দায়িত্বহীনতা নাকি অন্যকিছু

- আপডেট সময় : ২৪১ বার পড়া হয়েছে
স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়ের অধীনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর দেশের প্রত্যন্ত হাওর ও নদী উপকূল এলাকাবাসীর স্বাস্থ্য সেবার জন্য উপজেলাগুলোতে নৌ অ্যাম্বুলেন্স বরাদ্ধ দেয়। ২০১৩ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত হাওর এবং উপকূল এলাকার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে প্রায় দুই শতাধিক নৌ অ্যাম্বুলেন্স পাঠানো হয়। এ সকল নৌ অ্যাম্বুলেন্স উপকুল এলাকার অসুস্থ রোগী হাসপাতাল বা ক্লিনিকে আনা নেয়ার জন্য পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু হাসপাতাল চিকিৎসক, সিভিল সার্জন এবং প্রশাসনের দায়িত্বহীনতায় এ সকল অ্যাম্বুলেন্স রোগী সেবা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। তা ছাড়া জ্বালানী খরচ বহন এবং চালক না থাকায় এ সকল নৌ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পাশে হাওর এবং নদীর পানিতে তীরে পাকিং অবস্থায় পড়ে থাকে দীর্ঘদিন। অযত্নে অবহেলায় বছরের পর বছর পড়ে থাকায় এ সকল নৌ অ্যাম্বুলেন্সের সরঞ্জামের নস্ট হয়ে পচন ধরেছে। দায়িত্বহীনতা এবং কর্তব্যের অবহেলায় সেবা বঞ্চিত হয়েছেন এলাকায় অসহায় দুঃস্থ রোগী। পাশাপাশি সরকারের কোটি টাকায় কেনা নতুন নৌ অ্যাম্বুলেন্সগুলো পানিতে পচে মাটিতে মিশে যাচ্ছে। এ সকল বিষয় দেখার কেউ নেই।
অনুসন্ধানের তথ্য বলছে, ২০১৩ সালের ২৮ অক্টোবর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক চিঠি থেকে জানা যায়, জি-১১৯৯ নম্বর প্যাকেজে দেশের আট জেলার ১০টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জন্য প্রত্যেককে একটি করে নৌ-অ্যাম্বুলেন্স বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। সেটি হচ্ছে সিলেট ও সুনামগঞ্জের হাওর অঞ্চলে, পটুয়াখালীর দশমিনা নদীর উপকুল অঞ্চলে, বরগুনার বাউফল উপকুল অঞ্চলের উপজেলাগুলোতে স্বাস্থ্য সেবার জন্য। তাদের মধ্যে একটি সুনামগঞ্জের তাহিরপুর। ওই বছরের ২৮ ডিসেম্বর নৌ-অ্যাম্বুলেন্সটি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পৌঁছে। ব্যবহার শুরুর তিন বছর পর পর নৌ-যানটি সংস্কারের কথাও উল্লেখ ছিল ওই চিঠিতে।
এদিকে নৌযান পাওয়ার একমাস পরে ২০১৪ সালের ১৩ জানুয়ারি এক চিঠিতে জেলার সিভিল সার্জনকে তাহিরপুর স্বাস্থ্য কর্মকর্তা জানাচ্ছেন, শুরু থেকেই নৌ-অ্যাম্বুলেন্স চালানোর জন্য কোনো চালক না থাকায় তা তাহিরপুর থানার উত্তর পাশের নদীতে রাখা হয়েছে। এটি দেখাশোনার জন্য স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের দুজন নিরাপত্তা প্রহরীর মধ্যে একজনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এতে হাসপাতালের লোক স্বল্পতা তৈরি হওয়ায় নৌ-অ্যাম্বুলেন্স রক্ষণাবেক্ষণে নতুন লোক নিয়োগের জন্য অনুরোধ করা হয়। চিঠিটি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ছাড়াও অধিদপ্তরের হাসপাতাল ও ক্লিনিকসমূহ শাখার পরিচালক, কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের পরিচালক, তাহিরপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, নির্বাহী কর্মকর্তা, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) কাছেও অনুলিপি পাঠানো হয়।
এরপর ২০১৫ সালের ২৫ নভেম্বর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হাসপাতাল-৪ অধিশাখার এক চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে ওই বছরের ৮ ডিসেম্বর নৌ-অ্যাম্বুলেন্সের তথ্য জানাচ্ছেন তাহিরপুরের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা। এতে একটি ছকের ৭ নম্বরে ‘অ্যাম্বুলেন্সে কর্মরত ড্রাইভারের সংখ্যা’ ঘরে জানাচ্ছেন ‘নাই’। ১২ নম্বর ‘মন্তব্য’ ঘরে জানানো হচ্ছে অ্যাম্বুলেন্সটি ‘অচল অবস্থায় সংরক্ষণ আছে।
