনপি তাদের আপত্তিসহ নির্বাচনের দিন গণভোটের দাবির বিষয়টি নিয়ে সরাসরি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে যাবে। জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট বিএনপি কোনোভাবেই মেনে নেবে না।
অন্যদিকে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী কমিশনের সুপারিশকে ইতিবাচকভাবে দেখলেও গণভোটের সময়সূচি নিয়ে বিএনপির সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থানে রয়েছে। জামায়াত মনে করে, একই দিনে জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট হলে রাজনৈতিক নেতারা নিজ নিজ দলের প্রার্থীর জয় নিয়ে ব্যস্ত থাকবেন এবং এর ফলে গণভোটের গুরুত্ব কমে যাবে। একইসঙ্গে তারা বলছে, জুলাই সনদে বিদ্যমান রাষ্ট্রকাঠামোর যে সংস্কারের কথা রয়েছে, সেই সম্পর্কে জনগণকে জানাতেই নির্বাচনের আগে গণভোট হওয়া আবশ্যক।
এ বিষয়ে জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, জাতীয় নির্বাচন কোনো কারণে না-ও হতে পারে, কিন্তু জুলাই সনদ একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল। এটা সবার আগে হতে হবে। তিনি বলেন, জুলাই সনদ এতই গুরুত্বপূর্ণ যে কিছু ফান্ড খরচ করে হলেও গণভোটের মাধ্যমে এটা বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট হবে–এটিই যথার্থ বলে আমরা মনে করি।
এবিষয়ে জামায়াতের আইন বিষয়ক উপদেষ্টা শিশির মনির বলেন, জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দিতে হলে গণভোট অত্যাবশ্যক। তিনি এ-ও মনে করেন, অতীতে আদেশ জারির ২১ দিনের মধ্যেই গণভোট হয়েছে। তিনি জোর দিয়ে বলেন, ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচনের কথা মাথায় রেখে এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত হবে না, যা নির্বাচনকে সংশয় বা অনিশ্চয়তার’ মধ্যে ফেলে দেয়।
সনদ বাস্তবায়নের রূপরেখা নিয়ে অন্য দুই দলের চেয়ে ভিন্ন ধরনের অবস্থানে রয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। দলটি সনদে স্বাক্ষর না করলেও কমিশনের সুপারিশকে কয়েকটি বিষয়ে ইতিবাচকভাবে দেখছে। এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেন, জুলাই সনদ কোনো রাজনৈতিক সমঝোতার ফাঁকা বুলি নয়, এর অবশ্যই আইনি ভিত্তি থাকতে হবে। সনদ বাস্তবায়নের আইনি ভিত্তি সম্পন্ন আদেশের খসড়া সরকার গ্রহণ না করা পর্যন্ত তারা সনদে স্বাক্ষর করবে না। গণভোট আগে নাকি জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে হবে, সেই বিকতর্ককে বিএনপি-জামায়াতের মতবিরোধ নিয়ে এনসিপির এ নেতা বলেন, এই তর্ক সৃষ্টি করে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত করা যাবে না। এমন তর্ক যারা করছে তারা ফ্যাসিবাদকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছেন।
ঐকমত্য কমিশনের বিষয়ে এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক বলেন, এতদিন এটা সালাহউদ্দিন কমিশন ছিল, এখন ঐকমত্য কমিশন মেরুদ- ফিরে পেয়েছে। তার দাবি, সালাহউদ্দিন কমিশনে দেশকে ভিন্নখাতে নেয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল, এনসিপি সঠিক পথে নিয়ে এসেছে। এনসিপি কমিশনের সুপারিশে গণভোটের ক্ষেত্রে ভিন্নমতের (নোট অব ডিসেন্ট) কার্যকারিতা না রাখা এবং পুরো সনদকে হ্যাঁ’/না’ ফরম্যাটে গণভোটে দেয়ার বিষয়টিকে ইতিবাচকভাবে দেখছে। এনসিপি স্পষ্ট জানিয়েছে, সনদের ওপর গণভোটের ম্যান্ডেট বাস্তবায়নে বাধ্যবাধকতা তৈরির লক্ষ্যে সরকার কবে এবং কীভাবে পদক্ষেপ নেয়, তা দেখার পরই তারা সনদে স্বাক্ষরের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।
এদিকে রাজনৈতিক দলগুলোর বর্তমান অবস্থান নিয়ে গভীর হতাশা প্রকাশ করেছেন আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল। তিনি বলেন, এত আলোচনার পরও রাজনৈতিক দলগুলো যেভাবে মতবিরোধ দেখাচ্ছে, এটা হতাশাজনক। জুলাই স্পিরিটকে ওনারা কোথায় নিয়ে গেছেন, সেটা তাদের বিবেচনা করা উচিত। তবে তিনি নিশ্চিত করেন, যে যা-ই বলুক, আমরা ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধেই নির্বাচন করব, আমরা বদ্ধপরিকর। জুলাই সনদ বাস্তবায়নের সময়সীমা নিয়ে তিনি বলেন, সনদে উল্লিখিত ২৭৮ দিনের মধ্যে স্বয়ংক্রিয় বাস্তবায়ন আদৌ সম্ভব কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তিনি জানান, ৩০ অক্টোবর উপদেষ্টা পরিষদে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ নিয়ে প্রাথমিক আলোচনা হয়েছে এবং দ্রুত এ নিয়ে সিদ্ধান্ত আসবে। আইন উপদেষ্টা আরও উল্লেখ করেন, জুলাই জাতীয় সনদ কীভাবে বাস্তবায়ন হবে, কিংবা গণভোট কবে হবে, সে সিদ্ধান্ত নেবেন প্রধান উপদেষ্টা। সেই সিদ্ধান্তে সরকার অটল থাকবে। তিনি আশা করেন, অতি দ্রুত প্রধান উপদেষ্টা সেই সিদ্ধান্ত দেবেন।
জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি ও গণভোটের সময় নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে তীব্র মতপার্থক্য তৈরি হয়েছে, তা দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে গভীর উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। এই মতবিরোধ থেকে দ্রুত বেরিয়ে আসতে না পারলে সনদ বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া এবং আসন্ন জাতীয় নির্বাচন দুটোই সংশয়ের মুখে পড়তে পারে বলে মনে করেন দেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা।
তারা বলছেন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মূল উদ্দেশ্যই ছিল একটি সংস্কারভিত্তিক ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করা। সেই ঐকমত্য যদি সনদ বাস্তবায়নের মতো মৌলিক প্রশ্নে ভেঙে যায়, তবে তা কেবল সনদের ভাগ্যকেই অনিশ্চিত করবে না। বরং জাতীয় নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা ও সময়সূচিকেও প্রভাবিত করতে পারে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক জাহেদ উর রহমান এক নিবন্ধে লিখেছেন, এই মুহূর্তে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের যে পদ্ধতি প্রস্তাবিত হয়েছে, তা গ্রহণ করা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উচিত হবে না। তিনি মনে করেন, এভাবে সনদ বাস্তবায়ন করতে গেলে উদ্ভূত পরিস্থিতি জাতীয় নির্বাচনকেই অনিশ্চিত করে তুলবে। রাজনৈতিক দলগুলোর এই বিপরীতমুখী অবস্থান জাতীয় ঐকমত্য এবং নির্ধারিত সময়ে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের ওপর কী প্রভাব ফেলবে, সেদিকেই এখন সবার দৃষ্টি। তা ছাড়া অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা এই পরিস্থিতি সমাধানে কী ধরনের উদ্যোগ নেন, সেটাও এখন দেখার বিষয়।

নিউজটি শেয়ার করুন

ট্যাগস :

জাতীয় নির্বাচন নিয়ে বাড়ছে শঙ্কা

আপডেট সময় :

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর দেশে পরিবর্তনের যে হাওয়া বইছিল, সম্প্রতি জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের চূড়ান্ত হওয়া জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে তৈরি হওয়া মতবিরোধ সেই পরিবেশকে নতুন করে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে।
