ডুবুরি সংকটে বাড়ছে মৃত্যু
- আপডেট সময় : ১৮৭ বার পড়া হয়েছে
নদীমাতৃক বাংলাদেশ। এদেশে পদ্মা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা নদীসহ অসংখ্য নদী, উপ-নদী ও শাখা নদী রয়েছে। এ ছাড়াও দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে হাওর রয়েছে এবং দেশের মোট আয়তনের দুই তৃতীয়াংশ বন্যা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। বছরের দুই থেকে পাঁচ মাস দেশের অধিকাংশ এলাকা পানির নিচে অবস্থান করে। নৌপথকে অন্যতম প্রধান যোগাযোগ ব্যবস্থা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সেই নৌপথে দুর্ঘটনা মোকাবেলা এবং প্রাণহানি কমাতে বা পানিতে ডুবে যাওয়া বিপদগ্রস্ত মানুষ উদ্ধারে নেই নিজস্ব ডুবুরি। ডুবুরি সংকটে তাৎক্ষনিক উদ্ধার কার্যক্রম ব্যঘাত ঘটায় বাড়ছে মৃত্যুর হার। শুধু তাই নয়, দেশের ফায়ার সার্ভিস সিভিল ডিফেন্স এর মধ্যে ডুবুরি সংকট রয়েছে। বিভাগীয় শাখা ছাড়া জেলার কোনো শাখা নিজস্ব ডুবুরি নেই। ডুবুরি সংকটে নৌ দুর্ঘটনায় মৃত্যুও সংখ্যা বেড়েই চলেছে।
জানা যায়, নৌ দুর্ঘটনায় গত ৫ বছরে দুই হাজারেরও বেশি মানুষ জীবন দিয়েছেন। ফলে এটি জাতীয় এবং আঞ্চলিক সমস্যায় পরিণত হয়েছে। তাছাড়া প্রতিবছর পুকুর, হাওর, ঝর্ণা এবং সমুদ্র সৈকতে পানিতে ডুবে মৃত্যুজনিত ঘটনা বাড়ছে। কিন্তু এসব দুর্ঘটনা মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের সক্ষমতার ঘাটতি রয়েছে। তাই প্রাকৃতিক দুর্যোগে উদ্ধার অভিযানে জরুরি সাড়া দেয়ার ক্ষেত্রে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের সক্ষমতা বাড়াতে উদ্ধার সহায়ক জিনিসপত্র সংগ্রহ জরুরি। এ ছাড়াও ডুবুরিদের পেশাগত দক্ষতা উন্নয়নের মাধ্যমে মূল্যবান জীবন ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি কমিনে আনা প্রয়োজন।
মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ায় ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সে নেই ডুবুরি দল। কোনো দুর্ঘটনায় উদ্ধার তৎপরতা চালাতে ডুবুরি দল আসে ঢাকা থেকে। এতে দুর্ঘটনায় জানমালের ক্ষয়ক্ষতি বেড়ে যায়। মুন্সিগঞ্জ জেলায় ৬টি উপজেলায় প্রতিটিতেই ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স স্টেশন রয়েছে। এর মধ্যে কোন স্টেশন ডুবুরি দল না থাকায় রাজধানী ঢাকার ফায়ার সার্ভিসের বিভাগীয় স্টেশনে খবর দিয়ে আনতে হয় ডুবুরি সদস্য। নদীতে টলার, মালবাহী জাহাজ, লঞ্চসহ শ্রমিক, শিশু ডুবে যাওয়ার ঘটনা ঘটলে ফায়ার সার্ভিস স্টেশনে ডুবুরি দল না থাকায় পরতে হয় বিপত্তিতে, ডুবুরির অপেক্ষা করতে হয় অনেক সময়।
