দেশজুড়ে খ্যাতি কুড়াচ্ছে নরসিংদীর ঘোড়াশালের সু-স্বাদু আনারস

- আপডেট সময় : ০৩:৪৭:০৪ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২০ মে ২০২৫ ২১ বার পড়া হয়েছে
নরসিংদীতে এবার আনারসের বাম্বার ফলন হয়েছে। বাজারে আনারসের দাম ভাল থাকায় চাষীদের মুখে হাসি ফুটে উঠেছে। নরসিংদী জেলার নরসিংদী সদর, রায়পুরা, বেলাব, মনোহরদী, শিবপুর ও পলাশ উপজেলায় আনারসের চাষ হয়ে থাকে।
বিশেষ করে স্বাদ ও গুণগত মানের কারণে সারা দেশে খ্যাতি কুড়াচ্ছে পলাশ উপজেলার ঘোড়াশালের রাবানের আনারস। নরসিংদীর একটি প্রবাদ আছে, রাবানের আনারস রসে টস টস। আনারস উৎপাদনের দিক থেকে ঘোড়াশাল বাংলাদেশের প্রসিদ্ধতম স্থান হিসেবে ব্যাপক পরিচিত লাভ করেছে। ঘোড়াশাল পৌর এলাকার সিংহভাগ ও জিনারদী ইউনিয়নের প্রায় তিন চতুর্থাংশ জমি আবহাওয়ার দিক থেকে আনারস চাষের উপযোগী।
এ এলাকার কৃষকদের প্রধান অর্থকরী ফসল হচ্ছে আনারস। আনারস অন্যতম প্রধান রসাল, সুস্বাদু ও সুমিষ্ট ফল। এসব এলাকার অধিকাংশ মানুষের জীবিকা নির্বাহ ও অর্থকরী ফসল হচ্ছে একমাত্র আনারস চাষ। প্রায় ১৫০ বছর আগে ঘোড়াশালে দেশীয় জাতের আনারসের চাষ হতো। ঘোড়াশালে চাষকৃত আগের দেশীয় জাতের আনারস তেমন মিষ্টি ও সুস্বাদু ছিল না। দেশীয় জাতের আনারস ঘোড়াশালে প্রায় ১৫০ বছর যাবৎ চাষাবাদের ফলে ধীরে ধীরে এ জাতটির গুণগতমান ও গঠনগত আকৃতি লোপ পায়।
জিনারদী ইউনিয়নের রাবান এলাকার পরিমল চন্দ্র সাহা নামে এক ব্যক্তি সিলেটে বেড়াতে গেলে সেখান থেকে কিছু আনারসের চারা এনে রাবান এলাকায় রোপণ করে পর্যায়ক্রমে ব্যাপক প্রসার ঘটান। পরবর্তীতে ঘোড়াশালে দেশীয় জাতের আনারসের জাতটির বিলুপ্ত ঘটে। সিলেট চাষকৃত আনারসের জাতটি সিলেটের আবহাওয়ায় তেমন খাপ খেতে পারেনি। এছাড়া আবহাওয়া অনুকূলে না থাকার কারণে সিলেটে চাষকৃত আনারসগুলো তেমন সুস্বাদু ও মিষ্টি ছিল না। সিলেটের আনারসের এই জাতটি ঘোড়াশালের আবহাওয়া ও মাটির সঙ্গে খাপ খেলে এবং আনারস চাষে অনুকূল আবহাওয়া থাকায় গঠনগত স্বাদের দিক দিয়ে আনারসগুলোর ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। প্রায় ৪০ বছর আগে সিলেটের আনারসের এ জাতটি ঘোড়াশালে আসে। ঘোড়াশালে আনারস চাষের জন্য আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় ৪০ বছরে এ জাতটি ঘোড়াশালে ব্যাপক সফলতা লাভ করে এবং এর ব্যাপক প্রসার ঘটে। ঘোড়াশালে চাষকৃত সিলেটের এ প্রজাতির আনারসের জাতটি ঘোড়াশালে জলডুগি আনারস নামে সর্বমহলে পরিচিতি লাভ করে। এর বৈজ্ঞানিক নাম হলো হানিকুইন। কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে জানা যায়- প্রতি একর জমিতে প্রায় ১৮ হাজার আনারসের চারা রোপণ করা হয়। এই এলাকায় ১৬৫ হেক্টর জমিতে আনারসের চাষ করা