বিএনপি বলছে, জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের আদেশ জারির এখতিয়ার সংবিধান অনুযায়ী অন্তর্বর্তী সরকারের নেই। একইসঙ্গে জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোটকে অযৌক্তিক বলছে দলটি। তাই জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট কোনোভাবেই মেনে নেবে না তারা। অন্যদিকে জামায়াত বলছে, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ জারির পর জাতীয় নির্বাচনের আগেই গণভোট আয়োজন করতে হবে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে এনসিপির আইনি ভিত্তি’ নিশ্চিত করার কঠোর অবস্থান। আর সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, গণভোট কবে হবে সে বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা অল্প সময়ের মধ্যে সিদ্ধান্ত জানাবেন। এবিষয়ে কোনো ক্রমেই সমঝোতার পথের সুমতি দেখা যাচ্ছে না।
এদিকে জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া ও গণভোটের সময়সূচি নিয়ে প্রধান দুটি দল বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী বিপরীত মেরুতে অবস্থান নেয়ার ফলে আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে শঙ্কা। ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশ এবং দলগুলোর বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়া দেশের রাজনৈতিক গতিপথকে অনিশ্চিতের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এতে জাতির জন্য সুফল বয়ে আনবে না।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গত ২৮ অক্টোবর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫’-এর খসড়ার চূড়ান্ত সুপারিশমালা জমা দিয়েছে। এই সনদে মৌলিকভাবে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর সংস্কার, ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা এবং জনগণের মৌলিক অধিকার সুরক্ষার জন্য বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে সনদ বাস্তবায়নে জনগণের সরাসরি সম্মতি নিতে একটি সাংবিধানিক গণভোটের আয়োজনের কথা বলা হয়েছে। শুধু তাই নয়, কমিশন তাদের সুপারিশে আরও বলেছে, ‘ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ একইসঙ্গে সংবিধান সংস্কার পরিষদ ও জাতীয় সংসদ হিসেবে কার্যকর থাকবে। তবে সংবিধান সংস্কার পরিষদ কার্যকর থাকবে ২৭০ দিন।
এ বিষয়ে বিকল্প প্রস্তাবে কমিশন বলেছে, যদি সংবিধান সংস্কার পরিষদ ২৭০ দিনের মধ্যে তাদের দায়িত্ব সম্পাদন করতে না পারে, তাহলে গণভোটে পাস হওয়া বিল স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে প্রতিস্থাপিত হবে। ঐকমত্য কমিশন ২০২৬ সালের জাতীয় নির্বাচনের দিন বা এর আগের যে কোনো দিন গণভোট আয়োজনের জন্য সুপারিশ করেছে।
কমিশনের সুপারিশমালা প্রকাশের পর প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বিএনপি বলছে, জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে ঐকমত্য কমিশনের দেয়া সুপারিশে জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) চাওয়া প্রতিফলিত হয়েছে। দলটির অভিমত, বিএনপি সবচেয়ে বড় স্টেকহোল্ডার (অংশীজন) হওয়া সত্ত্বেও কমিশনের সুপারিশে তাদের মতামত উপেক্ষা করা হয়েছে। বিশেষ করে বিএনপির নোট অব ডিসেন্ট (ভিন্নমত)’ সনদে লিপিবদ্ধ করার প্রতিশ্রুতি দেয়া হলেও তা রাখা হয়নি। এতে বিএনপি বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ।
এবিষয়ে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এক সংবাদ সম্মেলনে কমিশনের সুপারিশমালাকে একপেশে’ এবং জাতির ওপর চাপিয়ে দেয়া’ বলে মন্তব্য করেছেন। সনদ প্রণয়নের সময় যে বিষয়গুলোতে বিএনপির নোট অব ডিসেন্ট’ (ভিন্নমত) ছিল, সেই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো কমিশনের চূড়ান্ত সুপারিশে পুরোপুরি উপেক্ষা করাকে তিনি সুক্ষ্ম প্রতারণা বলেও উল্লেখ করেন।