গত বছর ইমামপুর ইউনিয়নে নৌকা পথে পিকনিক করতে যাওয়ার জন্য ভাড়া করা লঞ্চ নোঙ্গর করতে গিয়ে বিদ্যুৎ আইতো হয়ে এক কলেজ ছাত্র নদীতে তলিয়ে যায়। ঘটনার ১০ ঘণ্টা পর ঢাকা থেকে ডুবুরি দল এসে কলেজ ছাত্রের মরদেহ উদ্ধার করে। এছাড়া উপজেলার বালুয়াকান্দী ইউনিয়নের তেতৈতলা গ্রামের মো. কামাল উদ্দিনের কলেজ পড়ুয়া ছেলে ইমন হোসেন মেঘনা নদীতে ডুবে মারা যায়। তখনও ডুবুরি দল না থাকার এলাকার লোকজন উদ্ধার অভিযান চালিয়ে দেড় দুই ঘণ্টা পর তাকে উদ্ধার করে। গত ২৬ আগস্ট উপজেলার হোসেন্দী হোসেন্দী ইউনিয়নের হোসেন্দী গ্রামের কাজলী নদীতে গোসল করতে গেলে আনিসা আক্তার নামে এক মাদ্রাসা শিক্ষার্থীর পানিতে তলিয়ে যায়। ডুবুরি সংকটে অপেক্ষার পর স্থানীয়রা দেড় ঘণ্টার চেষ্টায় মরদেহ উদ্ধার করে। উপজেলার সচেতন মহল মনে করেন মুন্সিগঞ্জ জেলার সবকটি উপজেলায় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স স্টেশন রয়েছে। তবে এখানে নেই কোন ডুবুরি দল।
জানা যায়, জানুয়ারি মাসে বান্দরবানের থানচি উপজেলার নাফাখুমে পড়ে নিখোঁজ হওয়া আরিফুল হাসান ফাহিমের (২৭) লাশ উদ্ধার করতে ফায়ার সার্ভিসের একদিন অপেক্ষা করতে হয়েছে। নিহত ফাহিম রাজধানীর মিরপুরের ক্যান্টনমেন্ট এলাকার কচুক্ষেতের মো. হেদায়েত উল্লাহর ছেলে। ১৭ অক্টোবর সকালে তারা নাফাখুম বেড়াতে যায়। পথে আরিফুল হাসান ফাহিম পা পিছলে গভীর পানিতে পড়ে নিখোঁজ হন। একদিন পর তার লাশ পানিতে ভেসে উঠলে উদ্ধার করা হয়। এর আগে চটগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার ইছামতি নদীতে ডুবে যাওয়া যুবক মো. ইকবালকে (২২) উদ্ধারে বেগ পেতে হয়েছে ফায়ার সার্ভিসকে।
ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্সের স্টেশন কর্মকর্তা মো. রিফাত মল্লিক জানান, আমরা যে কোনো দুর্ঘটনার মোকাবিলার সবরকম সরঞ্জাম লোকবল রয়েছে। আমাদের উপজেলা ডুবুরি দল নেই এমন নয়, জেলা পর্যায়েও কোন স্টেশনে ডুবুরি দল নেই। এই জাতীয় পরিস্থিতিতে আমরা বিভাগীয় স্টেশনের উপর নির্ভর করতে হয়।
জানা যায়, শরিয়তপুরের গোসাইরহাট উপজেলার পুরাতন লঞ্চঘাট থেকে মাঝেরচর এলাকায় যাওয়ার সময় মেঘনা নদীতে ট্রলারডুবির ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় মা-মেয়েসহ দুজন ঘটনাস্থলেই নিহত ও ৩ জন নিখোঁজ হয়। এসময় দ্রুত খবর দেওয়া হয় ফায়ার সার্ভিসের লোকজনকে। তবে তাদের ডুবুরি না থাকায় পরবর্তীতে মাদারিপুর থেকে দুজন ডুবুরি এনে উদ্ধার কাজ শুরু করে। ততক্ষনে সব শেষ।
প্রতিটি জেলা ফায়ার সার্ভিস শাখায় বর্ষা মৌসুমের মুহূর্তে দুজন ডুবুরির খুবই প্রয়োজন। বিভিন্ন সময় পাশের জেলাগুলো থেকে ডুবুরি এনে উদ্ধার অভিযান চালাতে হয়। অনেক সময় দেখা যায় পাশের জেলাগুলোর ডুবুরিরা তাদের জেলার কাজে ব্যস্ত থাকেন তখন আমাদের ভোগান্তি আরও বেড়ে যায়। যদি আমাদের নিজস্ব ডুবুরি থাকতো তাহলে আমাদের কার্যক্রম আরও গতিশীল হতো। সেদিন জেলায় ডুবুরি দল থাকলে তারা এই উদ্ধার কাজ দ্রুত সময়ের মধ্যে শুরু করতে পারতো। এতে মরদেহগুলো দ্রুত সময়ের মধ্যে উদ্ধার করা সম্ভব হতো।