অপরদিকে ২০১৩ সালে এক চিঠিতে আট স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সকে নৌ-অ্যাম্বুলেন্স দেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। শুধু তা-ই নয়, ২০২৩ সালের ৭ জুন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রশাসন ও অর্থ শাখার সহকারী পরিচলকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে সরাসরি লাইন ডিরেক্টরকে এক চিঠি দেন তাহিরপুরের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা। শুরু থেকে চালক নিয়োগ না দেওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করে তিনি লেখেন, ‘বর্তমান বর্ষা মৌসুমে হাওর বেষ্টিত এলাকায় জনগণের সেবার মান বৃদ্ধির জন্য একজন নৌ-অ্যাম্বুলেন্স চালক একান্ত প্রয়োজন।
অপরদিকে সুনামগঞ্জের হাওর অধ্যুষিত চার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চারটি নৌ-অ্যাম্বুলেন্স দেয় সরকার। কিন্তু নৌযান চালানোর জন্য চালক ও তেলের বরাদ্দ দেয়নি কর্তৃপক্ষ। এতে রোগীবহনে একদিনও ব্যবহার করা যায়নি অ্যাম্বুলেন্সগুলো। পড়ে থেকে নষ্ট হয়ে গেছে।
স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, সুনামগঞ্জের হাওর অঞ্চলের বাসিন্দাদের জরুরি স্বাস্থ্যসেবা দিতে কেনা হয়েছিল চারটি আধুনিক নৌ-অ্যাম্বুলেন্স বা এক শয্যার ক্লিনিক বোট। প্রতিটি নৌযানের দাম ছিল ৩০ থেকে ৪০ লাখ টাকা। এতে খরচ দাঁড়ায় প্রায় দেড় কোটি টাকা। কিন্তু চারটি অ্যাম্বুলেন্সের মধ্যে তিনটিই চলেনি কোনো দিন। উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের অযত্ন-অবেহেলায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বোটগুলো। কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না এর মধ্যে থাকা সরঞ্জাম। চুরি হয়ে গেছে অধিকাংশ। ব্যবহার না হওয়ায় খুলে রাখা হয়েছে এর ইঞ্জিন। চালক ও তেলের বরাদ্দ না থাকায় এমন অবস্থা হয়েছে বলছেন উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা। এ জন্য ব্যবস্থা নিতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেওয়ার কথা জানান সিভিল সার্জন।
২০১৩ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত জেলার তাহিরপুর, জামালগঞ্জ, শাল্লা ও ধর্মপাশা উপজেলার জন্য চারটি নৌ-অ্যাম্বুলেন্স কিনে তৎকালীন সরকার। এ সব অ্যাম্বুলেন্স এখন পরিত্যক্ত।
অন্যদিকে সরেজমিনে দেখা গেছে, উপজেলায় বসবাসরত অসুস্থ রোগীর জন্য বরাদ্দ নৌ-অ্যাম্বুলেন্সগুলো পড়ে আছে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সামনে। এগুলো আর চলাচলের উপযোগী নয়। নৌযানের কোথাও ছিদ্র, কোথাও বোর্ড-কাঠ পচে গেছে। ইঞ্জিন নষ্ট হয়ে গেছে। তথ্য অনুযায়ী, প্রতিটি অ্যাম্বুলেন্সের ভেতর ১৭ ধরনের সরঞ্জাম থাকার কথা থাকলেও সরজমিনে কোথাও ২টি আছে, আবার কোথাও একটিও নেই। রোগী বহনের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম নেই একটিতেও।