মির্জা ফখরুল বলেন, জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোটের আয়োজন করা অযৌক্তিক ও অবিবেচনাপ্রসূত’। বিএনপি মনে করে, সময়, অর্থ ও প্রশাসনিক ব্যয় কমাতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনই জুলাই সনদ বাস্তবায়নে গণভোট আয়োজন করা সবচেয়ে যৌক্তিক। তিনি আরও জানান, জুলাই সনদ বাস্তবায়নে প্রয়োজনে বিএনপি তাদের আপত্তিসহ নির্বাচনের দিন গণভোটের দাবির বিষয়টি নিয়ে সরাসরি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে যাবে। জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট বিএনপি কোনোভাবেই মেনে নেবে না।
অন্যদিকে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী কমিশনের সুপারিশকে ইতিবাচকভাবে দেখলেও গণভোটের সময়সূচি নিয়ে বিএনপির সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থানে রয়েছে। জামায়াত মনে করে, একই দিনে জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট হলে রাজনৈতিক নেতারা নিজ নিজ দলের প্রার্থীর জয় নিয়ে ব্যস্ত থাকবেন এবং এর ফলে গণভোটের গুরুত্ব কমে যাবে। একইসঙ্গে তারা বলছে, জুলাই সনদে বিদ্যমান রাষ্ট্রকাঠামোর যে সংস্কারের কথা রয়েছে, সেই সম্পর্কে জনগণকে জানাতেই নির্বাচনের আগে গণভোট হওয়া আবশ্যক।
এ বিষয়ে জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, জাতীয় নির্বাচন কোনো কারণে না-ও হতে পারে, কিন্তু জুলাই সনদ একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল। এটা সবার আগে হতে হবে। তিনি বলেন, জুলাই সনদ এতই গুরুত্বপূর্ণ যে কিছু ফান্ড খরচ করে হলেও গণভোটের মাধ্যমে এটা বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট হবে–এটিই যথার্থ বলে আমরা মনে করি।
এবিষয়ে জামায়াতের আইন বিষয়ক উপদেষ্টা শিশির মনির বলেন, জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দিতে হলে গণভোট অত্যাবশ্যক। তিনি এ-ও মনে করেন, অতীতে আদেশ জারির ২১ দিনের মধ্যেই গণভোট হয়েছে। তিনি জোর দিয়ে বলেন, ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচনের কথা মাথায় রেখে এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত হবে না, যা নির্বাচনকে সংশয় বা অনিশ্চয়তার’ মধ্যে ফেলে দেয়।
সনদ বাস্তবায়নের রূপরেখা নিয়ে অন্য দুই দলের চেয়ে ভিন্ন ধরনের অবস্থানে রয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। দলটি সনদে স্বাক্ষর না করলেও কমিশনের সুপারিশকে কয়েকটি বিষয়ে ইতিবাচকভাবে দেখছে। এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেন, জুলাই সনদ কোনো রাজনৈতিক সমঝোতার ফাঁকা বুলি নয়, এর অবশ্যই আইনি ভিত্তি থাকতে হবে। সনদ বাস্তবায়নের আইনি ভিত্তি সম্পন্ন আদেশের খসড়া সরকার গ্রহণ না করা পর্যন্ত তারা সনদে স্বাক্ষর করবে না। গণভোট আগে নাকি জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে হবে, সেই বিকতর্ককে বিএনপি-জামায়াতের মতবিরোধ নিয়ে এনসিপির এ নেতা বলেন, এই তর্ক সৃষ্টি করে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত করা যাবে না। এমন তর্ক যারা করছে তারা ফ্যাসিবাদকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছেন।