দুর্ঘটনার পর প্রথমেই ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দলকে এগিয়ে আসার কথা থাকলেও সেটি হয় না। জেলায় ডুবুরি না থাকায় পানিতে ডুবে যাওয়ার ঘটনায় ভুক্তভোগীদের জীবিত উদ্ধারে তাৎক্ষণিক উদ্ধার অভিযান চালানো যায় না। পাশের জেলা মাদারিপুর, ফরিদপুর ও বরিশাল থেকে ডুবুরি দল ধার করতে আনতে হয়। ফলে ডুবুরি আসতে আসতে পানিতে প্রাণ যায় ভুক্তভোগীদের। এছাড়া ডুবুরির অভাবে যথাসময়ে উদ্ধার অভিযান শুরু না হওয়ায় বেগ পেতে হয় মরদেহ উদ্ধারেও। এতে সময় অপচয়ের পাশাপাশি দীর্ঘ হয় উদ্ধার কার্যক্রম। যখন নৌকাডুবে দুর্ঘটনা ঘটে, অন্য জেলা থেকে ডুবুরি দল আনতে হয়। এতে পরে ডুবুরি দল মরদেহ খুঁজে পায় না। আমাদের অঞ্চল যেহেতু নদী এলাকায়, তাই ডুবুরি দলের খুবই প্রয়োজন।
ডুবুরি সংকট নিরসনে সম্প্রতি ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের ডুবুরি ইউনিটকে আরো সম্প্রসারণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। ইতোমধ্যে এই বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সে এখন মাত্র ২৫ জন ডুবুরি রয়েছে, যা প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই নগণ্য বলে জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা। কোথাও নৌকা ও লঞ্চডুবি হলে তখন আরো বেশি সমস্যায় পড়তে হয়। যে কারণে সরকার ১৬৫ কোটি ২০ লাখ টাকা ব্যয়ে ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি ইউনিটকে আরো সম্প্রসারণের উদ্যোগ নিয়েছে।
জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) সম্প্রতি এক বৈঠকে ‘ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স ডুবুরি ইউনিট সম্প্রসারণ নামে একটি প্রকল্পের অনুমোদন দিয়েছে। ১৬৫ কোটি ২০ লাখ টাকা ব্যয়ে সরকার এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে। জলভাগে ও নৌরুটে দুর্ঘটনা কবলিত ব্যক্তি ও যানের অবস্থান শনাক্ত করা এবং উদ্ধার কাজ পরিচালনায় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সক্ষমতা বাড়াতে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়াও আধুনিক উদ্ধার সরঞ্জাম ও প্রযুক্তির সঙ্গে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের ডুবুরিদের পরিচিত করা এবং আধুনিক উদ্ধার কৌশল প্রয়োগে পারদর্শী করা এবং যেকোনো দুর্ঘটনায় উন্নত সেবা দেওয়ার লক্ষ্যে এ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, চাঁদপুর, খুলনা, বরিশাল ও রংপুরে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এ লক্ষ্যে সরকার একটি স্যালভেজ ফায়ার ফাইটিং টাগ, সাতটি পন্টুন ও জেটি, ১৪টি হেভি ডিউটি রেসকিউ বোট, ১৪টি লাইট ডিউটি রেসকিউ বোট, সাতটি রেসকিউ ভেহিক্যাল, ৪২টি ডাইভিং অ্যাপারেটরস সেট, সাতটি এয়ার কমপ্রেসার মেশিন, সাতটি লাইট ট্রাক (রেসকিউ বোট পরিবহন), সাতটি পোর্টেবল ডি-কমপ্রেসার চেম্বার, একটি বিল্ড ভেহিক্যাল মাউন্টেড ডি-কমপ্রেসার চেম্বার এবং বিভিন্ন রেসকিউ সরঞ্জাম সংগ্রহ করবে। তাই ডুবুরির সংখ্যা বাড়ানো জরুরি।






