জামালগঞ্জ উপজেলার হাওরবাসীদের স্বাস্থ্যসেবার জন্য ২০১৮ সালে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে একটি নৌ-অ্যাম্বুলেন্স দেয় সরকার। তবে এটি চালানোর জন্য তেল ও চালকের বরাদ্দ ছিল না। নৌ-যানটির সন্ধানে চলতি বছরের ২৯ আগস্ট যাওয়া হয় জামালগঞ্জ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। অনেক খোঁজাখুঁজির পর স্থানীয় থানার সামনের একটি ঝোপের ভেতর খুঁজে পাওয়া যায় অ্যাম্বুলেন্সটি, পরিত্যাক্ত অবস্থায় পরে আছে। এছাড়া পাশের স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের নৌ-অ্যাম্বুলেন্সটির খোঁজে সম্প্রতি যাওয়া হয়েছিল হাসপাতালে। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সামনের একটি ডোবায় দেখা যায় অ্যাম্বুলেন্সটি পরিত্যাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে।
এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের নৌ-অ্যাম্বুলেন্সটি দেওয়া হয় ২০১৩ সালে। তবে এরপর একদিনও ব্যবহার করা হয়নি এটি। কর্তৃপক্ষের দাবি, বোটটি হাসপাতালের পুকুরে ডুবিয়ে রাখা হয়েছে। এ ছাড়া অন্য উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সরকারের দেওয়া উপহার অ্যাম্বুলেন্সটি কোথায় আছে, তার অস্তিত্বই পাওয়া যায়নি।
অ্যাম্বুলেন্সের সরঞ্জাম কোথায় গেছে, এমন প্রশ্নের জবাবে তাহিরপুর স্বাস্থ্য কর্মকর্তা (সদ্য বিদায়ী) রিয়াদ হাসান প্রথমে কথা বলতে চাননি। পরে নিয়ে যান হাসপাতালের পুকুরপাড়ে। তিনি জানান, এই পুকুরেই ডুবিয়ে রাখা হয়েছে অ্যাম্বুলেন্সটি। কিন্তু বাস্তবে তা দেখতে পাননি এই প্রতিবেদক। তবে নৌ-অ্যাম্বুলেন্সের কয়েকটি টুকরোর খোঁজ মেলে হাসপাতালের পরিত্যাক্ত একটি ভবনে। অ্যাম্বুলেন্সটি ক্রয়ের সময় ১৭ ধরনের সরঞ্জাম থাকলেও পরিত্যাক্ত ভবনের একটি কক্ষে শুধু ইঞ্জিন ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায়নি।
উপজেলার বাসিন্দা তানভির জানান, বোট যদি পানিতে ডুবিয়ে রাখে, তাহলে এটা নষ্ট হয়ে যাবে। যতদিন যাবে বোটের বিভিন্ন অংশ পঁচে খুলে খুলে পড়বে। নৌ-অ্যাম্বুলেন্সে অক্সিজেন সিলিন্ডার, সংস্কারের এক সেট যন্ত্র, রক্ষণাবেক্ষণ সরঞ্জামসহ অন্যান্য জরুরি চিকিৎসা উপকরণের খোঁজ মেলেনি কোথাও।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধি জোনাব আলী বলেন, সরকার নৌ-অ্যাম্বুলেন্স দিয়েছে উপকুল এবং হাওরবাসীর সেবার জন্য, কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের গাফিলতির কারণে এসব গুরুত্বপূর্ণ জিনিস নষ্ট হচ্ছে। প্রত্যন্ত এলাকার মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে নৌ-অ্যাম্বুলেন্সগুলো প্রয়োজনীয় সংস্কারের পর চালুর দাবি জানাচ্ছি।
নৌ-অ্যাম্বুলেন্স পড়ে থেকে নষ্ট হওয়ার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে সচেতন নাগরিক কমিটির স্থানীয় সভাপতি খলিল রহমান বলেন, তেল ও চালক না দেওয়ায় নৌ-অ্যাম্বুলেন্স প্রকল্পটির উদ্যোগ হাওরবাসীর কোনো কাজেই আসছে না। এই নৌ-যানগুলো সুষ্ঠভাবে ব্যবস্থাপনা করা হয়নি, ফলে এই দুরবস্থা হয়েছে। অ্যাম্বুলেন্সগুলোর দায়িত্বে যারা ছিলেন তাদের জবাবদিহির আওতায় নিয়ে আসা উচিত, কেন এত মূল্যবান জিনিসগুলে নষ্ট হলো।
জেলার সিভিল সার্জন জসিম উদ্দিন বলেন, এগুলোর জন্য শুরু থেকেই চালক ও তেলের কোনো বরাদ্দ ছিল না। তাই এগুলো দীর্ঘদিন ধরেই পরে আছে। এতে সরঞ্জাম নষ্ট হবে, এটাই স্বাভাবিক। হয় এগুলো চালানোর মতো সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হোক, না হয় ফেরত নেওয়া হোক।
সিলেট স্বাস্থ্য বিভাগের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ গৌছ আহমদ চৌধুরী বলেন, ওয়াটার অ্যাম্বুলেন্স বিষয়ে আমাদের কাছে কোনো পত্র আসেনি। তবে এই বিষয়টা সরাসরি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সাথে মন্ত্রণালয় থেকে যোগাযোগ করা হয়। তারপরও আমরা মন্ত্রণালয়ে বিভিন্ন মিটিং এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছি। আমরা এখনো কোনো উত্তর পাইনি।