ঐকমত্য কমিশনের বিষয়ে এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক বলেন, এতদিন এটা সালাহউদ্দিন কমিশন ছিল, এখন ঐকমত্য কমিশন মেরুদ- ফিরে পেয়েছে। তার দাবি, সালাহউদ্দিন কমিশনে দেশকে ভিন্নখাতে নেয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল, এনসিপি সঠিক পথে নিয়ে এসেছে। এনসিপি কমিশনের সুপারিশে গণভোটের ক্ষেত্রে ভিন্নমতের (নোট অব ডিসেন্ট) কার্যকারিতা না রাখা এবং পুরো সনদকে হ্যাঁ’/না’ ফরম্যাটে গণভোটে দেয়ার বিষয়টিকে ইতিবাচকভাবে দেখছে। এনসিপি স্পষ্ট জানিয়েছে, সনদের ওপর গণভোটের ম্যান্ডেট বাস্তবায়নে বাধ্যবাধকতা তৈরির লক্ষ্যে সরকার কবে এবং কীভাবে পদক্ষেপ নেয়, তা দেখার পরই তারা সনদে স্বাক্ষরের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।
এদিকে রাজনৈতিক দলগুলোর বর্তমান অবস্থান নিয়ে গভীর হতাশা প্রকাশ করেছেন আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল। তিনি বলেন, এত আলোচনার পরও রাজনৈতিক দলগুলো যেভাবে মতবিরোধ দেখাচ্ছে, এটা হতাশাজনক। জুলাই স্পিরিটকে ওনারা কোথায় নিয়ে গেছেন, সেটা তাদের বিবেচনা করা উচিত। তবে তিনি নিশ্চিত করেন, যে যা-ই বলুক, আমরা ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধেই নির্বাচন করব, আমরা বদ্ধপরিকর। জুলাই সনদ বাস্তবায়নের সময়সীমা নিয়ে তিনি বলেন, সনদে উল্লিখিত ২৭৮ দিনের মধ্যে স্বয়ংক্রিয় বাস্তবায়ন আদৌ সম্ভব কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তিনি জানান, ৩০ অক্টোবর উপদেষ্টা পরিষদে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ নিয়ে প্রাথমিক আলোচনা হয়েছে এবং দ্রুত এ নিয়ে সিদ্ধান্ত আসবে। আইন উপদেষ্টা আরও উল্লেখ করেন, জুলাই জাতীয় সনদ কীভাবে বাস্তবায়ন হবে, কিংবা গণভোট কবে হবে, সে সিদ্ধান্ত নেবেন প্রধান উপদেষ্টা। সেই সিদ্ধান্তে সরকার অটল থাকবে। তিনি আশা করেন, অতি দ্রুত প্রধান উপদেষ্টা সেই সিদ্ধান্ত দেবেন।
জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি ও গণভোটের সময় নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে তীব্র মতপার্থক্য তৈরি হয়েছে, তা দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে গভীর উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। এই মতবিরোধ থেকে দ্রুত বেরিয়ে আসতে না পারলে সনদ বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া এবং আসন্ন জাতীয় নির্বাচন দুটোই সংশয়ের মুখে পড়তে পারে বলে মনে করেন দেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা।
তারা বলছেন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মূল উদ্দেশ্যই ছিল একটি সংস্কারভিত্তিক ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করা। সেই ঐকমত্য যদি সনদ বাস্তবায়নের মতো মৌলিক প্রশ্নে ভেঙে যায়, তবে তা কেবল সনদের ভাগ্যকেই অনিশ্চিত করবে না। বরং জাতীয় নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা ও সময়সূচিকেও প্রভাবিত করতে পারে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক জাহেদ উর রহমান এক নিবন্ধে লিখেছেন, এই মুহূর্তে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের যে পদ্ধতি প্রস্তাবিত হয়েছে, তা গ্রহণ করা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উচিত হবে না। তিনি মনে করেন, এভাবে সনদ বাস্তবায়ন করতে গেলে উদ্ভূত পরিস্থিতি জাতীয় নির্বাচনকেই অনিশ্চিত করে তুলবে। রাজনৈতিক দলগুলোর এই বিপরীতমুখী অবস্থান জাতীয় ঐকমত্য এবং নির্ধারিত সময়ে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের ওপর কী প্রভাব ফেলবে, সেদিকেই এখন সবার দৃষ্টি। তা ছাড়া অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা এই পরিস্থিতি সমাধানে কী ধরনের উদ্যোগ নেন, সেটাও এখন দেখার বিষয়।