নতুন ডিসিরা আলোচনায়, নিরপেক্ষতা নিয়ে বিতর্ক
- আপডেট সময় : ১৩০ বার পড়া হয়েছে
আগামী নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে জেলা প্রশাসক (ডিসি) নিয়োগ নিয়ে প্রশাসনে এক নতুন বিতর্ক উত্থাপিত হয়েছে। সাম্প্রতিক প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী দেশব্যাপী অন্তত ৫০ জেলায় নতুন ডিসি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
জেলা প্রশাসক নিয়োগকে কেন্দ্র করে প্রশাসনের ভেতরে অস্বাভাবিক নীরব অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, মাঠ প্রশাসন, নিরাপত্তা সংস্থা এবং বিভিন্ন জেলায় দায়িত্ব পালনকারী একাধিক সিনিয়র কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে স্পষ্ট হয়েছে, এ বছরের ডিসি নিয়োগ গত দুই দশকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত, বিতর্কিত এবং ঝুঁকিপূর্ণ পদায়ন হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। সরকারি নথি, প্রশাসনের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ এবং অতীত রেকর্ড বিশ্লেষণেও এই আশঙ্কা আরও ঘনীভূত হয়েছে। এসএসবি–সুপারিশকৃত তালিকা উপেক্ষা করে এমন বহু কর্মকর্তাকে জেলা নেতৃত্বে বসানো হয়েছে, যাদের বিরুদ্ধে অতীতে তদন্ত বা অভিযোগ ছিল, যাদের রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠতা প্রকাশ্য, অথবা যারা সংশ্লিষ্ট জেলার জন্য প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতার ঘাটতিতে ভুগছেন। এসএসবির তালিকার সঙ্গে বাস্তব নিয়োগের মিল মাত্র ৩৮ শতাংশ, যা অভ্যন্তরীণভাবে নজিরবিহীন বলে দাবি করছেন দায়িত্বশীলরা।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব এবং প্রধান উপদেষ্টার মুখ্য সচিবের ব্যক্তিগত পছন্দই নিয়োগ প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছে বলে মন্তব্য করেছেন অন্তত তিনজন যুগ্মসচিব। একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল জেলা বাছাই করে সেসব স্থানে এমন ব্যক্তিদের পাঠানো হয়েছে, যাদের বিশ্বস্ততা আগেই প্রতিষ্ঠিত ছিল। এরই মধ্যে প্রশাসনের ভেতরে আলোচনায় এসেছে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী সরকার আমলে গড়ে ওঠা দুই বড় লবি—বিশেষ করে এইচ টি ইমাম নেটওয়ার্ক—যা মাঠ প্রশাসনে দীর্ঘদিন ধরেই প্রভাব বিস্তার করে এসেছে। তাদের সঙ্গে যুক্ত একাধিক কর্মকর্তার আবারও কৌশলগত জেলায় পুনঃউত্থান প্রশাসনের উচ্চপর্যায়ে নতুন প্রশ্ন তুলেছে। অতীতে এই নেটওয়ার্ক নির্বাচনী প্রকল্প তদারকি, মিডিয়া কন্ট্রোল এবং মাঠ প্রশাসনের মাধ্যমে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারে সক্রিয় ছিল। ২০২৪ সালের বিতর্কিত নির্বাচনেও তাদের ভূমিকা নিয়ে অজস্র বিতর্ক তৈরি হয়েছিল। এখন সেই কাঠামোরই কিছু অংশ পুনর্গঠিত হয়ে আসন্ন নির্বাচনের আগে ফের শক্তিশালী হচ্ছে বলে মনে করছেন সিনিয়র কর্মকর্তারা।
বিভিন্ন জেলায় নিয়োগ পাওয়া বেশ কিছু কর্মকর্তার অতীত রেকর্ড নিয়েও তীব্র সমালোচনা রয়েছে। পাবনার ডিসি হিসেবে নিয়োগ পাওয়া শাহেদ মোস্তফা অতীতে দুবার গোপন অনুসন্ধানের মুখে পড়েছিলেন—একবার টেন্ডার প্রভাবিত করা ও আরেকবার আর্থিক অনিয়মের নথি গোপন রাখার অভিযোগে। রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে তিনি দু’বারই তদন্ত এড়ালেও প্রশাসনের মধ্যে তার পরিচিতি সবসময়ই সরকার–ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তা হিসেবে। পাবনা আসন্ন নির্বাচনের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল, যা এই নিয়োগ নিয়ে আরও সন্দেহ তৈরি করেছে। নারায়ণগঞ্জে রায়হান কবিরকে পাঠানোও প্রশাসনে অস্বস্তি তৈরি করেছে। ছাত্রলীগের মিছিলে অংশ নেওয়ার ভিডিও এখনো অনলাইনে রয়েছে, আর তিনি ইকোনমিক ক্যাডারের হওয়ায় মাঠ প্রশাসনের নেতৃত্ব–প্রশিক্ষণ সীমিত। জেলার শক্তিশালী এসপি–র সঙ্গে সমন্বয়–সংকট তৈরি হওয়ার আগাম সতর্কতা ইতোমধ্যে মন্ত্রণালয়ে পৌঁছেছে।
এছাড়া নারায়ণগঞ্জের সদ্য বিদায়ী ২৫ ব্যাচের বিতর্কিত ডিসি জাহিদুল ইসলাম মিয়াকে চট্টগ্রামে বদলি করা হয়েছে। তাকে ঘিরে দীর্ঘদিন চাপা থাকা দুর্নীতির অভিযোগ বদলির পর বিস্ফোরিত হয়েছে। উন্নয়ন প্রকল্প, ঠিকাদারি, শিল্পকারখানা, পরিবহন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, জমি অধিগ্রহণ, এনওসি ও ছাড়পত্র—প্রায় সব খাতেই ১০–১৫% কমিশন নেওয়া হতো বলে অভিযোগ রয়েছে।
কুড়িগ্রামে অন্নপূর্ণা দেবনাথের নিয়োগ নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। ছাত্রলীগ-অতীত, উপভূমি সংস্কার কমিশনে চাকরির সময় জমি–সংক্রান্ত একটি মামলায় নাম আসা এবং রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠতার কারণে প্রকাশ্য সমর্থন পাওয়া—এসব কারণে সীমান্তবর্তী এই জেলার জন্য তাকে ঝুঁকিপূর্ণ মনে করছেন সিনিয়র কর্মকর্তারা। রংপুরে মোহাম্মদ এনামুল আহসানকে পাঠানো হয়েছে, যিনি অতীতে এইচ টি ইমাম ঘনিষ্ঠ ছিলেন এবং তথ্য মন্ত্রণালয়ে ‘থ্রি–ম্যান সিন্ডিকেট’ নামে পরিচিত একটি দলে প্রভাবশালী ছিলেন। তার বিরুদ্ধে একাধিক অনিয়মের লিখিত অভিযোগ থাকলেও কোনো তদন্ত এগোয়নি। যশোরের মতো স্ট্র্যাটেজিক জেলায় পাঠানো হয়েছে মোহাম্মদ আশেক হাসানকে, যিনি রাজনৈতিক সুপারিশে পদোন্নতি পেয়েছিলেন এবং গণ–অভ্যুত্থানের সময় প্রশ্নবিদ্ধ আচরণ নিয়ে অভ্যন্তরীণ আলোচনা ছিল।
বরগুনায় তাছলিমা আক্তার, রাঙামাটিতে নাজমা আশরাফি এবং ঢাকায় রেজাউল করিম—এই তিন নিয়োগ নিয়েও সমালোচনা প্রশাসনের ভেতরে উচ্চমাত্রার। পার্বত্য অঞ্চলের মতো সংবেদনশীল এলাকায় রাজনৈতিকভাবে চিহ্নিত কর্মকর্তাকে পাঠানোকে অনেকেই বিপজ্জনক সিদ্ধান্ত বলে মনে করছেন। অন্যদিকে ঢাকার মতো জটিল ও অতি-চাপযুক্ত জেলার ডিসি হিসেবে এমন একজনকে বসানো হয়েছে, যিনি ছাত্রলীগ-অতীত থাকা সত্ত্বেও মাঠ প্রশাসনে তেমন উল্লেখযোগ্য অভিজ্ঞতা দেখাতে পারেননি। ঢাকার মতো স্থানে হকার ব্যবস্থাপনা, নগর–ঝুঁকি, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ, উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনায় দক্ষতা অপরিহার্য হলেও তার রেকর্ড প্রশ্নের মুখে আছে বলে জানিয়েছেন ঢাকায় দায়িত্ব পালন করা একাধিক কর্মকর্তা।
সবচেয়ে বিতর্কিত নিয়োগগুলোর মধ্যে রয়েছে ঝিনাইদহের আবদুল্লাহ আল মাসউদ, যিনি অতীতে সরকারি গাছ কাটার অভিযোগে “গাছখেকো মাসউদ” নামে পরিচিত ছিলেন। সাংবাদিকরা বিষয়টি প্রকাশ করলে তিনি উল্টো তাদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করতে চাপ দিয়েছিলেন বলেও অভিযোগ ছিল। এসব রেকর্ড থাকা সত্ত্বেও তাকে আবারও জেলা প্রশাসনের নেতৃত্বে বসানোকে প্রশাসনের একাধিক কর্মকর্তা মাঠ প্রশাসনের জন্য অপমানজনক বলে মন্তব্য করেছেন।
এই নিয়োগ–তালিকা ঘোষণার পর মাঠ প্রশাসনে আরও যে সংকটটি প্রকট হয়ে উঠেছে তা হলো সিনিয়র–জুনিয়র দ্বন্দ্ব। অন্তত ১৭ জেলায় ডিসিরা এসপির জুনিয়র, ৯ জেলায় ডিসির অভিজ্ঞতা ওই জেলার প্রশাসনিক বাস্তবতার তুলনায় কম, এবং ১২ জেলায় স্থানীয় রাজনৈতিক নেটওয়ার্ক ডিসির নিয়ন্ত্রণের বাইরে রয়েছে। নিরাপত্তা সংস্থার একটি অভ্যন্তরীণ নথিতে নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা, পাবনা, যশোর, কক্সবাজার, রংপুর, সিলেট ও ঢাকাকে আগামী নির্বাচনের জন্য উচ্চ–ঝুঁকিপূর্ণ জেলা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই জেলাগুলোতে রাজনৈতিকভাবে চিহ্নিত বা অভিজ্ঞতাহীন ডিসিদের পাঠানো পরিস্থিতি আরও অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে।