হয়। আনারস চাষের এলাকাগুলো হচ্ছে- রাবান, কুড়াইতলী, বড়িবাড়ি, কাটাবের, বরাব, ধলাদিয়া, গোবরিয়াপাড়া, লেবুপাড়া, সাতটিকা ও চরনগরদী। আনারস চাষি রাখাল চন্দ্র দাস ৬ বিঘা জমিতে ও বিমল সেন ৮ বিঘা জমিতে আনারস চাষ করেন। তাদের সাথে আলাপ করে জানা যায়- তারা প্রায় ৩২ বছর ধরে আনারসের চাষ করে আসছে। তারা জানায়, প্রতি বিঘা জমিতে আনারস চাষে ১৫ হাজার টাকা খরচ হলে আনারসের ফলন ভালো হলে প্রতি বিঘার আনারসে বিক্রি হয় প্রায় ৬৫/৭০ হাজার টাকা। এতে দেখা যায় লাভ হয় বহু গুণ।
অনেক লোক আনারস চাষ করে বহু সম্পদের মালিক হয়েছেন। ঘোড়াশালের আনারস চাষ দেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক ভূমিকা পালন করছে। আনারসের ফলন ভাল হলে প্রতি বছর আনারসে ঘোড়াশাল আয় হয় প্রায় ১২ কোটি টাকা। প্রতি একর জমিতে প্রায় ১৮ হাজার আনারসের চারা রোপণ করা হয়। ঘোড়াশালে পর্যাপ্ত পরিমাণ আনারস উৎপন্ন হয়। কৃষকরা জানায়, আনারস পচনশীল ফল হিসেবে এর সংরক্ষণ ব্যবস্থা থাকা দরকার।
আনারস সংরক্ষণের জন্য ঘোড়াশালে কোনো হিমাগার আজও পর্যন্ত তৈরি হয়নি। কৃষকরা আনারস সংরক্ষণের জন্য একটি হিমাগার স্থাপনের জন্য সংশিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট দাবি জানান। ঘোড়াশালে আনারস চাষে চাষিদের মনোবল রয়েছে পর্যাপ্ত। আধুনিক সভ্যতার যুগে এখনও ঘোড়াশালে সনাতন পদ্ধতির মাধ্যমেই আনারসের চাষ হচ্ছে। আনারস চাষিরা জানান, আধুনিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে আনারস চাষ করলে আরও অধিক ফলন হতো এবং দেশও অর্থনৈতিকভাবে একটু লাভবান হতো।
এ ব্যাপারে পলাশ উপজেলা কৃষি অফিসার আয়েশা আক্তার জানান, এ বছর পলাশে ১৬৫ হেক্টর জমিতে আনারস চাষ হয়েছে। গত বছর অতি খরায় আনারসের আকার ছোট ছিল। কিন্তু এবার আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় আনারসের আকার বেশ বড় হয়েছে। তিনি জানান প্রতি হেক্টর জমিতে ২০ মে. টন আনারসের উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে। ৮শ’ গ্রাম থেকে দেড় কেজি পর্যন্ত একটা আনারসের ওজন হওয়ায় কৃষকরা এ বছর অধিক লাভের মুখ দেখতে পাবে। এ বছর পলাশ উপজেলায় ১৬৯৫ মে.টন আনারস উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
ঘোড়াশালের আনারস দেশের মধ্যে সুস্বাদু আনারস হিসেবে পরিচিত বলে এর চাহিদা ব্যাপক। সারা দেশে এ আনারসের নাম ঘোড়াশাল আনারস হিসেবে সবাই চিনে বলে কৃষি অফিসার জানান। তিনি আরো জানান অল্প সময়ে অধিক ফলন ও ব্যাপক লাভবান হওয়ায় মানুষ এ আনারস চাষের দিকে আগ্রহ দেখাচ্ছে। আগামী বছর থেকে উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে আমরা কৃষকদের আরো উন্নত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে।