দাবি আদায়ের নামে জনভোগান্তি

- আপডেট সময় : ১৩১ বার পড়া হয়েছে
আন্দোলন আর আন্দোলন। দাবি আদায়ের আন্দোলনের প্রথম পদক্ষেপ বিক্ষোভ মিছিল তার সঙ্গে সড়ক অবরোধ। গুটি কয়েক মানুষ হলেই মিছিল এবং সড়ক অবরোধ। তাও সড়কের মাঝখানে। অর্ন্তবতী সরকারের এক বছরের প্রায় প্রতিদিনই ব্যস্ততম রাজধানীর কোথাও না কোথাও রাস্তা অবরোধে আন্দোলন চলছে। বিশেষ করে রাজধানীর স্পর্শকাতর এলাকায় যেমন সচিবালয়ের আশপাশ, জাতীয় প্রেসক্লাব, শাহবাগ, মৎসভবন মোড়. হাইকোটের পাশে, মিন্টুরোডের পাশে হোটেল শেরাটনের মোড়ে সড়ক অবরোধ নিত্য দিনের। প্রায় গত এক বছরে রাস্তা অবরোধে আন্দোলনের ফলে রাজধানীর মানুষের ভোগান্তির শেষ নেই। তারা বিরক্ত আন্দোলনকারিদের বিরুদ্ধে। তারপরও আন্দোলন থেমে নেই।
সরকারী আমলারা বলছেন, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সরকারি কর্মচারী থেকে শুরু করে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের দীর্ঘদিনের বৈষম্য ও পুঞ্জীভূত ক্ষোভ যেন এক স্রোতে মিলিত হয়। নানা ধরনের যৌক্তিক-অযৌক্তিক দাবি নিয়ে মাঠে নামেন তারা। গত এক বছর রাজধানী ঢাকা পরিণত হয় দাবি আদায়ের নগরীতে। প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনা, সরকারের প্রশাসনিক কেন্দ্র সচিবালয়, শাহবাগ, জাতীয় প্রেস ক্লাব ছিল দাবি আদায়ের প্রধান কেন্দ্র। আর এসব এলাকার প্রভাব পড়ে পুরো রাজধানীতে। ক্ষণে ক্ষণে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয় মহানগরীতে।
এক হিসাবে দেখা গেছে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়ে শুধু রাজধানীতেই চার শতাধিক দাবিদাওয়ার আন্দোলন হয়েছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) হিসাবে, ঢাকায় গড়ে প্রতিদিন দুই বা ততোধিক আন্দোলন-বিক্ষোভ কর্মসূচি পালিত হয়। এসব কর্মসূচি সামলাতে বেগ পেতে হয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে। এজন্য কয়েক দফা বিজ্ঞপ্তি দিয়ে যমুনা ও সচিবালয়ের আশপাশের এলাকায় সভা সমাবেশ নিষিদ্ধ করতে হয়। সর্বপ্রথম ২০২৪ সালের ২৬ আগস্ট, চলতি বছরে ১৩ মার্চ, ১০ ও ২৬ মে, ৮ জুলাই এবং সর্বশেষ গত বুধবার ডিএমপি আবারও নতুন করে বিজ্ঞপ্তি জারি করে। তারপরও ডিএমপি আইন মানতে চাইছে না আন্দোলনকারিরা। এতে করে আইন শৃংখলা বাহিনীর সদস্যরাও বিরক্ত।
বিশেষজ্ঞদের মতে, যে কোনো বিপ্লব বা অভ্যুত্থান-পরবর্তী নতুন সরকার গঠিত হলে সেই সরকারের ভিত্তি দুর্বল থাকে, সরকারের সব ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ থাকে না। এ সুযোগে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ ও যৌক্তিক-অযৌক্তিক দাবি এবং অপ্রাপ্তিগুলো ফুঁসে ওঠে। ফলে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বৈষম্যের শিকার সবাই নিজের দাবি ও স্বার্থ আদায়ে বেপরোয়া হয়ে ওঠে। সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির এই দাবি জনভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। শুরুতে সরকারের যে কোনো দাবিদাওয়া মেনে নেওয়ার সংস্কৃতি এ ধরনের দাবির আন্দোলনকে উসকে দেয় বলেও মত বিশেজ্ঞদের।
ঘটনাক্রম পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত বছরের ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পরই বাংলাদেশ বেতার, টেলিভিশন, ওয়াসা, ডেসা, সচিবালয়, আধাসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তাদের দাবি নিয়ে কর্মসূচি পালন করেন। এরই মাঝে আন্দোলনের মাধ্যমে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার শিক্ষার্থীরা ছয়টি বিষয়ে পরীক্ষা বাতিল করে ফল আদায় করে নেয়। গত বছরের ২০ আগস্ট সচিবালয়ে ঢুকে শিক্ষা উপদেষ্টাকে ঘেরাও করে শিক্ষার্থীরা দাবি আদায় করে নেয়।
ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, আনসার থেকে চাকরিচ্যুত সদস্য, নিয়োগ বঞ্চিত বিসিএস ক্যাডার, পিলখানার ঘটনায় চাকরিচ্যুত সাবেক বিডিআর সদস্য, সাত কলেজ পৃথকীকরণ নিয়ে সাত কলেজের আন্দোলন, জুলাই অভ্যুত্থানে আহতদের চিকিৎসার আন্দোলন, পলিটেকনিক্যালের শিক্ষার্থীদের অবরোধ, ইন্টার্ন চিকিৎসকদের ভাতা বৃদ্ধির আন্দোলন, রেলসেবা বন্ধ করে কর্মচারীদের আন্দোলন, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের আন্দোলন, ডিপ্লোমা ইন নার্সিং এবং ডিপ্লোমা ইন মিডওয়াইফারি কোর্সকে স্নাতকের স্বীকৃতি, ৭০ শতাংশ আবাসন ভাতাসহ তিন দফা দাবিতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আন্দোলন অনুষ্ঠিত হয় রাজধানীতে।
এ ছাড়া ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়র পদ পেতে ইশরাক হোসেনের অনুসারীদের বিক্ষোভ, ছাত্রদল নেতা সাম্য হত্যার বিচারের দাবিতে শাহবাগ থানা ঘেরাও, চাকরি জাতীয়করণের দাবিতে শিক্ষকরা, বকেয়া বেতন ও ঈদ বোনাসের দাবিতে শ্রমিকদের বিক্ষোভ, হাইকোর্টের মাজার গেটে বিক্ষোভ, পলিটেকনিক কলেজ এবং কবি নজরুল কলেজের শিক্ষার্থীদের আবাসন সংকট দূর করার দাবিতে আন্দোলন চলে।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ বলেন, মানুষ যখন বুঝে গেছে দেশে আইনকানুন নেই, তখন সবাই এ সুযোগটাই কাজে লাগিয়েছে। বৈপ্লবিক পরিবর্তন হলে সরকারের এই দুর্বল মুহূর্তকে ব্যবহার করে সুযোগসন্ধানীরা দাবি আদায়ের পাঁয়তারা করে। আমাদের এখানেও এর বিকল্প হয়নি। যখন সরকার বুঝতে শুরু করেছে ততদিন দেরি হয়ে গেছে। রাজধানী তখন দাবি আদায়ের শহরে পরিণত হয়ে গেছে।