প্রশাসনের ভেতরে অসন্তোষ এখন প্রকাশ্য না হলেও বিস্তৃত। বহু সিনিয়র কর্মকর্তা বলেছেন, মেধা, অভিজ্ঞতা, সততা—কিছুই আর মাঠ প্রশাসনে মূল্য পাচ্ছে না। কেউ কেউ আরও সরাসরি বলেছেন, এটি নির্বাচনের আগে প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার স্পষ্ট পরিকল্পনা। ভবিষ্যতে নির্বাচনী সহিংসতা বৃদ্ধি, প্রশাসনের নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হওয়া এবং দীর্ঘমেয়াদে মাঠ প্রশাসনের মনোবল ভেঙে পড়া—এই তিনটি ঝুঁকি তারা সবচেয়ে বেশি আশঙ্কা করছেন। তাদের ভাষায়, ডিসি নিয়োগ এবার একটি প্রশাসনিক ঘটনা নয়, এটি রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোর স্থিতিশীলতার ওপর সরাসরি আঘাত।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের একটি অভ্যন্তরীণ চিঠি অনুযায়ী, রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ জেলায় বিশেষ নজরদারির জন্য বিশ্বস্ত কর্মকর্তা নিশ্চিত করতে হবে—এমন নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এই চিঠির ভিত্তিতে ১২ জন কর্মকর্তাকে সরাসরি মন্ত্রিপরিষদ সচিবের পছন্দের তালিকা থেকে নিয়োগ দেওয়া হয়, যাদের মধ্যে ৭ জনের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনে অভিযোগ রয়েছে। আন্তর্জাতিক তুলনায় বাংলাদেশে রাজনৈতিক নিয়োগের হার ৬২ শতাংশ, যেখানে ভারত ও শ্রীলঙ্কায় এই হার যথাক্রমে ১২ ও ৮ শতাংশ। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের ২০২৪ সালের সূচক অনুযায়ী বাংলাদেশের স্কোর ৪১, যা উদ্বেগজনক।
নতুন বিতর্কিত নিয়োগগুলোর মধ্যে কুমিল্লার সাইফুল ইসলাম ২০২৩ সালে একটি টেন্ডারে অনিয়মের তদন্তাধীন ছিলেন এবং তার স্ত্রীর নামে তিন কোটি টাকার সম্পদ বিদেশে রয়েছে বলে বিএফআইইউতে রিপোর্ট করা হয়েছে। সিলেটের নাজমুন নাহার ছাত্রলীগের সাবেক নেত্রী এবং তার ভাই সিলেট সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলর, যা স্বজনপ্রীতির আশঙ্কা বাড়িয়েছে। কক্সবাজারের মাহবুব আলমের বিরুদ্ধে ২০২২ সালে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ত্রাণ বাণিজ্যের অভিযোগে ইউএনএইচসিআরের অভ্যন্তরীণ চিঠিতে নাম এসেছে। বরিশালের ফারজানা ইসলাম ইকোনমিক ক্যাডার হওয়ায় মাঠ প্রশাসনে কোনো অভিজ্ঞতা নেই এবং তার বাবা বর্তমান সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য। ঝিনাইদহের আবদুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধে ২০২১ সালে দুদকে তিনটি লিখিত অভিযোগ দাখিল হলেও কোনোটি তদন্ত হয়নি।
প্রশাসনের ভেতরে প্রতিক্রিয়া তীব্র। এক যুগ্মসচিবের অভ্যন্তরীণ বার্তায় বলা হয়েছে, এটি আর প্রশাসন নয়, এটি রাজনৈতিক ক্যাডারে পরিণত হওয়ার শুরু। বিভাগীয় কমিশনারদের একটি গোপন বৈঠকে ৮ জনের মধ্যে ৬ জন লিখিতভাবে মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে জানিয়েছেন, নতুন ডিসিদের অনেকেই স্থানীয় প্রশাসনিক সংস্কৃতি বোঝেন না এবং নির্বাচনী প্রস্তুতিতে সহযোগিতা কমে যেতে পারে। নিরাপত্তা সংস্থার একটি অভ্যন্তরীণ নথিতে নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা, পাবনা, যশোর, কক্সবাজার, রংপুর, সিলেট ও ঢাকাকে আগামী নির্বাচনের জন্য উচ্চ–ঝুঁকিপূর্ণ জেলা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।


















